somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ কি ইসলাম বিরোধী চেতনা?

২১ শে অক্টোবর, ২০০৯ সকাল ১০:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বিশ শতকের শেষভাগে সোভিয়েট ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্বরাজনীতিতে ক্ষমতার ভারসাম্যে আসে ব্যাপক পরিবর্তন। সমাজতান্ত্রীক আদর্শে উজ্জীবিত সোভিয়েট ইউনিয়ন রাতারাতি পূজিবাদী আদর্শ গ্রহণ করার ফলশ্রুতিতে বিশ্বরাজনীতি পূঁজিবাদী বিশ্বের কেবালা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতে শুরু করে। সমাজতান্ত্রীক বিশ্বের এই হঠাৎ বিপর্যয়ে, বিশ্ব রাজনীতির নয়া মেরুকরণের অনিবার্য উপাদান হিসেবে পূজিবাদী আদর্শের বিপরীতে ইসলামী জঙ্গীবাদ দর্শন ক্রমশঃ শক্তি সঞ্চয় করে এই শতকের শুরুতেই এই ভ্রান্ত ইসলামী মতবাদ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।

বাংলাদেশে পচাঁত্তর পরবর্তী পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ধর্মভিত্তিক সামপ্রদায়িক রাজনীতির সাংবিধানিক স্বীকৃতিতেই পুনরুত্থান ঘটে। পরবর্তীতে বিশ্ব রাজনীতির নতুন মেরুকরণ এবং বিশ্বায়নের সুযোগে বাংলাদেশেও সংগঠিত হতে থাকে হরকাতুল জেহাদ, জে.এম.বি সহ বেশ কিছু সামপ্রদায়িক রাজনৈতিক দল, যেগুলোর মূল দর্শন হচ্ছে ইসলামী জঙ্গীবাদ। বর্তমানে সরকারী কঠোর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও যে এই সব জঙ্গীবাদী দল গোপনে এখনো তৎপড় এর প্রমান মেলে দেশের তিনটি বড় রেল ষ্টেশনে এই সেদিনের একযোগে বোমাবাজী ঘটনায়।

বাংলাদেশে ইসলামী জঙ্গীবাদের বড় শক্র হচ্ছে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ। এই প্রস্তাবনার সপক্ষে রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে, উদীচির অনুষ্ঠানে বোমা হামলা সহ প্রয়াত কবি শামসুর রহমান, শেখ হাসিনাকে হত্যার প্রচেষ্টা ঘটনা সমূহ উল্লেখ করা যেতে পারে। উল্লিখিত প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিবর্গ বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদেরই ধারক ও বাহক। তাই এদের উপর আক্রমন বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদকেই আক্রমনের নামান্তর।

অনেকদিন ধরে, বিশেষতঃ স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ধারা শুরু হওয়ার পর থেকে ধর্মোন্মাদ চিন্তা চেতনায় আচ্ছন্ন কিছু ব্যক্তিবর্গ জাতীয়তাবাদ তথা বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদকে ইসলামের প্রতিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করার প্রয়াস পাচ্ছে। সেই পুরানো পাকিস্তানী কূটতর্কজাল -- বাংলা এবং বাঙ্গালী সংস্কৃতিতে বড়বেশী হিন্দুয়ানী গন্ধ, তাই এর খতনা করে মুসলমানী লেবাস পরানো অতি জরুরী নতুবা খোদ ইসলামই যে হয়ে পড়বে বিপন্ন। ইসলাম কি এতোই ঠুনকো যে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের ধাক্কায় তার ইজ্জত খোয়াবে? এ ছাড়া ধর্ম এবং জাতীয়তাবাদের মাঝে কি কোন দ্বন্দ্বের অবকাশ কিংবা বৈরিতা রয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে ধর্ম এবং জাতীয়তাবাদ এই দুটি পদবাচ্য সম্পর্কে আমাদের স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে।

