যখন বাড়ি থেকে বেরুনোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম তখন শরতের মাত্র কদিন গিয়েছে। গাছের পাতায় পাতায় মেহদির রঙ কেবল লাগতে শুরু হয়েছে। কিন্তু উত্তাপ বড় বেশি নিচে নেমে ছিল। প্রতিদিন হিটার চালিয়ে বাড়ি গরম করতে হচ্ছিল। অথচ এ সময়ে বেশ আরামদায়ক উষ্ণতা থাকার কথা। এবছর শুরু থেকেই কেমন যেন আবহাওয়ার চালচলন।
যখন বৃষ্টি হওয়ার কথা তখন একদমই বৃষ্টি হলো না। শীতকালে বরফ পাতও ছিল তুলনামূলক অনেক কম। পানির উপর প্রভাবটা গ্রীষ্মকালে বেশ বোঝা গেল। লেইক, নদীর জলের সীমারেখা এত নিচুতে নামতে আগে কখনো দেখিনি।
পাখিগুলো শুকনো লেইকে গম্ভীর হয়ে বসে আছে যখন তাদের জলের সাথে খেলা করার সময়। কোথাও জলের দেখা মিললে দল বেঁধে উড়ে গিয়ে, ঝাঁপিয়ে পরছে সেখানে।
ওরাও যেমন জলের জন্য তৃষিত তেমনি ফসলের মাঠেও ছিল হাহাকার। শুকনো পাতা, কলির ঝরে পরা। অথচ ফসল তোলার আগে যখন বৃষ্টির প্রয়োজন নাই তখন প্রতিদিন বৃষ্টি। ঘনঘন বিদ্যুত চমক। এমন বিদ্যুৎ চমক বজ্রপাতের শব্দ বহুকাল শুনিনি। প্রকৃতির পরিবর্তন যেন চোখে দেখা যাচ্ছে।
শীত আগে এসে গেছে ভেবেছিলাম অথচ জানলাম এখন আবার উত্তাপ বেড়েছে।
যখন দেশের মাটিতে পা রাখলাম। তখন শরতের নীল আকাশ কাশফুলের মায়া দেখতে দেখতে মাটিতে নামলাম। অথচ এয়ারক্রাফটের শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত অবস্থা থেকে বেড়িয়েই পরে গেলাম তাপ অনলের মাঝে। বহুদিন বাদে দরদর ঘাম ঝরতে শুরু করল শরীরে। একে করোনার দূরত্ব রাখার চেষ্টা তার উপর গিজ গিজ মানুষ ভাবনা হীন গায়ের উপর উঠে যাচ্ছে। স্থানে স্থানে লেখা আছে, দূরত্ব বজায় রাখুন। নো মাস্ক নো সার্ভিস" খুব সুন্দর কথা" । প্রচেষ্টা যথাযথ। কিন্তু মানছে না সবাই। কারো ঠিক ঠাক মাস্ক পরা নাই, তো কারো মাস্কই নাই। চারপাশে খুঁজলাম হ্যাণ্ডসেনেটাইজার কোথও রাখা আছে কিনা। না নেই। ঘন্টা খানেক আর্মি পাহাড়া দিয়ে আটকে রাখল, দাঁড়িয়ে আছি অপেক্ষায় চেক আউট করার জন্য। নিচে নাকি পাঁচ ছয় প্লেনের যাত্রীর ভীড় তাই অপেক্ষা করতে হচ্ছে আমাদের। কি আর করা সেফটির জন্য অপেক্ষাই সই। করোনা মেডিকেল চেকাপের জন্য এই অপেক্ষার সময় বাড়ছে। এক সময় আমাদের নিচে নামার সুযোগ হলো। কে কার আগে যাবে, বাঙালির সেই চরিত্রগত অভ্যাসের ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে গেলো আবার। যদিও গার্ডরা লাইনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। একজন না সরলে এগুনোর উপায় নেই। কিন্তু মানুষের প্রবণতা যেন আরেক জনের গায়ের উপর উঠে থাকলেই তাড়াতাড়ি যাওয়া যাবে। পিছন থেকে বোরখাওয়ালীর ক্রমাগত ধাক্কা খেতে খেতে বাধ্য হলাম বলতে দূরত্ব রাখুন। গায়ের উপর উঠে আসছেন কেন?
