ব্রোকেন চেয়ার কাঠের একটি স্মারক ভাস্কর্য। প্রখ্যাত সুইস ভাস্কর শিল্পী ড্যানিয়েল বার্সেট এবং ছুতারমিস্ত্রী বা কাঠমিস্ত্রী লুই জেনিভে নির্মিত। চেয়ারটি কাঠের তৈরি সাড়ে পাঁচ টন ওজনের এবং বারো মিটার উঁচু। এটি একটি ভাঙা পা সহ বিশাল আকারের চেয়ার। প্যালেস অফ নেশনস জেনেভা সুইজারল্যান্ডরে দালানের উল্টো দিকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে।
চেয়ারটা দেখতে অতি সাধারন, আমাদের ঘরের ডাইনিং টেবিলের চেয়ারের মতন। রঙটাও অনেকটা মেহগনি রঙের মতন একটু বেশি লালচে। যার সামনের বা পাশের পায়া অর্ধেক ভেঙ্গে গেছে মনে হয়। ভাঙ্গাটাও যথেষ্ট সযত্নে করা। মনে হয় মুচড়ে ভেঙ্গে নেয়া হয়েছে। বেশ ভালো ক্ষত বিক্ষত।
ভাঙ্গা চেয়ার অসম্ভব রকম একটি ব্যাঙ্গ ভাস্কর্য। পা ভাঙা চেয়ার জেনেভায় প্যালেস অফ প্যালেস অফ নেশনসের সামনে উনিশ সাতানব্বই সন থেকে রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে আছে।
ব্রোকেন চেয়ারের নতুন নাম হ্যান্ডিক্যাপ ইন্টারন্যাশনাল। হিউম্যানিটি অ্যান্ড ইনক্লুয়েশনের অনুরোধে ১৯৭৯ সালে এই কাজটি করেন শিল্পী। জেনেভায় জাতিসংঘ সদর দফতরের সামনে এটা স্থাপন করা হয়। শিল্পর মূল বার্তা ছিল,অ্যান্টিস্টোনাল ল্যান্ডমাইনগুলি নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানানো এবং মাইন বান চুক্তি স্বাক্ষর করে রাজ্যগুলিকে, হামলা নিষিদ্ধ করার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করতে উত্সাহিত করা।
নাগরিক জনগোষ্ঠীর হতাশা সশস্ত্র সহিংসতায় আক্রান্ত সুযোগ থেকে বঞ্চিত, তাদের সুরক্ষা এবং ক্ষতিগ্রস্থদের উদ্ধার করার জন্য যুক্ত রাষ্ট্রের বাধ্যবাধকতা।
মারাত্মক উচ্চাকাঙ্ক্ষা যা নীতি নির্ধারক এবং নাগরিককে সংহত করতে হবে- ব্যক্তি, পরিবার এবং সম্প্রদায়ের যারা সংঘর্ষে জর্জরিত, দুর্বল বা অস্থিতিশীল, তাদের সাথে যেতে হবে, যাতে তারা স্বায়ত্তশাসনের আওতায় পুনরায় অধিকার পেতে পারে।
ব্রোকেন চেয়ার ভাস্কর্যটি ভঙ্গুরতা এবং শক্তি, ভারসাম্যহীনতা এবং স্থায়িত্ব, সহিংসতা এবং মর্যাদাবোধ উভয়েরই প্রতীক। প্লেস ডেস ন্যাশনেল প্যালেসের সামনে স্থাপন করা ভস্কর্যটি যেন মনে করিয়ে দেয় প্রতিটি জাতিসংঘ সদস্যকে তাদের দায়বদ্ধতা সম্পর্কে চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে। এটি তিনটি পায়ে সূক্ষ্ম ভারসাম্যহীন - চতুর্থটি হিংস্রভাবে বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। যুদ্ধ সহিংসতার শিকারের প্রতীক হয়ে এখনও মর্যাদার সাথে লম্বা দাঁড়িয়ে আছে।
ভাঙা চেয়ার, ল্যান্ডমাইন ক্ষতিগ্রস্তদের কষ্টের প্রতীক।
এটি অনুমান করা হয় যে প্রতি বিশ মিনিটে, বিশ্বের কোথাও একজন ল্যান্ডমাইন দ্বারা নিহত বা আহত হয়।
যখন আমরা যুদ্ধ, বা নানাবিধ আক্রমণে লোক মারা যাওয়ার খবর শুনি , তখন প্রচণ্ড ভাবে মর্মাহত হই, আবেগ তাড়িত হই কিন্তু তারপরে, আমরা ভুলে যাই।
চোখের সামনে ভাঙ্গা লাল চেয়ার দেখে ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরিত ক্ষতিগুলো মনে জাগ্রত হয়, এই নিয়ে কাজের আকাংখা বাড়ে সেই প্রতীক হিসাবে সাজিয়ে দেয়া হয়েছে পথের মাঝখানে। শিল্পীদের ভাবনার আকাশ নানা ভঙ্গিতে প্রকাশ পায়। তার প্রতীক দেখতে পেলাম এই সরল সাধারন ভাঙ্গা চেয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে।
নভেম্বর এসে গেলো আর কদিন পরে রিমেম্বারন্স ডে পালিত হবে এগার নভেম্বর, বিশ্বে শান্তির প্রতীক হিসাবে। যুদ্ধ নয় শান্তি। কিছু মানুষ চেষ্টা করছে শান্তির জন্য যদিও যুদ্ধ চলছে ক্রমাগত এখানে নয় ওখানে। দেশে দেশে, সমাজে, বর্ণে, পরিবারে। হিংসা বিদ্বেসের আক্রমণে প্রতিদিন আহত নিহত হচ্ছে অসংখ্য মানুষ পৃথিবী জুড়ে।
ভয়াবহ রকম নৃশংসতা মানুষের মনে। তার মাঝে কিছু মানুষ সংস্থা, শিল্পী মানুষকে আলোকের পথ দেখাতে চান, নিজস্ব কাজে।
ছুটে চলা মানুষ আমি, পৃথিবীর বহুদেশে বহু শান্তির প্রতীকের দেখা পাই। ধরে রাখি মনে এবং কিছু ছবিতে। ব্রোকেন চেয়ারের সাথে দেখা হয়েছিল জেনেভা সুইজারল্যান্ডে চার বছর আগে।
এক পাশে ভাঙ্গা চেয়ার সামনে অনেক দেশের পতাকা উড়ছে গেটের সামনে। তার ভিতর দিয়ে লম্বা পথ চলে গেছে দালানের কাছে। যেখানে অনেক প্রতিনীধীরা মিলিত হয়ে মানুষের উপকারের সিদ্ধান্ত নেন। কতটুকু কার্যকরী হয় কে জানে। তবে আমাদের এই পৃথিবীতে এমন একটা সংস্থা আছে।
সেদিন ছিল আমার শেষদিন সুইজারল্যান্ডে বেড়ানোরআর ছিল রবিবার বন্ধের দিন। তাই দালানের ভিতরে যাওয়ার সুযোগ হলো না। সেখানে আরো অনেক শিল্প ভাষ্কর্য আছে।
রাত দশটায় উড়ব জুরিখ থেকে। তার আগে সারাদিন বাসে করে চক্কর দিচ্ছিলাম জেনেভা শহর শেষবারের মতন। বিকাল চারটার ট্রেন ধরে ফিরে যাবো জুরিখ এয়ারপোর্টে। তারপর বাড়ি ফেরা সেখান থেকে আড়াই মাস পর।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা নভেম্বর, ২০২২ রাত ১১:৩৭