আমাদের দেশে একজন শিক্ষক বইয়ের পাতা ছিড়ে ফেলেছেন। বেশিরভাগ মানুষ সেই শিক্ষককে সাপোর্ট করছেন। কারন দেশে এই সমস্ত শিক্ষা দেয়া ঠিক না । বইয়ের সে পাতায় কি ছিল; বলা হয়েছে একজন ট্রান্সজেন্ডার মানুষের কথা। শরীফার গল্প আসলে একটি সত্যি ঘটনা, সম্ভবত আশির দশকের খবর, সেই সময়ে বাংলাদেশের পত্রিকা খুঁজলে ঘটনাটি পাওয়া যাবে। পড়েছিলাম আমার মনে আছে।
ট্রান্সজেন্ডার গ্রহণ করা তো দূরের কথা, এই ভাবনাটাও তো অনেক দূরের বিষয়। যে দেশের ছেলেমেয়েদের ইচ্ছারই কোন মূল্য দেওয়া হয় না। সন্তানকে সব সময় থাকতে হয় অভিভাবকদের ইচ্ছার অধীনে।
অনেক সময় শুনি, অনেক ছেলে মেয়ে আত্মহত্যা করছে। কেন সেই মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়? অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় তাদের উপর অভিভাবকের চাপিয়ে দেওয়া মত তারা নিতে পারে না । অনেক সময় তুলনা করা হয়, অন্য ভাই-বোনদের সাথে, কাজিনদের সাথে অথবা পাশের বাড়ির সন্তান বা সহপাঠী কারো সাথে। এই সমস্ত ব্যবহার অভিভাবকরা করে আসছেন আদি থেকে, একজন মানুষকে নিজস্ব গুণাগুণে চিহ্নত না করে সব সময় আর কারো মতন হওয়ানোর চেষ্টা এবং তুলনা। এই সময় পর্যন্ত এভাবই তারা অভ্যস্ত। তারা কখনো ভাবতেই পারেন না, সন্তান তার নিজের মতো চলবে।
সন্তানকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হয়।
ভাবনা পরিবর্তন না করে বরং অভিভাবক গর্ব করে বলেন, আমরাতো বাবা-মা শিক্ষকের হাতে বেদম মার খেয়েছি তারপরে মানুষ হয়েছি। কিন্তু তাদের মনের ভিতরে যে দুঃখ ছিল তারা যা হতে চেয়েছেন তা না হতে পারার কষ্ট এসব বিষয়গুলো তারা কখনো বলেন না। তারা অভিভাবককে শ্রদ্ধা করেন, শিক্ষককেও শ্রদ্ধা করেন খুব ভালো। কিন্তু তার মানে এই নয় পরবর্তি প্রজন্ম নিজের পছন্দে চলতে পারবে না ।বরং আদি অকৃত্তিম তাদেরই ঐতিহ্য বহন করে একই ধারা চালু রেখে নিজেদের প্রতিবিম্ব হলে অভিভাবক দারুণ সন্তুষ্ট হন।
অনেক ছেলে মেয়ে প্রেম করে। তাদের সে প্রেম, অহংকারের কবরের নিচে চাপা পরে। প্রেমের সমাধির কারণ অভিভাবকের পছন্দ হয়নি, নানা বিষয়ে মিলেনা দুই পরিবারে। কিন্তু দুটি মনের যে মিল হল সেটা কেউ চোখে দেখে না, মন বোঝা সে তো অনেক দূরের কথা।
অনেক সন্তান, জন্মগতভাবে দৈহিক ভিন্ন আকৃতি নিয়ে জন্মায়। পুরুষ ও নারীর মধ্যবর্তী অবস্থানের এই সব মানুষকে তৃতীয় লিঙ্গ বলা হয়। মানুষের সন্তান কিন্তু কুসংস্কারে আচ্ছন্ন পরিবার। সমাজের নানা নিয়মে, সন্তানদেরকে পরিবারের পরিচয় দেওয়া হয় না।
সমাজে তৃতীয় লিঙ্গর আলাদা সমাজ গড়ে উঠেছে, ধর্ম এবং সমাজ ব্যবস্থার মাধ্যমে। সুস্থ পরিবারের মানুষরা তাদের সন্তাদের তৃতীয় লিঙ্গর মানুষদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন না তাদের কথা বলেন না। সব কিছু থেকে আলাদা করে রাখতে চান আপাত সুস্থ পরিবার নিজেদের এবং সন্তানদের।
