somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শর্মিষ্ঠারা চলে যায়

০২ রা এপ্রিল, ২০১৯ সকাল ১০:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


খবরটা যখন প্রথম কানে আসে মাথা ঘুরে পড়ে যাবার অবস্থা হয়েছিল দেবব্রতর।বিশ্বাসই হচ্ছিলনা তার।ভবতোষ কর্মকার সপরিবারে ইণ্ডিয়া চলে গিয়েছে।সে খেলা বাদ দিয়ে পুকুর পারে চলে আসে।ছোট পুকুর পারে তখন কেউ ছিলনা।পুকুরের সিঁড়ি ঘাটে চুপ করে বসে থাকে।বুকে একটা চাপা কষ্ট দলা পাকাতে থাকে।কিছুক্ষণ পর খেলার মাঠের অন্যেরাও চলে আসে।পুকুর ঘাটে হাত মুখ ধুয়ে যে যার মত চলে যায়।শুধু চন্দন চুপচাপ ওর পাশে বসে থাকে।
-খুব খারাপ লাগছে নারে?
চন্দন প্রশ্ন করে।
-খুব।
কান্না ভেজা কন্ঠে দেবব্রত বলে।
-কি আর করবি?চল বাড়ি যাই।
-না এখন বাড়ি যাবোনা।মুখ দেখে মা বিভিন্ন প্রশ্ন করবে।
-তবে চল ভিক্টোরিয়া পাবলিক লাইব্রেরীতে যাই।
দুই বন্ধু উঠে লাইব্রেরীর দিকে যায়।

ব্যান্ডের শব্দ আর পোলাপানের চিৎকার কানে আসতেই শর্মিষ্ঠার মন চঞ্চল হয়ে উঠে।কিন্তু একা ছাদে যেতেও সাহসে কুলাচ্ছিল না।আচমকা ছোট ভাই শৈবাল দৌড়ে আসে।
-দিদি দিদি ছাদে চল।মিছিল আসতেছে।
হাঁপাতে হাঁপাতে শৈবাল বলে।
-মা মিছিল দেখতে ছাদে গেলাম।
চেঁচিয়ে মাকে বলেই দৌড় দেয় শর্মিষ্ঠা।যেতে যেতে মায়ের কথা কানে আসে-এত বড় মেয়ে হয়েছে তাও ধিঙ্গিপনা গেলোনা।
শর্মিষ্ঠাদের বাড়ির কাছাকাছি আসতেই দেবব্রত বারবার শর্মিষ্ঠাদের বাড়ির ছাদের দিকে লক্ষ্য করতে থাকে।আজ ওদের দল বঙ্গোজ্জল টিমের সাথে ফাইনাল ম্যাচে ফুটবল খেলায় জিতেছে।তাই ব্যান্ডপার্টিসহ মিছিল করে ওরা শহর প্রদিক্ষণ করছে।

শর্মিষ্ঠা নীচের দিকে তাকায়।দেবব্রতকে তুমুল নাচতে দেখে হাসি পায় ওর।আশপাশের ছাদেও অনেক ছেলেমেয়ে উঠেছে মিছিল দেখতে।দেবব্রত একবারও তাকাচ্ছেনা ওর দিকে।ভারী বদ ছেলেতো শর্মিষ্ঠাভাবে।স্কুলের সামনে হ্যাংলার মত দাঁড়িয়ে থাকে তখন শর্মিষ্ঠা কি বোঝেনা কেন দেবব্রত এখানে।বয়েই গেছে ওর।দেবব্রতকে না দেখলে কি হবে?

-এই দেবব্রত,ছাদের দিক তাকা।
চন্দন নাচতে নাচতে বলে।
-আমি আগেই দেখেছি।
দেবব্রত উত্তর দেয়।
মিছিল চলে যায়।শর্মিষ্ঠা কিছুক্ষণ ছাদে বসে থাকে।
-দিদি যাবিনা?
শৈবাল প্রশ্ন করে।
-তুই যা।আমি একটু পড়ে আসছি।
শৈবাল চলে যায়।শর্মিষ্ঠার মন খারাপ হয়ে যায়।কেন যে সে নিজেই তা জানেনা।ধীরে ধীরে সে আবার ছাদের রেলিং এর কাছে আসে।রাস্তায় মানুষ চলাচল দেখে।আচমকা খেয়াল করে দেবব্রত একা একা রাস্তায় হাঁটছে।চোখে চোখ পড়ে।দেবব্রতই চোখ নামিয়ে নেয়।হনহন করে হেঁটি ওদের বাড়ি পার হয়ে চলে যায়।শর্মিষ্ঠার যেমন হঠাৎ মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল,তেমনি হঠাৎ মন ভালো হয়ে যায়।