ধর্ম কি? সাধারণভাবে ধর্মকে সংজ্ঞায়িত করা যায় এভাবে -- ধর্ম হচ্ছে ভাববাদীদের ইশ্বর চেতনায় প্রাপ্ত ঐশীবানী যাতে বিধৃত আছে ইহজগতে জীবন যাপনের নির্দেশাবলী, যা একজন ধার্মিকের জন্য অবশ্যই পালনীয়। প্রায় প্রতিটি ধর্মেই রয়েছে মৃত্যুর পর পুনরুত্থানে বিশ্বাস। ধর্মীয় ঐশীবানীতে রযেছে ধার্মিকের জন্য পরলোকে লোভনীয় পুরস্কার এবং অবিশ্বাসীর জন্য ভয়াবহ শাস্তির অঙ্গিকার। এই শাস্তি বা পুরস্কার নির্ধারিত হবে ইহলোকের কর্মফলের ভিত্তিতেই।

ধর্ম হিসেবে ইসলাম নবীন এবং সময়ের প্রেক্ষাপটে আধুনিক একথা নিঃসন্দেহে বলা চলে। পবিত্র গ্রন্থ কোরআনে ইসলামকে সর্বকালের এবং সর্ব জাতির বলে ঘোষিত হয়েছে। এই ঘোষনার মাঝেই জাতিসত্তা বা জাতীয়তাবাদের প্রতি ইসলামের স্বীকৃতির মেলে। কোরআনে বিভিন্ন প্রসঙ্গে বিভিন্ন জাতির কথা এসেছে এবং স্পষ্টতঃই বিভিন্ন জাতির কাছে দূত প্রেরনের কথা বলা হয়েছে। মোট কথা জাতি বা জাতীয়তাবাদের অসিত্বকে ইসলাম অস্বীকৃতি কিংবা এর প্রতি কোন বিরূপ মনোভাব পোষন করে না।

জাতি, জাতিসত্তা বা জাতীয়তাবাদ মূলতঃ নৃ- বিজ্ঞানের অংশ। সৃষ্টির আদি পর্যায় থেকে বিভিন্ন মানব গোষ্ঠী নানা কারণে ভৌগলিক বিচ্ছিন্ন অবস্থায় যূথবদ্ধভাবে বসবাস করার ফলে একেক গোষ্ঠীর দৈহিক গঠন, বর্ণ, আকৃতি, ভাষা-সংস্কৃতির মিথস্ক্রীয়ায় প্রকাশিত হয়েছে একেক রূপে। এভাবেই আর্য, দ্রাবিড়, মোঙ্গলীয় ইত্যাদি বিভিন্ন জাতির উদ্ভব হয়েছে। পরবর্তীতে এই সব মৌলিক জাতির পারস্পরিক মিথস্ক্রীয়ায় সৃষ্ট হয়েছে সমকালীন জাতি সমূহ, যেমন জার্মানী, জাপানী, ফরাসী, বাঙ্গালী ইত্যাদি। এই সব জাতির দৈহিক গঠন, বর্ণ ভাষা-সংস্কৃতি, চারিত্রিক গঠনে পার্থক্য লক্ষ্যনীয়। উল্লেখ্য, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, বর্ণ দৈহিক গঠন ইত্যাদি জীববিজ্ঞানে স্বীকৃত জিন দ্বারা নির্ধারিত, যা বংশ পরস্পরায় বিভিন্ন মানব গোষ্ঠী বা জাতির মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে। আর ভাষা সংস্কৃতিতে বিচিত্রতা আসে মানবগোষ্ঠীর বিভিন্ন ভৌগলিক সীমানায় বিচ্ছিন্নভাবে বসবাসের অনিবার্য ফলশ্রুতিতে। তাই একজন আরবীয় মুসলমান ও একজন আফ্রিকার মুসলমানের ধর্মীয় চিন্তা- চেতনা এক হলেও দৈহিক গঠন, বর্ণ, চারিত্রিক গঠন এবং সর্বোপরি ভাষা- সংস্কৃতি বিচারে তাদের মাঝে রয়েছে বিস্তর ব্যবধান।

