somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ওবায়েদ হকের গল্পঃ অধর্ম

১৮ ই আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ১২:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মোতালেব মিয়া চা মুখে দিয়েই দোকানদারের দিকে কাপটা এগিয়ে দিয়ে বিরক্ত হয়ে বলল,
কি চা বানাইসস, দুধ চিনি বাড়াইয়া দে।
দোকানদার অভ্যস্ত হাতে দুধ আর চিনির চামচটা একটু করে নাড়িয়ে দিলো। তাতে চায়ের স্বাদে খুব একটা হেরফের হলো না কিন্তু মোতালেব মিয়া চায়ে চুমুক দিয়েই এমনভাবে তাকালো যেন চামচের নাড়ানিতে তাঁর চা অমৃত হয়ে গেছে। তাঁর তৃপ্তির কারন চায়ের স্বাদ নয়, অতিরিক্ত প্রাপ্তি।
বাজারে সবচেয়ে সস্তায় যেদিন ইলিশ বিক্রি হয়, যেদিন অর্ধেক দিনের আয় দিয়ে কানা ফকির দরদাম না করেই এক জোড়া ইলিশ কিনে নিয়ে যায় সেদিনও মোতালেব মিয়া আধা ঘন্টা দরদাম করে পাঁচ টাকা কম দিয়ে ইলিশ কিনে। তখনও তাঁর মুখে এই তৃপ্তির হাসি দেখা যায়।
প্রায়ই মামলার কাজে কোর্টে যেতে হয় তাকে সাক্ষী দিতে, লোকে বলে মিথ্যা সাক্ষী দিয়ে সে নিজের ঘর পাকা করেছে। কোর্ট থেকে তাঁর এই কোঁড়েরপার বাজারের রিকশা ভাড়া কমপক্ষে পনেরো টাকা কিন্তু মোতালেব মিয়া সবসময় ভাড়া ঠিক না করে আসে এবং এখানে এসে অনেক বাক বিতন্ডার পর আট টাকায় রফা করে।
চা শেষ করে চায়ের দোকানের টিভির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে সে। সাদা কালো টিভিতে বাংলা সিনেমার গান চলছে। বাংলা সিনেমার নায়িকা হিসেবে নায়িকার স্বাস্থ্য একটু খারাপই বলা যায়, নায়ক অবলীলায় বারবার কোলে তুলে নিচ্ছে। স্থুলতার অভাবে বৃষ্টিস্নাত নায়িকার কুর্দন মোতালেব মিয়ার বেশি ভালো লাগছে না কিন্তু নায়িকা যথাসাধ্য করেছে, স্বউদ্যোগে ভূরি কাঁপিয়ে পুষিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। গান শেষ হওয়ার পরই ভীলেন ধর্ষন পর্ব শুরু করলো, পার্শ্ব নায়িকা ‘বাঁচাও বাঁচাও’ চিৎকার করতে করতে নিজের পরিধেয় খুলতে ভীলেনকে সাহায্য করছিলো। মোতালেব মিয়া খুবই আগ্রহ নিয়ে সে দৃশ্য দেখতে লাগলো, মনে হয় পার্শ্ব নায়িকার অভিনয়ে কিংবা স্থুলতায় সে বেশ মুগ্ধ। এমন সময় এক অল্প বয়সের যুবক ছেলে দোকানে এসে হাক ছাড়লো,
এক কাপ চা।
মোতালেব মিয়া একটু বিষন্ন হলো, দোকানদারের দিকে তাকিয়ে গলায় জোড় পূর্বক বিরক্তি এনে বলল,
কি লাগাইয়া রাখছস এইসব, খবর দে খবর।
দোকানদারও নিতান্ত অনিচ্ছায় চ্যানেল পাল্টে দিলো। আজকে খবর ভালো লাগছে না মোতালেব মিয়ার। বড় কোনো খবর নেই, বোমা ফাটলো না কোথাও, রাজনৈতিক মারামারি নেই, কেমন যেন সব নেতিয়ে গেছে। ধর্ষন হয়নি কোথাও,দুর্ঘটনায় মানুষ মারা গেলো না, লঞ্চ ডুবা দূরে থাক কোনো ডিঙ্গি নৌকাও ডুবেনি কোথাও। এমন কোনো খবর নেই যা দেখে ‘আহা উহু’ করে আফসোস করা যাবে। মোতালেব মিয়া খুব হতাশ হলো, এভাবে দেশ চলতে থাকলে তাঁর মত মুরুব্বীদের কি হবে? ভাবনাটা হতাশার গভীরে প্রবেশ করার আগেই পাশের ছেলেটি সিগারেট ঠোটে রেখে তার দিকে তাকিয়ে বলল,
ভাই ম্যাছ আছে?
