২৯ অক্টোবর,২০১০
ঘুম থেকে উঠেছি ১০টা ৩০ এরও পর।মাথায় চিন্তার ঝড় চলছে,কাল জীবনের প্রথম ভর্তি পরীক্ষা...কি লেখা আছে ভাগ্যে জানিনা......বাপ্রবি তে পড়ার ইচ্ছা নাই এরকম খুব কম পাবলিক ই দেখছি.......ভিতরে ভিতরে চিন্তিত থাকলেও বাইরে তেমন কিছুই মনে হচ্ছেনা!
এই পর্যন্ত জীবনে যতগুলো পরীক্ষা দিয়েছি সব পরীক্ষার আগের দিন পড়তে ইচ্ছা হয় না,কারণ টা আমার কাছেও অজানা......জোর করে পড়তে চাইলেও পারিনা......সারা দুপুর কাটলো আধো ঘুম আর আধো জাগরণে..রাতে পড়ার চেষ্টা করেও পারলাম না...আমার মতে,
পরীক্ষার সময় ২টা জিনিস খুব ই গুরুত্বপূর্ণ।
১মঃশরীর সতেজ রাখা......
২য়ঃপরীক্ষার হলে কোনো কিছু কমন না পরলেও মাথা কোনোভাবেই গরম করা যাবে না।
তো এই জন্য রাত ১০টায় গেলাম বিছানায়...কিন্তু ঘুম এলো না ৩টা পর্যন্ত,কারণ টা টেনশন নাকি বাবার নাসিকা গর্জন বলতে পারবো না।
৩০ অক্টোবর,২০১০
আমার সীট পড়েছিল নতুন একাডেমিক ভবন এর ৫ তালায়।ভবন টা আমার কাছে জটিল লেগেছে,কিন্তু ঢুকতে ভয় লাগছিল।গেটের একটা নির্দিষ্ট সীমানার পর থেকে আমাদের সবাইকে একা যেতে হয়...ওই জায়গাটুকু পেরোনর সময় আমার হৃদস্পন্দন ছিল প্রায় ৮০-৯০।
কিন্তু মনে মনে ভাবছিলাম যেভাবেই হোক মাথা ঠান্ডা রাখতেই হবে...৫ তালায় উঠে ৫৩৫নং রুমে নিজের সীট খুজে বসে পড়লাম...পরীক্ষা শুরু হতে এখনো ৩০ মিনিট বাকি,চুপচাপ বসে চারদিকে দেখতে থাকলাম,একটা বেঞ্চে একজন করে,২ বেঞ্চের মাঝে ২ হাত করে ফাকা!!
আমাদের রুমে গার্ডের দায়িত্বে পড়লো ৩ জন!লম্বা দাড়িওয়ালা একজন বৃদ্ধ প্রফেসর,আর দুইজন অপেক্ষাকৃত কম বয়স্ক।৯টা বাজতেই প্রশ্নপত্র হাতে পেলাম...শুরু হলো কাগজ আর কলমের যুদ্ধ।দেড় ঘন্টা MCQএর মধ্যে ৪৫ মিনিট কিভাবে গেলো টের পেলাম না...তখনো
আমার অর্ধেকের বেশি MCQ বাকি!!তখন শুরু করলাম দ্রুত গতিতে হাত চালানো...আমার উত্তরপত্র নেওয়ার আগে শুধু এইটুকু হিসাব করতে পারলাম যে প্রথম ৬০টার মধ্যে আমি পূরন করেছি মাত্র ৩৭টা...পরের ৬০টার মধ্যে কতগুলো করেছি তা জানতে পারলাম না।
তখনো মাথা গরম হয় নাই এটাই ভরসা...ভাবলাম MCQ যা হইছে হইছে, written এ ভাল করতেই হবে।
যথারীতি written খাতাও হাতে পেলাম।সবাইকে ৫মিনিট সময় দিল ৩০টা প্রশ্ন আছে কিনা দেখার জন্য...পদার্থ সবই কমন পরেছে...গনিত ও ঠিক আছে...কিন্তু রসায়ন দেখে আক্কেল গুরুম!রসায়নের বেশিরভাগ ই আমার কমন পড়েনি...মনের ভিতরে টেনশন যেন ডানা