পৃথিবীর অপরাপর জাতির মতোন বাঙ্গালীরও গর্ব করার মত রয়েছে নিজস্ব মূল্যবোধ, ভাষা-সংস্কৃতি এবং একটি ভূখন্ড। আবহমান কাল থেকে বাংলার এই নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি চর্চিত হয়ে আসছে যা নিয়ে বাঙ্গালী হিসেবে আমরা গর্বিত হতে পারি। আমাদের এই গর্ব,বাংলার নিজস্ব এ সংস্কৃতি কি ইসলাম বিরোধী চেতনা? এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যায় কোন জাতির সংস্কৃতি যদি ইসলামের মৌলিক আর্দশ বিরোধী না হয়ে থাকে তবে তা ইসলাম বিরোধী হতে পারে না। ইসলামের মূল আদর্শ হচ্ছে একেশ্বরবাদে বিশ্বাস, মোহাম্মদ (সঃ)- কে প্রেরিত পুরুষ হিসেবে প্রেরিত পুরুষ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া এবং সেই সাথে কোরআন ও হাদিসের অনুবর্তী হওয়া । বাঙ্গালী মুসলমান যদি তার বাঙ্গালিত্ব বজায় রেখে ইসলামের এই মূল আদর্শের অনুবর্তী হতে পারে তাহলে ইসলামের সাথে বিরোধের অবকাশ কোথায়?

মৌলবাদীরা বাংলা সংস্কৃতি ও ভাষার মাঝে হিন্দুয়ানী গন্ধ পেয়ে থাকে। ব্যতিক্রমকে নিয়মের ব্যত্যয় হিসেবে মেনে নিয়ে একথা অবশ্যই স্বীকার্য যে, বাঙ্গালী মুসলমানদের পূর্ব পুরুষ এক সময় সনাতন হিন্দুধর্মের অনুসারী ছিল এবং সে কারণে আমাদের ভাষা-সংস্কৃতিতে হিন্দুধর্মের অনিবার্য প্রভাব রয়েছে। এ ছাড়া বাঙ্গালী সংস্কৃতিতে বৌদ্ধ ধর্ম এবং দেশজ লোকাচারের প্রভাবকেও অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু এ সত্ত্বেও যদি আমাদের ভাষা-সংস্কৃতি ইসলামের মূল আদর্শকে বিপন্ন না করে তাহলে তা বর্জন করার যৌক্তিকতা কোথায়? বাংলা-বাঙ্গালী সংস্কৃতির বর্তমান ধারা আমাদের নিজস্ব অহংকার,একে যারা অস্বীকার করতে চায় বা জোরপূর্বক ‘ইসলামী করণ’ করার প্রচেষ্টা চালায় তারা হয় হীনমন্যতাগ্রস্ত কিংবা তাদের রয়েছে কোন এক দূরভীসন্ধী। উল্লেখ্য, খোদ আরবে বর্তমানে যে ভাষা-সংস্কৃতি অব্যাহত আছে বিশ্লেষনে দেখা যায় তা ইসলাম ধর্মের আর্বিভাবের বহুপূর্ব থেকেই প্রচলিত হয়ে আসছে। আরবের মুসলমানেরা তাদের পূর্বপুরুষদের সাহিত্য-সংস্কৃতিকে জাহেলী যুগের বলে অস্বীকার করেনি বরং প্রাচীন সেই বেদুইন সংস্কৃতির ভিত্তিতেই তাদের সংস্কৃতি, ভাষা-সাহিত্য বিবর্তিত হয়ে চলছে।

