somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সহাবস্থান বা প্রস্থানের গল্প!

২৭ শে মে, ২০১১ বিকাল ৩:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

.
.
.
((১))

জায়গাটার ভালো নাম সে জানেনা, এটা তার তিন নম্বর আবাস্থল। এটার পুরনো একটা নাম আছে যেটা এখানে ভবিষ্যতে আবাস গড়ে তোলা ভদ্রলোকেরা হয়তো জানতেই পারবেনা। তারা একটা নতুন নামে এই আবর্জনার স্তুপ কিনে নিবে কাঠা-শতক-কোটির হিসাবে। এখানে কি এখন তারা আসে? ভুলেও না। যারা আসে তাদের সাথে রেভেন এর সখ্যতা না থাকলেও খুব বেশি বৈরিতা নেই। কারাই বা আসে এখানে। আবর্জনার ট্রাক শ্রমিকরা, ক্যাটারপিলার চালকেরা, আর কিছু অভাগা টোকাই। অবশ্য টোকাই আর তার মাঝে খুব বেশি পার্থক্য নাই। দু’জনের গায়ের রং প্রায় একই, মাঝে মাঝে তারা এক সাথেই ভাগাভাগি করে খায়।

রাত ভোর হতেই সারি সারি ট্রাকগুলো এখানে আসে, শহরের যত আবর্জনা তারা এখানে রেখে যেতে চায়। জানিনা আদৌ তারা সেটা করতে সফল হয় কিনা। শহরে যখন গাড়িগুলো অতিক্রম করে পেছনে চলা রিক্সার আরোহীদের বিকট দুর্গন্ধে নিজেদের নাক চেপে ধরতে দেখা যায়, কই এই শ্রমিকগুলো কখনো তাদের নাক রুমালে বাঁধল না। টোকাইদেরও এখান কুড়িয়ে পাওয়া খাবার খেতে কখনো গন্ধ শুঁকতে দেখা জয়ায় না। তবে কি এই আবর্জনার সাথে যাদের সম্পর্ক হয় তাদের কাছে এটা ভালো লাগতে শুরু করে? প্রকৃতি মনে হয় এমনি, সবকিছুর জন্যই কিছু কিছু সহনশীল করে তৈরি করে রাখে।



((২))

“মা! মা! দেখ একটা পাখি।“
সদ্য শেষ হওয়া একতলার ছাদে কাপড় ছড়িয়ে দিতে দিতে এমন চিৎকার শুনে দৌড়ে ছেলের কাছে এসে মা দেখতে পান একটা কালো কুচকুচে পাখির ছানা ছাদে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটছে।
“মা, দেখ, এটা আমার পাখি। আচ্ছা এটা কি পাখি?”
“জানি না, খোকা। খুব রোদ, চল নিচে যাই।“
“না, আমি আমার পাখিকে রেখে যাবনা। ওটা আমি পুষব। আচ্ছা বলনা মা, এই পাখির নাম কি?”

বাচ্চারা প্রশ্ন মনে হয় একটু বেশিই করে, ছাদে খুঁড়িয়ে চলা পাখিটার মতই। পাখি ছানার বিরক্তিকর কিচ্ কিচ্ কিচ্ শব্দ ছেলেটার মায়ের কানে ছেলের পাখি পোষার আকুতি না পৌছুলেও শিঁড়ির দু’ধাপ নেমে আবার পেছন ফিরে তাকায়, দেখে অসহায় পাখির ছানাটি যেন মিনতি করে কিছু বলতে চাইছে।

শহরের এ প্রান্তে বাড়িগুলো নতুন হচ্ছে, দেখেই বোঝা যায় এগুলো ভদ্রলোকেরই আস্তানা হবে একদিন। আচ্ছা তারা কি জানে একসময় এখানে সকাল সন্ধ্যা বিচরণ করত আবর্জনার ট্রাক, ক্যাটারপিলার, কাক, শকুন, কাদাখোঁচা, গোয়ালপাড়ার গাভী অথবা শুকরগুলো আর টোকাইরা। তাদের সুরম্য অট্টালিকাগুলো পাইলিং করা হচ্ছে শহরের বাসাবাড়ির আবর্জনা, শাক কুটা, ডিমের খোসা, ওষুধের প্যাকেট, ভাঙ্গা কাঁচ, কোকের বোতল, পলিথিন, ব্যবহৃত রেজর, কনডম, চিড়ে যাওয়া অন্তর্বাস এর উপরে।

এমনও হতে পারে কুমারি মেয়ের গর্ভপাত শহরের ডাস্টবিন, গারবেজ ট্রাক হয়ে এখানে এসে জমেছিল। শকুন, কাক বা শুয়োরগুলোর পেটে যাওয়ার আগেই ক্যাটারপিলারের ধাক্কায় তলিয়ে গেছে দশ বা তারো বেশি হাত আবর্জনার নিচে।