ঝাপ্টানো শুরু করলো...তাই খাতা দেখতে দেওয়ার ওই ৫মিনিট শেষ হওয়ার আগেই উত্তর করা শুরু করলাম...একটার উত্তর করা শেষ তখনি কে যেনো চেচিয়ে উঠল..."এই ছেলে তোমাদের না এখন লেখা শুরু করতে বারণ করেছি?"।মাথা তুলে দেখি বক্তার ডান হাতের তর্জনী আমার
দিকেই নির্দেশ করছে...দ্রুত পদক্ষেপে বক্তা এগিয়ে আসতে থাকল আমার দিকে,মনে হল খাচা ভেঙ্গে হৃদপিন্ড বাইরে বেরিয়ে আসবে...ভেবেছিলাম খাতা টাই নিয়ে জাবে...যাক কাছে এসে শুধু খাতাটা বন্ধ করে দিয়ে চলে গেলো!হাফ ছেড়ে বাচলাম।
সময় হলে লেখা শুরু করলাম...কলমের অনেক রক্ত ঝরিয়ে পরীক্ষার প্রায় শেষ দিকে চলে এসেছি।রসায়নের অবস্থা সবচেয়ে করুণ!উত্তর করেছি ঠিকই কিন্তু হবে কিনা তা জানিনা।সময় যখন শেষ প্রায় তখন চোখে পড়ল একটা পরিচিত অংক করিনি...কিভাবে শুরু করব তাও খেয়াল আসছে না।
ভাবলাম কাউকে একটু জিজ্ঞেস করলেই পারবো...প্রথমেই তাকালাম রুমের গার্ডত্রয়ের দিকে,দুইজন সরলদোলকের মত মাথা নাড়িয়ে রুমের এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত দেখে বেরাচ্ছে...আর বৃদ্ধ যে জন তিনি চেয়ারে বসে "shogun" নামের একটা ইংরেজী বই পরছে,মাঝে মাঝে বইয়ের উপর দিয়ে উকি মেরেও
দেখছেন...ভাবলাম খাতা হারানর চেয়ে ১০ নাম্বার হারানো ভাল...তাই ওই অঙ্কের নিচের ৩সে.মি জায়গা ফাকা রেখেই খাতা জমা দিয়ে দিলাম।
পরীক্ষা ভালো হলে মন থেকে একটা সারা পাওয়া যায়...কিন্তু আমি পেলাম না...বুয়েটে পড়ার স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল।
বাবা আমার কালো মুখ দেখেই বুঝতে পারলো কি হয়েছে...তাই কিছু বলল না,শুধু বলল,"কত উত্তর করছিস?"
সেটা তো আমি নিজেও জানিনা তাই বলতে পারলাম না।বন্ধু বান্ধব,মা,বোন যারাই ফোন করল...সবাইকে একই উত্তর,"ভালো হয়নাই,চান্স পাবোনা"
২টায় আর্কিটেকচার পরীক্ষাও দিলাম,ভালোই হলো...একটা ছবি শুধু বেশি ময়লা হয়ে গেলো।
আমার কলেজের থেকে আরোও একজন(সাব্বির আহমেদ-১৪৫তম) পরীক্ষা দিয়েছিলো,...তার কাছ থেকেই জানতে পারলাম তার পরীক্ষা খুব ভাল হয়েছে..."3 idiots" এর একটা ডায়লগ এর প্রমাণ পেলাম হাতেনাতে,মনটা আরো ভেঙ্গে গেলো...
বাকিদিনটুকু মাথা ভার হয়ে ছিল।সন্ধ্যেবেলায় বুয়েটের ১নং গেটের কাছে সিড়িতে বসে ভাবতে থাকলাম এই ক্যাম্পাসে আর কখনো আসতে হবেনা আমাকে।ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ক্ষণিকের জন্যে চোখের কোণায় কিছু চকচকও করে উঠেছিল বোধহয়......
এরপর???
এরপরের কাহিনী সংক্ষিপ্ত করেই বলি...