ভবতোষ ওর মেয়েকে নিয়ে বিশ্বনাথ মাষ্টারের বাড়িতে আসে।দরজা ঝাঁকালে বিশ্বনাথের ছেলে দরজা খুলে দেয়।
-কাকে চান?
দেবব্রত প্রশ্ন করে।
-বিশ্বনাথ বাসায় আছে?
ভবতোষ জানতে চায়।
-আছেন।আপনি ভেতরে আসুন।
শর্মিষ্ঠা যখন ওর পাশ দিয়ে যাচ্ছিল তখন খুব সুন্দর একটা গন্ধ পায় দেবব্রত।উনাদেরকে বাহিরের ঘরে বসতে দিয়ে দেবব্রত ভেতরে চলে যায়।বাবাকে গেষ্টের কথা বলে।

পড়ার ঘর হতে বাবা আর ওই মানুষটির উচ্চস্বরের হাসির আওয়াজ ভেসে আসে।কিছুক্ষণ পর চিৎকার করে বিশ্বনাথ বলে-দেবু পুরানো এ্যালবামটা নিয়ে আয়তো। দেবব্রত এ্যালবাম নিয়ে বসার ঘরে আসে।বিশ্বনাথ হাতে নিয়ে পুরানো সাদাকাল একটি ছবি বের করে।তিনজন যুবকের পিছনে তিনজন বউ দাঁড়িয়ে।
-এই দেখ আমাদের তিন বন্ধুর বিয়ের পর তোলা ছবি।
বিশ্বনাথ ভবতোষকে বলে।
-কই দেখি?
ভবতোষ ছবিটি হাতে নেয়।দেবব্রত আড়চোখে মেয়েটিকে দেখে।মেয়েটি ওর বাবার সাথে ছবি দেখছে।দেবব্রতর মা জল খাবার নিয়ে ভেতরে আসে।

শর্মিষ্ঠা যখন ওর বাবার কাছে পড়তে আসে ঠিক তখনই দেবব্রত প্রাইভেট পড়ার জন্য বাহিরে যায়।ফলে কোনদিন বাড়ির গেটে,কোনদিন পথে শর্মিষ্ঠার সাথে দেবব্রতর দেখা হয়।চোখাচোখি হয়।কিছুদিন যেতেই শর্মিষ্ঠা খেয়াল করে স্কুল ছুটির সময় দেবব্রত ওদের স্কুলের বিপরীতে বন্ধুসহ দাঁড়িয়ে থাকে।দু’জন দু’জন দেখে।তারপর শর্মিষ্ঠা রিক্সায় চেপে বাড়ি চলে যায়।