মোতালেব মিয়ার চোখে যেন ম্যাচ ছাড়াই আগুন জ্বলে উঠলো, সে গলা চড়িয়ে বলল,
ঐ পোলা তোমার বয়স কত?
ছেলেটি ঠোটে সিগারেট রেখেই বলল,
চ্যাতেন ক্যারে? ম্যাছ চাইছি বয়স জিগান ক্যান, বয়স কত হইলে ম্যাছ দিবেন?
চোখের আগুন যেনো এখন গায়ে ছড়িয়ে পড়লো মোতালেব মিয়ার, বলতে লাগলো,
আমি তোমার বাপের বয়সী আর তুমি আমার থেইকা ম্যাছ চাও, আমরা মুরুব্বীগো কত সম্মান করতাম, দেখলেই খারায়া সালাম দিতাম, অহনকার পোলাপাইন সব বেদ্দপ।
ছেলেটি সাথে সাথেই উঠে ব্যাঙ্গ করে বলল,
আসসালামুলাইকুম।
বলেই চলে গেলো, তাতেও মোতালেব মিয়ার মনে প্রশান্তি এলো না বরং জ্বালাটা বেড়ে আরো বহুগুনে জ্বলতে থাকলো।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষ সম্মানের কাঙ্গাল হয়ে উঠে। কারো কারো সে সম্মান চাইতে হয়না, আর বাকিরা চাইলেও পায় না। মোতালেব মিয়া দ্বিতীয় ধরনের লোক। এলাকার কোনো ছেলে তাকে সালাম না দিলে, কিছু কল্পিত বেয়দবী যোগ করে বাসায় গিয়ে নালিশ করে আসে।
দাড়ির সাথে সম্মানের একটা যোগ আছে, মোতালেব মিয়া তাই তাঁর কম ঘনত্বের গুটি কয়েক দাড়িও বড় করেছে, সেগুলোকে দেখতে পাটের আঁশের মত লাগে। কিন্তু তবুও বেয়াদপ ছেলেরা সালাম দেয় না।
মেজাজ ঠান্ডা করার জন্য পান মুখে দিলো সে। মুখে জমতে থাকা লাঁলচে তরলের মত তাঁর রাগটাও তরল হয়ে যাবে। সেই তরল জমিয়ে সে জমাদ্দার বাড়ির দেয়ালে বিসর্জন দিবে।হাজী আসকত জমাদ্দারকে সে দু চক্ষে দেখতে পারে না সে, তাঁর মুখে সাদা শুভ্র ঘন লম্বা দাড়ি দেখেই মোতালেব মিয়ার মনে খুব হিংসা হয়। জমাদ্দার বাড়ির দেয়ালে নতুন করে সাদা রঙ করা হয়েছে, একেবারে বকের ডানার মত সাদা ঝকঝক করছে। সে পিচিক করে তাঁর রাগ এবং মুখের তরল দিয়ে সাদা দেয়ালকে রাঙ্গিয়ে দিলো। এখন বেশ ভালো লাগছে দেয়ালে চায়নার ম্যাপের মত একটা আকৃতি হয়েছে। নিজের অনিচ্ছাকৃত শিল্পকর্ম দেখে সে খুব আপ্লুত হলো। আপ্লুত ভাবটা মুহুর্তেই উবে গেলো যখন দেখলো, তাঁর পিছনে হাজী আসকত জমাদ্দার দাঁড়িয়ে আছে। মোতালেব মিয়া মনে মনে কৈফিয়ত প্রস্তুত করছিলো। আসকত জমাদ্দার মোতালেবের শিল্পকর্মে খুব বেশি আগ্রহ না দেখিয়ে বলল,
কি মোতালেব কেমন আছো?
