ভার্সিটি থেকে ফিরছিলাম। অল্পবয়সী(বয়স ১২/১৩ হবে) গাড়ির কন্ডাক্টর সবার কাছ থেকে ভাড়া নিচ্ছিল।নতুন নিয়মে সব পরিবহণের ভাড়া বেড়েছে,গাড়ির এক বয়স্ক ভদ্রলোক এই ব্যাপারটা বিশ্বাসই করছিলেন না। কারণ তিনি শেষবার এই পথের ভাড়া দিয়েছিলেন আগের নিয়মে। এই নিয়ে অল্পবয়সী ছেলেটা বেশ বাঁকা বাঁকা স্বরে চামড়ায় লাগার মতো করে লোকটাকে কিছু কথা শুনালো। আমি বড়দের সামনে বা সাথে অভদ্রতা জিনিস্টা একদমই নিতে পারি না। কঠিন একটা ধমক লাগাতে যাবো ছেলেটাকে, তখন আমি আটকে গেলাম!। কি বলবো ওকে? যে- বড়দের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় শিখো নাই?'
আমি বলতে পারিনি। কিছু না বলে ছেলেটার দিকে ভালো করে তাকালাম। ১২/১৩ বছর বয়স মাত্র। এই অল্পবয়সে কতো কিছু দেখে ফেলেছে এই ছেলে। বুঝে গেছে পেট চালাতে হলে কাজ করতে হবে।বুঝে গেছে ভদ্রতা নয়,'যেভাবেই হোক' টাকা আদায় করতে হবে নাহলে মালিক মজুরি দিবে না। 'ভদ্রতা' শব্দটা ওদের জন্যও তো কেউ কখনো ব্যাবহার করেনি,ওরা কোত্থেকে শিখবে,কেনই বা অন্যের জন্য ব্যাবহার করবে? ওরা বুঝে গেছে ওরা সমাজের এক বিচ্ছিন্ন জাতি যাদের বেশিরভাগকে তাদের বাবা-মারাও জন্মের পরপর ছেড়ে দিয়েছে!
ছেঁড়া-ঢিলা জিন্সের প্যান্টটা একটা মিষ্টির প্যাকেট বাঁধার রশি দিয়ে বাঁধা। গায়ে বহুদিন পড়ে থাকায় রঙ বদলে কালচে হয়ে যাওয়া একটা কমলা শার্ট। বয়ঃসন্ধিকালের প্রভাব ছেলেটার গলার স্বরে।কাছাকাছি বয়সের আমার আদরের ছোটভাইটার কথা মনে পড়লো- আচ্ছা,ও কি পারতো এভাবে গাড়িতে ঝুলে ঝুলে গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে, দৌড়ে চলন্ত বাসে উঠতে? জীবনের বাস্তবতা এই ছেলেকে এইসব শিখিয়েছে।ছেলেটাতো নিজে তার এই জীবন বেছে নেয়নি।......
ইচ্ছা করছিলো ছেলেটাকে ভালো কিছু জামা-কাপড় কিনে দিই।অন্তত একবেলা খাওয়াই। আমি এমন কিছুই করতে পারিনি। "এই চল,আজ তোকে খাওয়াই" - গাড়িভর্তি মানুষের সামনে এই কথা বলতেও একটু সাহসের দরকার হয়।আমার মধ্যে সংকোচ জিনিসটা অনেক বেশি। আমার গলা দিয়ে অনেক ইচ্ছায়ও কোন আওয়াজ বের হয়নি। আমি কিছুই বলতে পারিনি।
নেমে যাওয়ার সময় ছেলেটার হাতে একটা নোট গুঁজে দিয়ে বললাম-এই টাকাটা তোর জন্য। শুধু তোর। মালিককে এর থেকে ভাগ দেয়ার দরকার নাই!" বড় বড় চোখগুলো হয়তো রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে পিছন থেকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে,কিন্তু ফিরে তাকাতেও আমাকে সংকোচ জেঁকে ধরলো। তবে সে সংকোচে অস্বস্তি নয়, অদ্ভুত স্বস্তি ছিল।আমি সামনে হেঁটে চলে আসলাম।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই নভেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:৪৭