শিক্ষা ব্যবস্থায় তৃতীয় লিঙ্গের কোন জায়গা নেই। তাদের কথা বলতে চাইলে হৈ হৈ করে উঠেন বিশাল জনগোষ্টি।
যারা এই তৃতীয় লিঙ্গ, এদেরকে মানুষ হিসাবে গণ্য করা হয় না, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা হয়।
তারা জোড় করে নানান রকম চেষ্টা করে নিজেদের জীবন যাপন করে ভিক্ষাবৃত্তি করে। এই মানুষগুলো কি ভাবে জীবন চালায় এ বিষয়ে কেউ ভাবে না।
বর্তমান সময়ে তাদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন চলছে এটা খুবই একটা ভালো বিষয়। পঞ্চাশ উর্ধ, বাংলাদেশে হাসিনা সরকার তাদের অধিকারের জন্য কিছু বলছেন, করছেন।
কিন্তু কুসংস্কার মনে রাখা মানুষরা তৃতীয় লিঙ্গের, সামাজিকভাবে চলাফেরা মেনে নিতে পারেন না। এদের সাথে বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাতে এদের সাথে অফিসে কাজ করতে, পরিবারে বসবাস করতে সংকোচ বোধ করেন। অসম মানুষ যেন অস্পৃশ্য।
নানাভাবে কাজ করে মানুষের মনে বিভেদ, ধনী, দরিদ্র, শিক্ষিত, অশিক্ষিত, বংশ, চেহারা, সৌন্দর্য এবং ধর্মের নানা ভেদাভেদ। একজন সুস্থ মানুষ মোটা বা চিকন হলেও বডিশেমিং করা খুব আনন্দের বিষয়। কেউ না করেন না, একজন মানুষকে নিয়ে অপমানজনক এই ব্যবহারে। অনেক শিক্ষকও ছাত্র ছাত্রীদের, দেহ বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নানা নামকরনে তাদের ক্লাসে ডাকেন। কানা, চিকনা, মোটা এবং আরো অনেক এসব প্রচলিত নাম। এসব বিষয় বাংলাদেশে মেনে নেয়া হয়, অনন্দের সাথে ।
সেখানে এখন নতুন করে প্রচলিত হয়েছে, ট্রেন্সজেন্ডার । কিভাবে দেখা হয় এই বিষয়। বোঝার আগেই এরা বিকৃত মনোভাবের মানুষ এই তকমা লাগিয়ে দেয়া হয় তাদের।
বিষয়টিকে আমাদের সমাজের মানুষ মেনে নিতে পারে না আর মানসিকভাবে ভাবনা চিন্তা সেটা তো অনেক দূরের বিষয় । এই সময়ে খুবই প্রচলিত ট্রেন্সজেন্ডার। তাদের কে সমমর্যাদা দেয়া হচ্ছে । বিদেশে তারা অনেকদিন থেকেই প্রতিষ্ঠিত। এই প্রতিষ্ঠাও তারা আদায় করেছে অনেক কষ্ট করে, আগের প্রজন্মের চেষ্টা বর্তমান প্রজন্ম ভোগ করছ। বিদেশে সামাজিকভাবে নানা কিছু করছে ট্রেন্সজেন্ডার মানুষ। স্বাভাবিক আমার আপনার মতনই তাদের অবস্থান। কিন্তু আমাদের দেশে যখন এই বিষয়টিকে নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করা হচ্ছে ,মানুষের ভাবনার মূল্য দেয়া হচ্ছে তখন কিছু মানুষের মাথায় বাজ পড়েছে যেন । তেমনি সেই শিক্ষক যিনি নিজেই অনেক বিষয়ে কুসংস্কারে আবদ্ধ তিনি ছিড়ে ফেলেছেন সপ্তম শ্রেণীর একটি গল্প বই থেকে।
যেখানে একটি ছেলে মেয়ে হয়েছিল ।