ঠিক এই ব্যাপারটাই মোতালেবের ভালো লাগে না, সে একজন বয়স্ক মানুষ, বয়সে ছোট হলেও হতে পারে কিন্তু তাই বলে তাকে তুমি করে বলবে এটা কেমন কথা। হজ্ব করলেই কি উনি সবাইকে তুমি করে বলার লাইসেন্স পেয়ে গেলেন নাকি? কিন্তু মুখে তার বিরক্তি গোপন করে বলল,
আছি আপনাদের দোয়ায়।
শুনলাম তোমার ছেলের বিয়ে দিচ্ছ।
মোতালেব মিয়া খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
কই থেইকা শুনলেন?
আরে এসব কথা কি আর গোপন থাকে? তা মেয়ের পরিবার কেমন?
এতিম মেয়ে, বাপ মা নাই, আমার খুব মায়া হইলো। কাইল দেখতে যামু। বিয়ে অহনও ঠিক হয় নাই।
আইচ্ছা ঠিক আছে, চলো নামাজটা পইড়া আসি।
মোতালেব মিয়া একটু আমতা আমতা করে কৈফিয়ত দেবার ভঙ্গি করে বলল,
অহন একটু কাম আছে, বুঝেনই তো। বাইত গিয়া পড়মু।
প্রায় সারাদিনই মোতালেব মিয়া অবসর কাটায়, শুধু নামাজের সময়ই কিভাবে যেন তার খুব গুরুত্বপুর্ন কাজ পরে যায়। মোতালেব মিয়া নিয়ত করেছে, সে আগামী বছর হজ্ব করতে যাবে, তারপর থেকে নিয়মিত নামাজ পড়বে। রাস্তাঘাটে সবাই ‘হাজী সাব’ ডাকবে আর সালাম দিবে ভাবতেই মনটা ভালো হয়ে যায় তার।
মোতালেব মিয়ার বর্তমান পেশা হচ্ছে জর্জ কোর্টের সাক্ষী তার আগে সে আদমজী জুট মিলে চাকরী করতো। নিজের কিছু বদ অভ্যাসের কারণে টাকা জমাতে পারেনি কোনোদিন। দুই মেয়ের বিয়ে দেয়ার পর আর হজ্বে যাওয়ার মত যথেষ্ট অর্থ ছিলো না তার কাছে। তাই এখন ছেলের বিয়ে দিয়ে কিছু অর্থযোগ ঘটাতে চাচ্ছেন। হজ্বে তাকে যেতেই হবে, অনেক পাপ জমে গেছে।
বিয়ের বাজারে তার ছেলে একেবারে নিন্মমানের পন্য নয়, এরকম ছেলের জন্য এতিম পাত্রী মোতালেব কখনোই বিবেচনা করেনি। কিন্তু এক্ষেত্রে পাত্রী তার অর্থ সম্পতির জন্য উতরে গেছে। মেয়ের বাবা মেয়ের জন্মের আগেই মারা গেছে, মা আরো বছর দশেক পর। মামার কাছে থেকে পড়াশুনা করেছে মেয়ে। অভিভাবক পদ এখন সেই মামার দখলে যা পরে মোতালেবের দখলে যাবে সেই সাথে দুটো বাড়ি এবং কয়েক একর জমি।
ছেলের মতকে কখনোই গুরুত্ব দেয়নি মোতালেব, তাই ছেলের রাজি হওয়া না হওয়া নিয়ে চিন্তা ছিলো না। কিন্তু মেয়ে দেখার পর ছেলের মুখে লাজুক হাসি দেখে মোতালেব মিয়া নিশ্চিন্ত হয়ে গেলো। মেয়ের বাড়ি দেখার জন্য কাল আবার যাবে সবাই, সেখানেই বিয়ের কাজটা সেরে ফেলবে ভাবছে, কারন হজ্বের আর বেশিদিন বাকি নেই।
মোতালেব মিয়া বাড়িতে ঢুকতেই দেখলেন উঠানে তার মেয়েরা মেহেদী বাটছে, তার ছেলেটা হাসি হাসি মুখ করে হাত পেতে রেখেছে। তার ছোট মেয়ে হাতে মেহেদী দিয়ে নকশা করছে। মোতালেব মিয়ার বোনেরা এসেছে তারা গুন গুন করে গান গাইছে, পাশের বাড়ির শামসুদ্দিনের বউও এসেছে, গলা চড়িয়ে সেও গাইছে,
“পোলার বাপে কে?
