লেবাননের বিখ্যাত কবি কাহলিল জিবরান তা্ঁর ‘On Children’ কবিতায় সন্তানের বাবা-মা কে উদ্দেশ্য করে বলছেন,
তোমার সন্তানেরা তোমার সন্তান নয়।
তারা তোমাদের মধ্যে আসে, তোমাদের থেকে নয়।
তুমি তাদের দিতে পার তোমার ভালোবাসা,
কিন্তু দিতে পার না তোমার চিন্তা, কারণ তাদের নিজেদের চিন্তা আছে।
তুমি তাদের মতো হওয়ার সাধনা করতে পারো, কিন্তু
তাদের মতো বানাবার চেষ্টা কোরো না।
কারণ জীবন পেছনের দিকে যায় না, গতকালের জন্যে বসেও থাকে না।
(সংক্ষেপিত)
কাহলিল জিবরান অসাধারণ ভাবে ছেলে-মেয়ের জীবন গড়ার ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের ভূমিকাকে তুলে ধরেছেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো আমাদের বাবা-মায়েরা ঠিক উল্টোটায় করেন। তারা তাদের গৎবাঁধা ছকের মধ্য দিয়ে ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যৎ গড়ে দিতে খড়গহস্ত হন। আর সেই ভবিষ্যত গুটি কয়েক পেশাকে ঘিরে আবর্তিত হয়। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী কিংবা যেখানে ভালো অর্থ আছে সে রকম কোনো পেশা। ছেলে-মেয়ের ভালো-মন্দ, পছন্দ-অপছন্দের জায়গাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে, তাদের সৃজনশীলতাকে অবদমিত করে উনারা লেগে থাকেন বৃত্তিজীবী তৈরির নেশায়। দিন-রাত ধরে চলতে থাকে মহড়া। জোর করে কেড়ে নেয়া হয় শৈশবের আনন্দময় দিকগুলি। অথচ বাবা-মা যদি ছেলে-মেয়েকে এই পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ উপভোগ করার সুযোগ করে দিতেন, বড় মানুষ হওয়ার ক্ষেত্রটি তৈরি করে দিতেন তাহলে গল্পটি হয়তো অন্যরকম হতে পারত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সৌভাগ্যবান ছিলেন যে, এখনকার মতো বাবা-মা পান নি, তাহলে তাকে আর বিশ্বকবি হওয়া জুটতো না। একজন সাধারণ বৃত্তিজীবী হয়েই ভবলীলা সাঙ্গ করতে হতো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর মাত্র ১১ বছর বয়সে কবিকে প্রথম মুক্তির স্বাদ দেন। বোলপুর থেকে হিমালয় পর্যন্ত কবিকে সাথে করে নিয়ে ঘোরেন আর রবীন্দ্রনাথের শিশু মনে প্রকৃতির অপার রহস্যের দ্বার উন্মোচন করে দেন। যার ফলে কবি এই প্রকৃতিকে, এই নিখিল বিশ্বকে তাঁর হৃদয়ে ধারণ করতে পরেছিলেন আর তার প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন কালি-কলম আর মননের মেল বন্ধনে। বিশ্ববিখ্যাত পদার্থবিদ আইনস্টাইনের মা ছোটবেলা থেকে তার ছেলেকে সঙ্গ দিতেন। ছেলের চাওয়া-পাওয়া কে গুরুত্ব দিতেন। ছেলের মন ভালো করার জন্য তাকে কোলে নিয়ে গা্ন গাইতেন, গান শোনাতেন। আইনস্টাইনের নিস্তরঙ্গ মনে সঙ্গীতের লহরীর ঢেউ তুলে দিতেন। আর তাই আইনস্টাইন পদার্থ বিজ্ঞানের জগতে তার তত্ত্ব দ্বারা নতুন সুর সৃষ্টি করেছিলেন। আলেকজান্ডার ছিলেন বিশ্ববিজয়ী বীর কিন্তু এই বিশ্ব জয়ের ভিতটা গড়ে দিয়েছিলেন তার বাবা ফিলিপ। একদিন মেসিডোনিয়াতে নতুন ঘোড়া আনা হয়েছে কিন্তু কেউ ঘোড়াটাকে বশে আনতে পারছে না। পাশে দাঁড়িয়ে আছেন রাজা ফিলিপ আর আলেকজান্ডার। আলেকজান্ডার লক্ষ্য করেছিলেন নিজের ছায়া দেখে ভয় পাচ্ছে ঘোড়াটি। তাই ঘোড়ার পামে গিয়ে আস্তে আস্তে তার মুখটা সূর্যের দিকে ঘুরিয়ৈ দিলেন। তারপর ঘোড়াটিকে আদর করতে করতে এক লাফে পিঠের উপর উঠে পড়লেন। উপস্থিত সবাই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যেই ঘোড়া ছুটিয়ে ফিরে এলেন আলেকজান্ডার। ঘোড়া থেকে নামতেই পুত্রকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন ফিলিপ। বললেন, ‘তোমাকে এইভাবে নতুন রাজ্য জয় করতে হবে। তোমার তুলনায় ম্যাসিডন খুবই ছোট।’ আলেকজান্ডারের মস্তিষ্কে ঢুকে গেল বিশ্বজয়ের নেশা। ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল ধনাড্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু তাঁর বাবা ছিলেন উদার প্রকৃতির মানুষ। তিনি মেয়েকে সঙ্গীত, ছবি আঁকা শেখানোর সাথে সাথে দেশ বিদেশের নানা ভাষার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে থাকলেন। অভিজাত এলাকা ছেড়ে ফ্লোরেন্সের ছোটবেলা কাটল গ্রামের বাড়িতে। ফ্লোরেন্স গ্রামের বাড়িতে কেউ অসুস্থ হলে সেবা করা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। এমনকি গ্রামের কোন মানুষ, হাঁস, মুরগি, গরু, ঘোড়াও অসুস্থ হলে ফ্লোরেন্স সেবা করতে দ্বিধা করেন না। ১৭ বছর বয়সে ফ্লোরেন্সের বাবা লন্ডনে নিয়ে এলেন উচ্চ শিক্ষার জন্য কিন্তু ফ্লোরেন্সের এসবে মন টানে না। সে নার্সিং পড়তে চায়। অভিজাত পরিবারের মেয়ে হয়ে নাসিং পড়বে! এটা প্রথমে মানতে কষ্ট হলেও শেষমেষ তাঁর বাবা-মা মেনে নিলেন এবং ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল পরিণত হলেন মানব সেবার এক অনন্য উদাহরণে। এই মানুষগুলো কেউই এতবড় মানুষে রুপান্তরিত হতে পারতেন না, যদি তাদের বাবা-মা এভাবে চিন্তার স্বাধীনতাকে, সৃজনশীলতাকে পরিশীলিত করার সুযোগ না করে দিতেন। প্রত্যেক বাবা-মা যদি ছেলে-মেয়েকে গৎ বাঁধা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন না দেখিয়ে মাদার তেরেসার মতো হতে বলতেন, কিংবা, মহাত্মা গান্ধীর মতো অহিংস একজন মানুষ হতে বলতেন, বঙ্গবন্ধুর মতো একজন মানব দরদী নেতা হতে বলতেন, নজরুল ইসলামের মতো একজন অসাম্প্রদায়িক মানুষ হতে বলতেন তাহলে এই দেশ এত এত আত্মকেন্দ্রিক, কুটিল স্বার্থপর মানুষে ভরে উঠত না এটা হলফ করে বলা যায়।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১:০২