উপমহাদেশে ধূর্ত রাজনীতিক মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ্‌ শুধু মাত্র তার রাজনৈতিক অভিলাষ পূরণের লক্ষ্যে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের প্রবর্তন করেন। অবশ্য এর পেছনে ইংরেজ শাসকদের ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ - এর প্রভাবও রয়েছে যথেষ্ঠ । জিন্নাহ্ত এই ধর্ম ভিত্তিক জাতীয়তাবাদে গভীর কোন দর্শন ছিল না এবং তার উদ্ভাবিত দ্বিজাতিতত্ত্ব যে একটি ভুল প্রস্তাবনা তা প্রমানিত হয়েছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মাধ্যমে। উল্লেখ্য, জিন্নাহর এই জাতীয়তাবোধ ধর্মীয় কোন প্রেরণা থেকে উৎসারিত ছিল না। বরং পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত জিন্নাহ্‌ যে ইসলাম ধর্মের প্রতি খুব বেশী শ্রদ্ধাশীল বা দরদী ছিলেন না তা ঐতিহাসিকদের বিশ্লেষনে ধরা পড়ে। বর্তমানে দেশে বিদেশে জামাত সহ অন্যান্য ধর্মভিত্তিক মৌলবাদী রাজনৈতিক দল আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত সেই দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে তাদের রাজনৈতিক অপপ্রচার চালিয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। এই সব দলগুলো পাকিস্তানী কায়দায় বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি ভাষার বিরুদ্ধে তৎপড়তা চালাচ্ছে। এদের উদ্দেশ্য রাষ্ট্রক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে তালেবানী স্টাইলে তাদের ভ্রান্ত ইসলামী মতবাদকে জনগণের উপর চাপিয়ে দেওয়া। আর এজন্য ইসলামী মুখোশে খোদ বাংঙ্গালী সংস্কৃতির উপর এদের এই আগ্রাসনের অপতৎপড়তা।

পাক-ভারত বিভক্তির অব্যহতি পরই বাংলা, বাঙ্গালী সংস্কৃতি এবং ভাষাকে ইসলামের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানো হয় তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনীতিবিদদের রাজনৈতিক অপকৌশল বাস্তবায়নের হীন অভিসন্ধিতে । এই বিশেষ গোষ্ঠী প্রথমেই আঘাত হানে আমাদের ভাষার উপর। বাংলাভাষার সাথে হিন্দুধর্মীয় গ্রন্থাবলীর ভাষা সংস্কৃতের যোগাযোগ সুস্পষ্ট এবং এই অজুহাতে সেই সময়কার ধর্মীয় কুসংস্কারাচ্ছন্ন গোষ্ঠী বাংলাভাষার বিপক্ষে বেশ জোরেসোরেই প্রচারাভিযান শুরু করে। এই প্রেক্ষাপটেই মিঃ জিন্নাহ্‌ কুট রাজনৈতিক চাল চালেন উর্দু ভাষার সপক্ষে এবং সদর্পে ঘোষনা দেন, ‘ উর্দু, এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। শুধু তাই নয়, সে সময়কার কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির উপর আঘাত হানতে থাকে বিভিন্নভাবে। বাঙ্গালীর মানস চরিত্র গঠনে রবীন্দ্রনাথের অবদানকে সর্ম্পূণ অবজ্ঞা করে রবীন্দ্র সঙ্গীত পর্য্যন্ত সরকারীভাবে নিষিদ্ধ ছিল বেশ কিছু বছর। পাকিস্তানের সেই অন্ধকারময় যুগে বাংলাসাহিত্যের বেশ ক’জন মাইল ফলক যেমন, ইশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম চন্দ্র, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ প্রমূখকে অস্বীকার করার পায়তারা চলছিলো শুধুমাত্র তাদের ধর্মীয় অবস্থানের কারণে।