সাহেব মেজবান সে
সামনে দাড়াইছে।
আইচ্ছা আইচ্ছা
লাল বাগিচায়
ফুল ফুইটাছে”
একেবারে বিয়ের আসর। এই মফস্বল এলাকায় এভাবেই কাউকে না জানিয়ে বিয়ে হয়।
মোতালেব মিয়া আড়চোখে তার বড় মেয়েকে ইশারায় ডাকলো, দাঁত দাঁত ঘষে বলল,
কি হইতাছে এইসব?
মেন্দী বাটি আব্বা
মোতালেব মিয়া রেগে বলল,
হ, এইবার মাইক লাগাও
বড় মেয়ে তার রাগটা বুঝলো, এবার জ্বীবে কামড় দিয়ে বলল,
আয়হায় বুল হইয়া গেছে, খারান আপনার জামাইরে কইতাছি সে আধা ঘন্টার ভিতরে ব্যাবস্থা করবো।
বলেই সে চলে গেলো নিজের বরকে খুজতে।
মোতালেব মিয়া স্থির দৃষ্টিতে মেয়ের চলে যাওয়া দেখলো। এই সংসারে তার মত আর কেউ নেই। পাড়া প্রতিবেশীর কারণে কত বিয়ে ভেঙ্গে যায়, পাত্রীর মামা খোজ খবর নিলে বিপদেই পরতে হবে। তার যে খুব একটা সুনাম আছে তা বলা যাবে না।
মোতালেবের সব রাগ গিয়ে পরলো তার বউ মোমেনার উপর। এবং এইসব আয়োজন যে মোমেনার মস্তিষ্ক প্রসব করেছে তা নিয়ে তার কোনো সন্দেহ রইলো না। মোমেনাই তাকে একমাত্র যমের মত ভয় পায়, তাই তার উপর রাগ ঝেড়ে শান্তি পাওয়া যায়।
নিজের ঘরে ঢুকতেই মেজাজটা আরেক দফা বিগড়ে গেলো মোতালেব মিয়ার। সারা ঘর ভর্তি পাতা ছিটিয়ে চড়ুইভাতি খেলছে তার নাতি নাতনীরা। একেবারে ছোটটা নিজের করা প্রাকৃতিক উচ্ছিষ্ট নিয়ে খেলছে। সবার হাতে গোল করে মেহেদী দেয়া হয়েছিলো, তারা সেগুলোর কিছু অংশ নিজেদের জামায়, মুখে আর বাকি অংশ বিছানার চাদর আর মোতালেব মিয়ার পাঞ্জাবীতে লেপ্টে দিয়েছে।
মোমেনা হঠাত করে আগত অতিরিক্ত মেহমানদের জন্য রান্না বান্না করছিলো, স্বামীর হুংকার শোনে তাড়াতাড়ি ছুটে এলো। মোতালেব মিয়া বলল,
কই গিয়ে বইয়া রইছস?
মোমেনা কাচুমাচু করে জবাব দিলো,
আমি পাকের ঘরে আছিলাম।
এই আন্ডাবাচ্চাগুলানরে বাইর কর এইখান থেইকা।
মোমেনা হাস মুরগী তাড়ানোর মত করে হুস হুস করে বাচ্চাগুলোকে বাহিরে দিয়ে আসলো।
মোতালেব মিয়া বলল,
পোলার বিয়া এইতা এত রাষ্ট্র করার কি হইলো? কালকে মাইয়ার ঘর বাড়ি দেখতে যামু তাই কইছিলাম মাইয়াগো আর তাগো জামাইগো খবর দেও, তুমি দেখি চৌদ্দ গুষ্টিরে জানাইয়া ফেলছো। মাথার ভিত্রে কি সব গু!
মোমেনা মাথা নিচু করে বলল,
আমি তো খালি মাইয়া গো কইসি তারাই তো ফুফুগো আর খালাগো খবর দিছে।
মোতালেব মিয়া মোমেনাকে থামিয়ে বলল,
হইছে বেশি কথা কইবা না। তোমার মাইয়া জামাইরে দিয়া মাইক আনতে পাঠাইছে, তারে মানা করো গিয়া নাইলে লাত্থি দিয়া বাইর কইরা দিমু কইতাছি। আর ছোট জামাইরে কও কাজীর লগে যোগযোগ রাখতে, কাজীও যাইবো সাথে, ট্যাকা পসার কথা বলতে মানা করবা সেইটা আমি কমু।
মোমেনা ঘাড় কাত করে চলে যাচ্ছিলো, কিন্তু কি মনে করে থেমে গেলো তারপর নীচু গলায় বলল,
আমিও কি যামু কালকে?