“বাবা, দেখ এটা আমার পাখি।“ বাবার আঙ্গুল ধরে টানতে টানতে ছেলেটি বারান্দায় রাখা পাখির দিকে এগিয়ে যায়।
“এটা কি পাখি বাবা? মাকে জিজ্ঞেস করেছি, বলতে পারেনি।”
“মনে হয় কাকের বাচ্চা।“ যতটুকু সম্ভব বিরক্তি লুকিয়ে ছেলেকে হাসিমুখে উত্তর দেয় বাবা।
“বাহ! বাবা তুমি এর একটা নাম ঠিক করে দাও, আমি ওর নাম রাখব।“
“রেভেন, এর নাম হবে রেভেন।“ এত শত ব্যস্ততার মাঝে যখন ছেলের সাথে থাকা হয় তখন নিজের ভালোমানুষি গুলোর কথা ভেবে নিজেই অবাক হয়ে যান ছেলেটির বাবা। এই যেমন একটু আগে- ডানা ভাঙ্গা, কুচকুচে কালো বিরক্তিকর পাখিটার জন্য একটা কি সুন্দর যথার্থ নাম এক মুহুর্তে মাথা থেকে বেরিয়ে এল। ছেলের প্রতি ভালোবাসাই হয়তোবা কাকের ছানার প্রতি তার এই মমতার জন্ম দিয়েছে।

এরপর খোকার সবসময়ের খেলার সাথী রেভেন বড় হয়। ভাঙা ডানা আস্তে আস্তে উড়ার উপযোগী হয়ে উঠে। কিচ্ কিচ্ শব্দের বদলে গলার স্বর কা কা তে পরিণত হয়। একদিন খেলার ছলে ডানা ঝাপটিয়ে দূরে কোথাও উড়ে যায়। শহর ছাড়িয়ে আরও কিছু দূরে, উড়তে উড়তে নিচে তার চোখ যায় কিছু আবর্জনার ট্রাক, ক্যাটারপিলার, কাক, শকুনের দিকে। এক মুহুর্তে খোকার ভালোবাসা সে ভুলে যায় এই বিস্তৃত আকাশ, শহর অথবা গারবেজ ডাম্প দেখে।



((৩))

সকাল হওয়ার আগেই জেগে উঠে গলা ফাটিয়ে কা কা আওয়াজ তুলে চারপাশে চক্কর মারাটাই রেভেন এর প্রতিদিনের নিয়ম হয়ে গেছে। এখন পৃথিবীর এই প্রান্ত থেকে শকুন মনে হয় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। আজ থেকে ক’বছর আগেও তার সাথে খাবার বা অবস্থান নিয়ে দ্বন্দ চলত শকুনদের। বেশিদিন বেঁচে থাকার মনে হয় এই একটাই সুবিধে। পৃথিবীর রং বদলে যাওয়াটা উপভোগ করা যায়। আবার ক্ষেত্রবিশেষে রংচটা পৃথিবীটা দেখতে দেখতে নিজের পৃথিবীটাও বর্ণহীন হয়ে পড়ে।

একসময় তার মনে হত খোকার(মানুষ) ভালোবাসা ছিন্ন করে সে খুব ভুল করেছে। মাঝে মাঝে আনমনে উড়ে যেত বাড়িটার পাশ দিয়ে, খোকাকে এক পলক দেখতে চাইত।

কিন্তু তার যুবক বয়সের সেই সময়গুলো মানুষের প্রতি তার একটা মিশ্র অনুভূতির জন্ম দিয়েছে। সেটা ঘৃণার, পক্ষান্তরে শ্রদ্ধার।

“তুই মুক্তি হইছোস, দেখ তোগো মুক্তি হওন ক্যামনে ছাড়াই।
সাব, ঈয়ে সাব মুক্তি হ্যায়। ঈয়েলোগ এয়সে কুচ নেহি বাতায়েগা।“

এরপর গায়ের কাপড় দিয়ে চোখ বাঁধা কিছু লোকের হৃদপিন্ডের খুব স্বাভাবিক শব্দ শোনা যায়। আর শোনা যায় কিছু মানুষরূপী জন্তুর গোঁৎ গোঁৎ স্বর-
“সাব, গুলি মাত খ্রচ কি জিয়ে, হামলোগ ঈয়ে মুক্তিকা বন্দোবস্ত করেগা।“
এরপর একে একে হাত, পা, চোখ বাঁধা মানুষ গুলোকে ঐ জল্লাদ গুলো গলা কেটে মারল, মেরে আবর্জনার স্তুপে ফেলে চলে গেল। এভাবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। তবে আশ্চর্যের বিষয় ছিল যাদের মারা হয়েছে তারা কেউই বেঁচে থাকার জন্য কোনদিন জল্লাদদের কাছে আকুতি করেনি, অনেকের ঠোঁটে থাকত ঊপহাসের হাসি। চোখগুলো বাঁধা না থাকলে হয়তো সে চোখে কিছু বিষও উগলে দিত জল্লাদ দের প্রতি।