উল্লেখ্য, একালের মতোন সেকালেও ঘরের শক্র বিভীষণ তথা বাঙ্গালী হয়ে বাংলা ভাষা- সংস্কৃতির বিরুদ্ধে যড়যন্ত্র করার মতোন জ্ঞানপাপী কুলাঙ্গারের অভাব ছিল না। তৎকালীন মুসলিমলীগ সমর্থিত কিছু পত্র-পত্রিকা (বাঙ্গালী সম্পাদিত ) বাংলাভাষার বিরুদ্ধে যে তৎপড়তা চালিয়েছিল তা সে সময়কার পত্র-পত্রিকা পরখ করলেই সুষ্পষ্ট সাক্ষ্য মেলে। এদের কেউ কেউ বাংলা ভাষাকে ‘মুসলামানী’ করার প্রয়াসে উর্দু হরফে বাংলা লেখার উদ্ভট যুক্তি প্রদর্শন করেছিলো। কেউ বা ছিল বাংলাভাষার তাবদ তৎসম, তদ্ভব (সংস্কৃত বা সংস্কৃত মূল) শব্দাবলী বর্জন করে আরো বেশী উর্দু, ফার্সী শব্দের জোর অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে বাংলাভাষাকে ইসলামীকরণ করার স্বপক্ষে। পৃথিবীর ইতিহাসে কোন জাতিই তার মুখের ভাষার উপর এহেন আগ্রাসনকে র্নিদ্বিধায় মেনে নেয়নি বাঙ্গালীরাও তাই গর্জে ওঠেছিলো প্রচন্ড রোষে -- সৃষ্টি করেছিলো বাহান্নোর গৌরবউজ্জল ইতিহাস, যা ছিল আমাদের স্বাধীনতার আন্দোলনের প্রথম পদক্ষেপ।

স্বাধীনতার প্রায় ছত্রিশ বৎসর পর আজো কোন কোন গোষ্ঠী ইসলামের মুখোশে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ষঢ়যন্ত্রে লিপ্ত। এদের দাপটে আমাদের গৌরবগাথা, স্বাধীনতার ইতিহাস পর্য্যন্ত বিকৃত । এমনকি কেউ কেউ আমাদের জাতীয় সঙ্গীত পর্য্যন্ত বদলানোর ইচ্ছা প্রকাশের ধৃষ্টতা দেখিয়েছে এর রচয়িতা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ হিন্দু ধর্মবলম্বী বলে। সেই পুরানো পাকিস্তানী কায়দায় এদের দাবী ডিমকে আন্ডা বলতে হবে কিংবা মাংশকে গোশত এবং ব্রাক্ষ্মনবাড়িয়াকে বি. বাড়িয়া । তা না হলে যেন ইসলামই বিপন্ন হয়ে পড়বে। স্বভাবত:ই প্রশ্ন জাগে, পবিত্র কোরআনে কি কোন ভাষাকে অশুচি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে? কোরআনের ভাষা আরবী ও প্রাচীন হিব্রুভাষার মূল এক। আর হিব্রু তো মুসলমানদের ধর্মীয় প্রতিপক্ষ ইহুদীদের ধর্মগ্রন্থ তাওরাতের ভাষা। এছাড়া পবিত্র কোরআনের ভাষা হওয়ার কারণে আরবী ভাষাকে পৃথিবীর অপরাপর ভাষা হতে অধিকতর মর্য্যাদা দেওয়া হয়েছে একথা পবিত্র কোরআনে কিংবা হাদিসে কোথাও বলা হয়নি। বাস্তবতা এই যে, আরবীকে কোরআনের ভাষা নির্বাচিত করা হয়েছে ঘটনাচক্রে-- হযরত মুহাম্মদ (দঃ) এর জন্ম যদি আরব ভুমিতে না হয়ে বাংলায় হতো তাহলে কোরআনের ভাষা নিঃসন্দেহে বাংলা হতো কিংবা অন্য কোন ভূখন্ডে হলে সে ভূখন্ডের ভাষাই কোরআনের ভাষা হিসেবে পরিচিতি পেত।