মোতালেব মিয়া খুব বিরক্ত হয়ে বলল,
বেক্কলের মত কথা কও ক্যান, তুমি যাইবা কি করতে?
মোমেনা বলল,
পোলাটার বিয়ার আগে মাইয়াটারে একটু দেখুম না?
মোতালেব বলল,
মাইয়া আমি দেখছি, তোমার পোলায় দেখছে, তোমার দেখনের কাম নাই। বেশি দেখতে ইচ্ছা হইলে তোমার পোলার বালিশের নিচে মাইয়ার ফটু পাইবা দেইখা লও। আর মাঁচায় নতুন লাউ ধরছে, সব চইলা গেলে আইসা দেখবা লাউ সহ মাঁচা গায়েব হইয়া গেছে।
লাউ পাহারা দেয়ার যুক্তিটা মোমেনা কোনোমতেই অগ্রাহ্য করতে পারলো না। তাই আর কিছু না বলে চলে গেলো তার নিজের জায়গায়, রান্নাঘরে।
মোতালেব মিয়া তার বউয়ের নির্বুদ্ধিতায় অকারনেই ক্ষুদ্ধ হয়। এই বউটাকে তার ঠিক বউ মনে হয় না, মাঁচায় গজানো লাউ গাছটার মতই মনে হয়। মোতালেবের কালেভদ্রে পাঠানো সামান্য টাকা দিয়ে কোন জাদু ছাড়াই কিভাবে যে সে সংসার চালিয়েছে তা মোতালেব কখনোই ভাবেনি। সংসারের হিসাব কিতাব মোমেনার আহ্লাদ সব শুষে নিয়েছে। এই সংসারে মোতালেব মিয়ার অযাচিত কতৃত্ব মোমেনার ভার হালকা না করে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। পান বানিয়ে পাশে বসে আহ্লাদী করা বউ নয় মোমেনা। মোতালেবের খুব ইচ্ছা করে কম বয়সী একটা মেয়ে তার সাথে ঠাট্টা মশকরা করবে, পা টিপে দিতে বললে মোমেনার মত মাথা নিচু করে পা টিপবে না, নিজের পা ছড়িয়ে দিয়ে বলবে,
আমার পাও টিপ্পা দেন।
মোতালেব মিয়া টিপে দিতে গেলে আবার পা সরিয়ে নিবে, গায়ে গা ঠেসে ধরে খিল খিল করে হেসে উঠবে।
এখন আর বিয়ে করার বয়স নাই মোতালেব মিয়ার, এই বয়সে মেয়ে পাবে কই, কিন্তু টাকা থাকলে কি না হয়। মোতালেব মিয়া সুখস্বপ্নে ভাসতে ভাসতে ঘুমের পাঁকে ডুবে যাচ্ছিলো কিন্তু হঠাত কর্কশ শব্দে মাইক বেজে উঠলো। তার বড় জামাই খুবই তরিতকর্মা।
মোতালেব মিয়ার মেয়েরা পাত্রীকে বিভিন্ন প্রশ্ন করে পর্যুদস্ত করতে চাইছে, তার ছেলে আড় চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে। বড় মেয়ের মেয়ে দুটি দরজার পর্দায় ঝুলছে তাদের কেউ বারন করছে না। মোতালেব মিয়া বার কয়েক চোখ রাঙ্গালো তাদের দিকে চেয়ে কিন্তু তারা মোতালেব মিয়ার চোখের ভাষা না বুঝার ভান করে ঝুলাঝুলি অব্যাহত রাখলো। পাত্রীর মামা খুব ব্যাস্ত মেহমানদের আপ্যায়ন নিয়ে, তাকে থামিয়ে মোতালেব মিয়া বললেন,
আপনে আর ব্যাস্ত হওয়ার দরকার নাই, বসেন। শোনেন বেয়াই সাব জন্ম মৃত্যু বিয়া আল্লার হাতে, আল্লাই ঠিক কইরা দিছেন এই বিয়া। নাইলে কত বিয়া আইছে পোলার লাইগা কিন্তু আমার যুত লাগে নাই। আল্লার ইচ্ছা আছে তাই আমিও দেরি করতে চাই না, আইজকাই বিয়া পরাইতে চাই।
মেয়ের মামা যেন হাপ ছেড়ে বাঁচলো, তিনিও দায়িত্ব থেকে মুক্তি চান। তিনি গদগদ হয়ে বললেন,
ঠিক বলেছেন, আমরা তো উছিলা মাত্র, তাঁর ইচ্ছাই সব, উপরওয়ালার মর্জি থাকলে আজকেই বিয়া হইবো।