মেডিকেলের চেকআপ শেষ হলে ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়ালাম। যখন আমি আর একজনের পর অফিসারের কাছে পৌঁছাব তখন দেখলাম দুজন অফিসারের একজনও মাক্স পরে নেই। আমি আরো দুজনের পিছনে গিয়ে অন্য লাইনে দাঁড়ালাম তখন। যে অফিসার মাস্ক পরে আছেন, আমি তার কাছেই যাবো।
দুজনের পর যখন আমার পালা তখন দেখি পাশ থেকে অন্য লাইনের একজন আমার সামনে এসে ঢুকে পরছেন লাইনে। তাকেও বলতে বাধ্য হলাম এটা তো আপনার লাইন না মাঝ থেকে ঢুকে পরছেন যে।
ওহো তাই, এটা আলাদা লাইন! যেন তিনি আকাশ থেকে পরলেন। ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানেন না। সত্যি কত রকমের ক্যারিকেচার মানুষের দেখা যে এই এয়ারপোর্টে পাওয়া যায়।
একটা সিম ছিল যাতে রিচার্চ করা হয়েছে কিন্তু কিছুতেই তার কানেকশন পাচ্ছিনা। এক সিম আরেকজনকে বিক্রি করে দেয়া ফোন কোম্পানির অধিকার। রিচার্জের টাকা ফেরত পাওয়ার সুযোগ রইল না।যারা কাছে এই সিম তিনি হয়তো বোনস টাকা পেয়ে অবাক হবেন। বাইরে যে এসেছে তার আসার সময় কতটা হলো জানা নেই। প্লেন নামার পরে প্রায় আড়াই ঘন্টা সময় চলে গেছে।
অবশেষে ব্যাগ কালেক্ট করে বেরিয়ে আসার পথে পেলাম গনফোন । বাধ্য হয়ে সেখান থেকে কথা বললাম। বাটনগুলোর নাম্বার সব উঠে গেছে। আন্দাজে নাম্বার টিপলাম। বেরুচ্ছি, এক কথা বলেই রেখে দিলাম। এতক্ষনের তাপ যেন এখন আরো আগ্রাসী হয়ে উঠল।
শরতের হিমেল হাওয়া কই। নীল আকাশ আর কাশফুলের বাহার যদিও আছে।
এসির বাতাস যদিও আমার খুব অপছন্দ কিন্তু এবার যেন এসি ছাড়া ঘরে আগুনের হলাহল ঘুরে বেড়াচ্ছে। গতবারও এ সময় বেশ প্রকৃতির বাতাস ছিল। এবার যেন সব বাতাস অন্য কোথাও উড়ে গেছে।
সপ্তাহ খানেক গরমে প্রতিদিন আমি আমার এনার্জি হারাতে থাকলাম। খাওয়া ঘুমানো কিছুতেই সুখ নেই। শুয়ে ঘুমাই না অথচ বসে থাকলে মনে হয় শুয়ে থাকি।
কদিনপর শুরু হলো বৃষ্টি তুমুল ঝড় যেন কালবৈশাখি নাচছে প্রতিদিন। ঈষানকোনে মেঘ জমে। তুমুল বৃষ্টি ধেয়ে আসে যখন তখন। শরত না বর্ষা। বৈশাখ না ভাদ্র মাস হিসাবে তালগোল পাকাতে থাকল। আর মাঝে মাঝে এত্ত জোড়ে বাজ পরে চমকে উঠি ঘুমের মধ্যেও। সাধারনত এমন বজ্রবিদ্যুৎ হয় শ্রাবণ মাসে। অথচ কার্তিক মাসে যেন শ্রাবনের মেঘগুলো জড়ো হলো আকাশে অঝরে নামল শ্রাবণের ধারা।
বৃষ্টি হলেই রাস্তা উপচে উঠছে পানি। তার ভিতরে হাঁটা চলা রান্না খাওয়া আসমানিদের বাড়ি, কাজকাম, ফুটপাত দখল করে। উন্নয়নশীল দেশে এও এক দিক বড় বড় প্রাসাদসম অট্টালিকার পাশাপাশি অতি দারিদ্রতার চিহ্ন।
একদিকে নানারকম রিসোর্ট, হোটেল, ক্যাফে, বুফে রেস্টুরেন্ট, নানা জমকালো মল সব যেন চাকচিক্য ছড়ানো দুনিয়া। সুখি এক দেশের ছবি। অথচ সেখান থেকে বেড়িয়ে এলেই সাধারন মানুষ গায়ের উপর গা, ব্যাস্ততা, খাটাখটুনি গতানুগতিক অভাব অনটন, খেটে খাওয়া মানুষের চলাচল । দুইরকম ছবি ছড়ানো দেশ। চাকচিক্যে যাদের বাস আগোড়া, মীনাবাজার, স্বপ্ন, নন্দন, নান্দনিকবাজার আলমাস সুপার শপ, নিত্য দিনের সদাই করার জন্য কিছু মানুষের কাছে বড় প্রিয় হয়ে উঠেছে এমন দোকান গুলো। ঝামেলাহীন কেনাকাটা করার জন্য অথচ কী ভয়ানক দাম। আমার কাছে মনে হয়। যাদের সামর্থ আছে তাদের কাছে আরামদায়ক কেনাকাটা। অন্য দিকে পথের পাশে অল্পদামে কেনাকাটা চলছে খাওয়া দাওয়াও চলছে, আসল বাংলাদেশের চেহারা।
যতদিন দেশের সব মানুষের আয় ব্যায়ের সামর্থ নূন্যতম সমতা হবে না ততদিন দেশের উন্নতির বিকাশ হয়েছে বলে মনে করা যায় না। বেশ কিছু দেশ ঘুরে ঘুরে দেশে আসলাম। সব দেশের গ্রোসারী দোকানের জিনিসের দাম, শপিংমলের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম, সে দেশের মানুষের ক্রয় সীমার মধ্যে এক রকম। বাংলাদেশের মতন এমন আকাশ পাতাল পার্থক্য নেই। এছাড়া কিছু চেইন ফাস্টফুডের খাবারও ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে।
জনসাধারন বেশির ভাগ সময় এসব দোকানে খাবার খায় মানসম্পন্ন এবং সুলভ, ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে। বাংলাদেশের মতন এত পার্থক্য নেই, কেউ কোনদিন পিজ্জা, ডোনাট ,কে এফসি, ম্যাকডোনাল্ড, স্টারবাক্স কফি খেতে পারে না একবেলা। কেউ তিনবেলা খাবারের পর শখ করে এসব খাবার খায়।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে অক্টোবর, ২০২১ রাত ১২:৩৩