মেয়ে কিন্তু ভাবনা ছেলের মত। তেমনি আবার অনেক ছেলে আছে, যাদের শরীরটা ছেলের কিন্তু ভাবনা মেয়েদের মত। শারীরিক ভাবে ভিন্ন অবস্থানের স্বীকৃতি যেখানে পাওয়া যায় না, মানসিক ভাবনায় নিজের শরীরটা বদলে ফেলবে এটা মানার জন্য তাদের বহু দূর হাঁটতে হবে।
প্রতিবাদ করে কিছু হবে না। এখন সময়, মানুষ তার নিজের মতন বাঁচতে চায় সেটা মেনে নিতে হবে।
আমি এই বিষয়ে আগে অনেক লিখেছি । বিদেশে অনেক আগে থেকেই মানুষ তাদের লিঙ্গ পরিবর্তন করছে ভাবনা অনুযায়ী ছেলে থেকে মেয়ে, মেয়ে থেকে ছেলে হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ আছে এই বিষয়টাকে শিক্ষার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করার একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, মানুষ নিজে কি। সে কি ভাবে তার ভাবনাকে মূল্যায়ন করার একটা চিন্তা-ভাবনা শিক্ষায়, দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। বোঝার আগেই সেখানে না না বলার প্রবণতা তৈরি হয়েছে বেশি। কারণ এরা নিজেরাই জানে না অধিকার কি। তারা শুধু অভ্যস্থ প্রচলিত অভ্যস্থতায়, মেনে নেয়ায় আর বিজ্ঞান না বুঝে ধর্ম, কুসংস্কারের পিঠে সওয়ার হওয়ার।
এরা মনে করে, আমরা তো মানুষ হয়েছি পিটুনি খেয়ে, সেভাবেই আমাদের সন্তানরা মানুষ হবে। অভিভাবক যে ভাবে আমাদের মানুষ করেছেন নিজের ইচ্ছা চাপিয়ে দিয়ে। আমরাও তাই করব আমাদের সন্তানের সাথে। বানাব নিজের ইচ্ছার রোবট।
এটা কি এক ধরনের মানসিক বৈকল্য হতে পারে যেমন অত্যাচারিত শাশুড়ি, বউকে অত্যাচার করেন, অধিকার দেন না সংসারে। আসলে কাউকে নিজের মতন মানুষ করা যায় না সন্তান বলেই। প্রত্যেকটা মানুষ নিজস্ব চিন্তাধারায় আলাদা ব্যাতিক্রম। অনেক সন্তানকে দেখেছি, বাবা মায়ের ইচ্ছায় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়ে; পরে গান, নাটক, চিত্রশিল্পী হয়ে জীবন কাটাতে।
সুস্থ স্বাভাভিক সন্তানরাই যখন নানা বিষয়ে নির্যাতিত হয় পরিবারে, সমাজে। সেখানে তৃতীয় লিঙ্গ যারা অবহেলিত ছিল এত জীবন তাদের অধিকার দিতে অবশ্যই অনেক বাঁধা আসবে।
আর তৃতীয় লিঙ্গর সাথে জড়িয়ে যায় ট্রান্সজেন্ডার। যারা নিজেদের চিকিৎসার মাধ্যমে বদলে ফেলে একটা অন্য রূপ দেন। সেটা শারীরিক বা মানুষিক অবস্থা থেকে হতে পারে।
সন্তানকে নিজের মতন চালানো নয় তার উপরে নিজের অধিকার স্থাপন করা নয়। সন্তানকে লালন পালন করতে হবে তার নিজের জায়গায় স্থাপন করে দেওয়ার জন্য। তার নিজের মতন করে চলতে দেওয়ার অধিকার দিতে হবে। সব সময় যে সাফল হবে তার কোন যুক্তি নেই। একটা মানুষ তার নিজের ইচ্ছায় নিজের জীবন চালাচ্ছে,এই ভাবনায় নিজেকে উন্নত করতে হবে।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জানুয়ারি, ২০২৪ রাত ২:১৭