মুহুর্তেই পরিবেশ পরিবর্তন হয়ে গেলো, মেয়ের মাথার ঘোমটার দৈর্ঘ্য বেড়ে গেলো, ছেলে কেমন অস্বস্তিতে এদিক সেদিক তাকাতে লাগলো, মনে হয় রুমালের অভাব বোধ করছে। কাজীও নড়েচড়ে বসলো। মোতালেব মিয়া তার হতে চাওয়া সম্পদের দিকে আরেকবার চোখ বোলাতে লাগলো। হঠাত দেয়ালে টাঙ্গানো দুটি ছবিতে তার চোখ আটকে গেলো। দুজনকেই চেনা চেনা মনে হচ্ছে। মোতালেবের চোখ অনুসরণ করে মেয়ের মামা বললেন,
আমাগো মা মনির মা বাবা। আল্লা তাগো বেহেশত নসীব করুক।
বলেই তিনি কাজী সাহেবকে তাড়া দিতে লাগলেন। মোতালেব মিয়া মনোযোগ ফেরাতে পারছেন না, সেলিনা আর তার স্বামী হান্নানের ছবির দিকে সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সেলিনার ছবিটাতে সে স্মিত হাসি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, মনে হচ্ছে তার দিকে তাকিয়েই হাসছে। শেষবার যখন মোতালেবের সাথে সেলিনার দেখা হয়েছিলো, তখন তার চোখে ছিলো কাকুতি, কন্ঠে অসহায়ত্ব। কেঁদে কেঁদে মোতালেবকে বলেছিলো,
আমি অহন কি করুম?
মোতালেব তাচ্ছিল্য সহকারে বলেছিলো,
আমি কেমনে কমু? যাও স্বামীর কাছে ফিরা যাও।
তুমি আমারে বিয়া করো
আরে কয় কি! আমার বউ পোলাপান আছে আমি তোমারে বিয়া করুম ক্যান?
আমার পেটে তোমার বাচ্চা আসছে, আমি এইটারে নিয়া কই যামু।
কিচ্ছু হইবো না, হান্নান মিয়া বুঝবো না।
বুঝবো, ডাক্তার কইছে হের সন্তান হইবো না। সেলিনা তার পায়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
আমারে তুমি বিয়া কইরা লইয়া যাও।
মোতালেব পায়ে ঝাড়া দিয়ে বলল,
যাঃ মাগী আমার লগে সিনেমা করবি না। শোয়নের সময় মনে আছিল না। প্যান প্যান করবি না যা যেদিকে ইচ্ছা।
সেলিনাকে কিছুই বলতে হয়নি, তার আগেই হান্নান মারা গিয়েছিলো।
মোতালেব মিয়ার চারপাশটা কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে গেলো, ঘোমটা মাথায় দেয়া মেয়েটির দিকে তাকাতেই তার বুক কেঁপে উঠলো। মাথার ভেতর সব কিছু কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। ধর্ম অধর্মের মাঝে নিজের কর্মের বেড়াজালে জড়িয়ে সে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পাথরের মত বসে রইলো। হৃদপিন্ড টা যেন বুকের ভেতর কোলাব্যাঙের মত লাফাচ্ছে আর ছলাত ছলাত রক্ত ছিটিয়ে দিচ্ছে। মোতালেব মিয়ার চারপাশটা ঝাপসা হয়ে আসছে, সেলিনার ছবির হাসিটা এখন কেমন যেন বিদ্রুপের মত দেখাচ্ছে।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ১২:৪৪
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৫৬

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ অন্তর্জাল।

ছোটবেলায় মুরব্বিদের মুখে শোনা গুরুত্বপূর্ণ অনেক ছড়া কবিতার মত নিচের এই লাইন দুইটাকে আজও অনেক প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×