এভাবে দিনের পর দিন তারা পড়ে থাকত আবর্জনার স্তুপে, যেন আবর্জনার স্তুপকেই তারা পরিশুদ্ধ করছে। এদের গলে যাওয়া শরীর, জমে যাওয়া রক্ত দেখে আবারো মানুষের প্রতি তার শ্রদ্ধা বেড়ে যায়।



((৪))

কত বয়স এখন তার, পঁচিশ বা আঠাশ। তার জাতের কাকদের গড় বয়স সে অতিক্রম করে এসেছে। তার জন্ম হয়েছিল সদ্য সংস্কার হয়ে অভিজাত এলাকা হয়ে ওঠা একটা আবর্জনার ডাম্পে। তার বাবা-মা হয়তো পুরনো দিনের আবাস ছেড়ে যেতে চায়নি তাই তারা মানুষের হাতে মারা পড়েছে নয়তো মানুষের তাড়া খেয়ে ঐ বাড়িটার ছাদেই তাকে ফেলে চলে গেছে অন্য কোথাও।
এই পর্যন্ত তাকে দুইটা ডাম্প ছাড়তে হয়েছে যেখানে এখন মানুষ বাস করে, তার স্বজাতিদেরও মানুষের সাথে সহাবস্থানে দেখা যায় মাঝে মাঝে।

অনেকদিন রেভেন নাম ধরে তার স্বজাতিদের কেউ তাকে আর ডাকেনা, সে এখন প্রৌড়। তাইতো, প্রৌড়দের কেউ কি কোনদিন সুন্দর নাম ধরে ডাকে?

আজ খুব খোকা কে দেখতে ইচ্ছে করছে তার, খোকা হয়তো তাকে আর চিনতেই পারবে না। এসব ভাবতে ভাবতে তার মনে হয় ডাম্প এখন ছেড়ে যাওয়া দরকার। কত কাকই তো এখন মানুষের বাসা বাড়ির খোপে, গাছের আড়ালে বাসা বানিয়ে থাকে। সেও নিশ্চয় খোকাদের বাড়ির কোন এক কোণে নিজের বাসা ঠিক করে নিতে পারবে।

“এই দারোয়ান, দেখতে পান না গ্যারেজের সামনে এত পেরেক, তার পড়ে থাকে? এগুলো না কুড়িয়ে আপনি কি করেন সারাদিন?” রাগের সাথে কথাগুলো বলে যায় এক যুবক।
“স্যার, প্রতিদিনই আমি এসব পরিষ্কার করি। তবুও কোত্থেকে যেন আসে। মনে হয় বাড়ির জানালার কোন ছাউনিতে কাক বাসা বাঁধছে। এসব পেরেক-তার দিয়ে কাকরাই বাসা বাঁধে।“
“আমি এসব বুঝি না, পেরেক এসে আমার গাড়ির চাকা পাংচার হবে, আমার উঠান কাকের গু’য়ে ভরে যাবে সেটা আমি কখনো হতে দিবনা।“

এরপর বাসায় ঢুকে হাতে একটা এয়ার রাইফেল নিয়ে ফিরে আসে যুবক। শ্যুটিং ক্লাবের সদস্য যুবক কোনমতেই তার টার্গেট মিস করেনা। ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে সামনে এসে পড়ে এক মুমূর্ষ কাক।

কাক শুণ্যদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে যুবকের চোখে। অদ্ভুত আনন্দ খেলে যায় যুবকের চোখে-মুখে, ঠিক যেমনটি রেভেন দেখেছিল প্রথম তাকে ছাদে কুড়িয়ে পাওয়া খোকার চোখে।

সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মে, ২০১১ ভোর ৬:৫৪
১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৮




আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না। আমাদের দেশে মানুষ জন্ম নেয়ার সাথেই একটি গাছ লাগানো উচিৎ । আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানবতার কাজে বিশ্বাসে বড় ধাক্কা মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৭


মানুষ মানুষের জন্যে, যুগে যুগে মানুষ মাজুর হয়েছে, মানুষই পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে কাজের ব্যস্ততায় এবং নিজের সময়ের সীমাবদ্ধতায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। তখন তারা সাহায্যের হাত বাড়ান আর্থিক ভাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×