একদিন সন্ধ্যায় বিশ্বনাথ দেবব্রতকে ভবতোষের দোকানে যেতে বলে।আর বলে দেয়-তুই তোর কাকার কাছে বলবি আংটিটা দিতে।ওর ওখানে আংটি বানাতে দেওয়া হয়েছে।দেবব্রত বাড়ি থেকে বেরিয়ে লালবাজারের দিকে হাঁটা ধরে।ভবতোষের বাড়ি রাস্তার সাথে।পুরানো আমলের বাড়ি।বাড়ির সামনের অংশে সোনার দোকান।দোকানের ভেতর দিয়েই বাড়িতে যেতে হয়।দোকানের সামনে এসে দেবব্রত চরম হতাশ হয়।দোকান বন্ধ।কিছুক্ষণ দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে।ওর বুকের ভেতর ধুকপুক শব্দ হতে থাকে জোরে জোরে।সে গিয়ে দরজার কড়া নাড়ে।কড়া নাড়ার শব্দ যত জোড়ে হয় ওর বুকের শব্দও তত জোড়ে হয়।দরজা খুলে দেয় শর্মিষ্ঠা।দেবব্রত ভীষণ নার্ভাস হয়ে যায়।শর্মিষ্ঠা ওকে দেখে মিষ্টি করে হাসে।
-কাকু বাসায় নেই?
ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় দেবব্রত প্রশ্ন করে।
-ভেতরে আসুন।
দেবব্রত হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে শর্মিষ্ঠার পিছনে পিছনে যায়।
-আপনি বসুন।বাড়িতে কেউ নেই।বাবা-মা ছোট ভাইকে নিয়ে জয়কালি বাড়ি গিয়েছে এখনই আসবে।
শর্মিষ্ঠার কথা শুনে দেবব্রত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে শর্মিষ্ঠার দিকে।
-আপনি না খুব ভিতু।
ফিক করে হেসে দিয়ে শর্মিষ্ঠা বলে।
দেবব্রত আরও নার্ভাস হয়ে পড়ে।আচমকা শর্মিষ্ঠা ওর দিকে সরে এসে গালে একটা চুমু দিয়েই দৌড়ে ভেতরে চলে যায়।দেবব্রত ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে যায়।

পরদিন সকালে পথে শর্মিষ্ঠার সাথে দেবব্রতর দেখা হয়।পাশ দিয়ে যাবার সময় ফিসফিসিয়ে দেবব্রত বলে-আমার পড়ার টেবিলে গল্পের বইয়ের ত্রিশতম পৃষ্ঠা।

শর্মিষ্ঠা পড়ার ফাঁকে দেবব্রতর ঘরে যায়।পড়ার টেবিলে গল্পের বই-দি টল হান্টার।ত্রিশতম পাতা বের করে।সেখানে পেন্সিল দিয়ে লেখা-এটা কি হলো?শর্মিষ্ঠা পাশে লিখে দেয়-যা ভেবেছো তাই হয়েছে।

সময়টা ১৯৯২ কি ১৯৯৩ সাল। বাংলাদেশে কিছুটা সাম্প্রদায়িক অস্থিতিশীলতা চলছে।ভারতে বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে।আর নাটোরের লালবাজার-কাপুড়িয়াপট্টি ছিল হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা।এসব এলাকার বেশীরভাগ হিন্দুদেরই ভারতেও বাড়ি রয়েছে।১৯৭১ এর পর হতেই ধীরে ধীরে এই অঞ্চলের বাসিন্দারা ভারতে চলে যাওয়া শুরু করে।কখনও কম কখনওবা বেশী ছিল এই গমনের হার।বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার পর প্রায়ই শোনা যেতো আজ এ বাড়ির বাসিন্দারা ভারতে গিয়েছে,তো কাল ও বাড়ির বাসিন্দা নেই।আর এমনভাবে চলে যেতো যে প্রতিবেশীরাও কিছু টের পেতোনা।

যেদিন প্রথম শুনলো শর্মিষ্ঠারা ভারতে চলে গিয়েছে সেদিন রাতে দেবব্রত ঘুমাতে পারেনা।পরদিন রাতে দেবব্রত শুনতে পায়, বাবা মাকে বলছে-ভবতোষের মেয়েটা খুব ভালো ছিল।দেবব্রতর সাথে মানাতো বেশ।বাবা উত্তর করে-ভবতোষকে সুখে থাকতে ভুতে কিলিয়েছে।দেবব্রতর বইয়ের উপর টপটপ করে জল পড়ে।দেবব্রত তাড়াতাড়ি হাত দিয়ে চোখ মুছে ফেলে।

বহুবছর পর দেবব্রত নাটোরে আসে।এলোমেলো রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভবতোষের দোকানের সামনে চলে আসে।কয়েকটি মহিলা আর একটি তরুণী দোকানের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে।আচমকা এক মহিলা এগিয়ে আসে দেবব্রতর কাছে।
-কেমন আছো দাদা?চিনতে পারছো?
দেবব্রতর সময় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে যায়।সে শুনতে পায় তরুণীটি বলছে-মা চল যাই।

০১/০৪/২০১৯
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মার্চ, ২০২১ রাত ৯:৫২
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×