বর্তমানে বাংলাদেশে ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলছে। ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সারের (আইএআরসি) সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০১২ সালে বাংলাদেশে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ ২৪ হাজার এবং প্রতি বছর আরও ১ লাখ ২২ হাজার মানুষ নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে।
বাংলাদেশে নারী ও পুরুষের ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার হার কাছাকাছি হলেও সচেতনতার দিক থেকে নারীরা অনেক পিছিয়ে আছেন। । নারীদের মধ্যে যেসব ক্যান্সারের মূলত বেশি প্রকোপ দেখা যায় সেগুলো হল স্তন ক্যান্সার ও জরায়ুমুখ ক্যান্সার। আমাদের দেশে নারীরা লজ্জা পেয়ে বা অবহেলা করে এসব ক্যান্সার পরীক্ষা করাতে চান না। এতে করে অনেক ক্যান্সার রোগী সময়ের অনেক পরে গিয়ে জানতে পারেন তার ক্যান্সার আছে কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে যায়। প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম।ক্যান্সারের চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল এবং প্রতিবছর অনেক নারী এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করছে তবে কিছু সাবধানতা অবলম্বন করলে ক্যান্সারের প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়। সুস্থ থাকা যায়।
টোব্যাকো বা ধূমপান ক্যান্সারের অন্যতম কারণ। বর্তমানে বাংলাদেশে মেয়েদের মধ্যেও ধূমপানের প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। তামাক এবং ধূমপান ছেলে-মেয়ে উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর। ধূমপান ছেড়ে দিলে শুধু ক্যান্সারে রিস্কই কমবে না, এর সাথে সাথে হৃদরোগ এবং গর্ভাবস্থার অনেক জটিলতাও কমে যাবে। এখানে জেনে রাখা ভালো যে গর্ভবতী নারীর জন্য নিকোটিন খুবই ক্ষতিকর।
জরায়ু মুখ ক্যান্সারের ক্ষেত্রেঃ
জরায়ুমুখ ক্যান্সার ( Cervical cancer) নারীদের জন্য একটি ভয়াবহ ব্যাধি এবং জরায়ুমুখ ক্যান্সার বিশ্বব্যাপী নারীদের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। বিশ্বে প্রতি দুই মিনিটে একজন নারী জরায়ুমুখ ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করেন এবং প্রতি বছর ৫০ লক্ষাধিক নারী নতুন করে আক্রান্ত হন (প্রেক্ষিত ২০১০)। তাই সঠিক সময়েই ভ্যাক্সিন নিয়ে নিন। সাধারণত ১৫ বছর বয়সের পর থেকেই জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধক টিকা নেয়া যায়। মোট তিন ডোজ টিকা নিতে হয় প্রথম ডোজের এক মাস পর দ্বিতীয় ডোজ এবং প্রথম ডোজের ছয় মাস পর তৃতীয় ডোজ টিকা নিতে হয়। টিকা গ্রহণের পাশাপাশি নিয়মিত পরীক্ষা করালে জরায়ুমুখ ক্যান্সারের আক্রমণ হার কমিয়ে আনা যায়।
টিকা ছাড়াও সার্ভিকাল ক্যান্সার থেকে বাচার উপায় হল নিয়মিত স্ক্রিনিং। স্ক্রিনিং এর ফলে এই ক্যান্সার প্রথম দিকে ধরা যায়, ফলে সহজে চিকিৎসা করা সম্ভব হয়। সারভাইকাল ক্যানসারের স্ক্রিনিং এর জন্য ৩০ বছর বয়স থেকে (অথবা বিয়ের পাঁচ বছর পূর্ণ হবার পর থেকে) প্রতি তিন বছর পর পর নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে ভায়া (VIA: Visual inspection by acetic acid) পরীক্ষা করানো উচিত। বাংলাদেশে বেশিরভাগ সরকারী হাসপাতালে বিনামূল্যে এই স্ক্রিনিং করা হয়। তবে ৬৫ বছরের পর এই ক্যানসারের ঝুঁকি কমে যায়, সুতরাং তখন আর নিয়মিত এই স্ক্রিনিং করানোর প্রয়োজন নেই।
স্তন ক্যান্সারের ক্ষেত্রেঃ
যত দ্রুত স্তন ক্যান্সার নির্ণয় করা যায়, তত দ্রুত তার ভয়াবহতার মাত্রা কমিয়ে আনা সম্ভব।আপনার স্তনে যদি কোনো ধরনের অস্বস্তি বোধ করেন কিংবা অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়, তাহলে দেরি না করে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। সতর্ক হবেন যখন দেখবেন:
- স্তনের ভেতর কোন কিছু জমাট বেঁধে আছে বলে মনে হচ্ছে, কোনো মাংসপিণ্ডের মতো যা আগে ছিল না। এটা ছোট কিংবা বড় হতে পারে, অনেক সময় বাইরে থেকে দেখা যায় না কিন্তু ভেতরে অনুভূত হয়। বিশেষ করে একটি স্তনে এমন হলে।
- স্তনের চামড়ায় কোনো ধরনের পরিবর্তন দেখা দিলে, যেমন, কুঁচকে যাওয়া, গর্ত হয়ে যাওয়া, কালশিটে পড়া/ ঘা হওয়া, স্তনের রঙ বদলে যাওয়া, লালচে র্যাশ হওয়া, স্তনের চামড়া ওঠা ইত্যাদি।
- স্তনবৃন্তে পরিবর্তন আসা, যেমন, বৃন্ত ভেতরে ঢুকে যাওয়া, শক্ত হয়ে যাওয়া, ঘা হওয়া কিংবা অস্বাভাবিক লালচে রঙ দেখা দেওয়া।
- স্তনবৃন্ত থেকে কোনো ধরনের তরল নিঃসৃত হওয়া
-স্তনে ক্রমাগত ব্যাথা, টনটনে ব্যাথা
নির্দিষ্ট সময় পর পর মেয়েদের উচিত নিজেই নিজের স্তন পরীক্ষা করা। ইউটিউবের সাহায্যে এখন ঘরে বসেই স্তন পরীক্ষা করার উপায় শিখে নেয়াযায়। আপনি নিজেই ঘরোয়া পদ্ধতিতে দেখতে পারেন স্তন ক্যান্সারের কোনো লক্ষণ আপনার মাঝে আছে কিনা। যদি কোনো লক্ষণ দেখা যায় বা স্তনের আকৃতিতে হঠাৎ কোন পরিবর্তন দেখতে পান তবে দেরি না করে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিন । যাতে করে কোনো বিপদের সম্ভাবনা থাকলে সঠিক সময়েই তা শনাক্ত করে তার প্রতিকার নেয়া সম্ভব হয়। কারণ ক্যান্সারের শনাক্তকরণ যদি শুরুর দিকেই করা যায় তাহলে চিকিৎসার মাধ্যমে সহজেই তা নিরুপণ সম্ভব হয়। ক্যান্সার বর্তমান বিশ্বের অত্যান্ত ভয়াবহ একটি রোগ। এখানে খামখেয়ালির কোনো সুযোগ নেই। কোন সন্দেহ থাকলে, কোনো লক্ষণ প্রকাশ পেলে অতিসত্তর ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। ক্যান্সারের কারণে প্রিয়জনেরা কখনোই হারিয়ে যাক, এটা আমাদের কারোই কাম্য নয়। তাই সচেতনতার শুরু হোক পরিবার থেকেই।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মার্চ, ২০১৭ রাত ১:২২