২-৭ নভেম্বর,আমি,সাব্বির আর আমাদের দুইজনের বাবা,এই চারজন মিলে ঢাকা-চট্টগ্রাম-ঢাকা-খুলনা-রাজশাহী...ঘুরে বেরালাম,বুয়েটের ক্ষতটা প্রায় শুকিয়ে গেছে...চুয়েটে চান্স পেলাম(মেধাতালিকায় ৮৭তম,আর্কিটেকচার এ ৭তম)...ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের 'ক' ইউনিটে হলাম ২০৩৮তম।
৮ নভেম্বর,২০১০
কালকে সন্ধ্যেয় রাজশাহী এসেছি,সকালে গেলাম রুয়েটে..(আমার বাবা যেখান থেকে পাশ করেছেন)।পরীক্ষা দিলাম,ভালই হয়েছে...সন্ধ্যেয় শুনলাম কুয়েটের রেজাল্ট দিয়েছে...চান্স পেলাম(২৭৩তম)।
ভাবছিলাম চুয়েটে আর্কিটেকচার এ ভর্তি হব...চিন্তা বাদ দিলাম...কুয়েটেই পড়বো...রাতে কানে খবর আসলো...বুয়েটের রেজাল্ট আজকেই দিয়ে দিবে......শুকনো ক্ষতে পড়লো খোচা...১১টার কিছু পরে সাব্বির ফোন করে বললো সে চান্স পেয়েছে।
ফোন করলাম বুয়েটের এক বড় ভাইকে......রোল বললাম,ধরেই নিয়েছিলাম চান্স হবেনা...তবুও যদি কিছু হয়ে যায়।...কিছুক্ষণ পরে ভাইয়া ফোন করে বললো,সরি ভাইয়া তোমার চান্স হয়নাই......ওয়েটিং লিস্ট এও আমার রোল নাই...কথাগুলো শুনলাম...মনের গভীরে বোধহয় চান্স পাওয়ার ইচ্ছা একটু হলেও অবশিষ্ট ছিলো।
তখন যে কিরকম লাগছিলো তা বুঝাতে পারবনা......গলা শুকিয়ে গিয়েছিলো...কথা বলতে পারছিলাম না কারো সাথে...বন্ধুরা ফোন করলো,তাদেরকে বললাম খবরটা......তারা আর কি বলবে?...শুনালো সান্তনার বাণী।
তখনও নেট এ রেজাল্ট ছাড়েনাই।
বুয়েটের আইপিই ডিপার্টমেন্টের একজন প্রফেসর আমার বাবার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু...উনি কিছুক্ষণ পরে ফোন দিলেন বাবার নাম্বার এ......ভাবলাম বোধহয় আমার রেজাল্ট জানতে ফোন দিয়েছেন।
"তোর ছেলে তো চান্স পাইছে..৪৩৫ তম।.নাম দেখছি...রোল নাম্বার বল,রোল নাম্বার মিলিয়েও দেখা গেলো ঠিকই আছে...আমার বিশ্বাস হল না মোটেও......পরে নেট এ রেজাল্ট দিলো...নিজের চোখে ৪বার দেখার পর বিশ্বাস হল।
বন্ধুদেরকে ফোন করে ভুল সংশোধন করলাম।আসলে ওই বড় ভাই শুধু আর্কিটেকচার এর লিস্ট দেখেছেন......।
৪৩৫ তম তে ইইই আর সিএসই আসে না......আইপিএ তে পড়ার ইচ্ছা নাই...(বাবার এজেন্ট আছে+মাত্র ৩০ জন)...রাতে অনেকক্ষণ ভাবলাম কোন সাবজেক্ট নিবো??
তারপর সবশেষে অনেক খোজখবর নেওয়ার পর সিভিল অধ্যয়নে নিজের সামনের ৫বছর বিসর্জন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম...
তারপর শুরু হল অপেক্ষার পালা.....লম্বা কাজকর্মহীন অলস সময়....কবে যে ক্লাস শুরুহবে?.........
শেষমেষ আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারী থেকে ক্লাস শুরু হবে...বুয়েট নিয়ে নানা মুখে নানা কথা শুনেছি...অনেক জল্পনা কল্পনা...দেখা যাক কি লেখা আছে ভাগ্যে......->$