বাঙ্গালী মুসলমানদের কেউ কেউ বড়বেশী বিভ্রান্ত। এদের কেউ কেউ ইসলাম ও আরবকে সমার্থক করে ফেলেন। যা কিছু আরবীয় তাকেই ইসলামী মনে করা যে এক ধরনের ভ্রান্ত ধারণা যুক্তির আলোকে তা বুঝার চেষ্টা অনেকেই করেন না। এমন একটি ভ্রান্ত এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় মেলে নবজাতকের নাম করণ করার প্রসঙ্গে। মুসলমান হলেই আরবীতে নাম রাখতে হবে এমন কোন নির্দেশনা পবিত্র কোরআনে কিংবা কোন নির্ভরযোগ্য হাদীছে নেই। নবজাতকের নাম রাখা প্রসঙ্গে ধর্মোম্মাদ ব্যক্তিবর্গ প্রায়ই বলে থাকেন ব্যক্তির উপর নামের তাছির (প্রভাব) আছে। এই কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভাবনারই বা ভিত কোথায়? মোহাম্মদ নামে বাংলাদেশে হাজার হাজার মানুষ রয়েছে। এদের কজনের উপরই বা হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এর চরিত্রের প্রভাব লক্ষনীয়? মোহাম্মদ নামের অনেককেই তো দেখা যায় চোর, ডাকাত, ভন্ড প্রতারক হতে। বিজাতীয় ভাষা আরবীতে সন্তানের নাম রাখলেই যে সন্তান মোমিন মুসলমান হয়ে যাবে কিংবা বাংলায় নাম রাখলে মুসলমানত্ব নষ্ট হয়ে যাবে এমন ভাবনা আমাদের চিন্তা -চেতনার অগভীরতারই প্রকাশ। তথাকথিত মুসলমান নাম যথা আব্দুল, আবুল, খালেক, মালেক, সালেহা, রহিমা, ইত্যাদি আরব ভূখন্ডে ইসলাম আর্বিভাবের পূর্বে কি প্রচলিত ছিল না? আরবীতে নাম রাখা শুধুমাত্র মুসলমানদেরই আধিপত্য নয় বরং আরবী ভাষা-ভাষী খ্রীষ্ট্রান বা ইহুদীরাও আরবীতে নাম রাখে তাদের ভাষার প্রতি সম্মান দেখিয়েই। ধর্মমত নির্বিশেষে বাঙ্গালী সন্তানের নাম যদি অর্থবহ ও শ্রুতিমধুর বাংলা শব্দে রাখা হয় তবে বাংলাভাষাকেই যথাযথ সম্মান দেখানো হবে এবং এতে করে ইসলামের ভাবমূর্তির কোনরূপ ক্ষুন্ন হবে না এ সত্য আমাদেরকে উপলদ্ধি করতে হবে।

মুসলিম বিশ্বের অপরাপর দেশে নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি ঐতিহ্যের প্রতি যথাযথ সম্মান দেখানো হয়। বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়া এক সময় হিন্দু সভ্যতায় প্রভাবিত ছিল। এই সত্যকে সেখানকার মুসলমানরা অস্বীকার করেনি। তাই আজো জাতীয় গ্রন্থ হিসাবে রামায়নকে সেখানকার অধিবাসীরা মেনে নিয়েছে। মিশরীয় মুসলমানেরা ফেরাউনদের সভ্যতা, ঐতিহ্য নিয়ে আজো গর্ব করে। সেখানকার মুসলমানরা হযরত মুসার সাথে যে ফেরাউনরা চরম বিরোধে লিপ্ত ছিল সে বিষয়ে প্রশ্ন তোলে না।

বাংলাদেশে যারা ইসলামকে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের বিপক্ষ শক্তি হিসেবে বিবেচনা করে তারা মূলতঃ ইসলামের শক্র জঙ্গীবাদকেই মদদ যোগায়। শান্তির ধর্ম ইসলামে স্পষ্টতঃই ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করা নিষিদ্ধ রয়েছে। ইসলাম মানবতাকেই সবচেয়ে বেশী মূল্য দেয়। আর বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের মূল সুর - সবার উপর মানুষ সত্য, তাহার উপর নাই। তাহলে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ কেন ইসলামের প্রতিপক্ষ হবে?













২৬টি মন্তব্য ২৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ অপেক্ষা

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২৩



গরমের সময় ক্লাশ গুলো বেশ লম্বা মনে হয়, তার উপর সানোয়ার স্যারের ক্লাশ এমনিতেই লম্বা হয় । তার একটা মুদ্রা দোষ আছে প্যারা প্রতি একটা শব্দ তিনি করেন, ব্যাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

×