বিশ্বে জ্বালানীর চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। কিন্তু প্রচলিত জ্বালানীর মজুদ দিনকে দিন কমে আসছে এবং এসব জ্বালানী পৃথিবীর পরিবেশকে মারাত্মকভাবে দূষিত করছে। পাথুরে কয়লা ও জ্বালানী তেলের পর আরো উন্নত বা বিকল্প জ্বালানী হিসেবে সৌর-বিদ্যুৎ, বাতাস, পানি এবং পরমাণু জ্বালানী ফসিল জ্বালানীর বিকল্প হিসেবে ব্যাপকভাবে বিবেচিত হচ্ছে। কিন্তু সবচেয়ে সাশ্রয়ী ও দূষণমূক্ত জ্বালানী হিসেবে পরমাণু জ্বালানী অন্য সব জ্বালানীর চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় শতকরা ২০ ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে পরমাণু জ্বালানী থেকে। সম্প্রতি (গত ২০-২২ এপ্রিল) বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে , একবিংশ শতকে পারমাণবিক জ্বালানী শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন। এ বিষয়ে ২০০৫ সালে প্যারিসে প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ।
চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত একবিংশ শতকে পারমাণবিক জ্বালানী শীর্ষক এ আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বিশ্বের ৬৫ টি দেশের ৮০০'রও বেশি কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞ অংশ নেন। পরমাণু জ্বালানীর বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনার পর এ সম্মেলনের সমাপনী ইশতিহারে পরমাণু জ্বালানীকে পরিচ্ছন্ন বা দূষণমুক্ত, নির্ভরযোগ্য ও নিরাপদ জ্বালানী বলে অভিহিত করা হয়। উন্নয়নশীল দেশগুলোসহ সব দেশের জন্যই পরমাণু প্রযুক্তি ব্যবহার অগ্রাধিকার বা প্রাধান্যপ্রাপ্ত একটি বিষয়, এ জন্যে নিরাপত্তা বিধান করাও জরুরী বলে ঐ বিবৃতিতে বলা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী পরমাণু জ্বালানীর গুরুত্ব বা চাহিদা বৃদ্ধির অনেক কারণ রয়েছে। যেমন, পরমাণু জ্বালানী পরিচ্ছন্ন ও বাতাসকে দূষিত করে না। অন্যদিকে তেল, গ্যাস ও পেট্রলের মত জ্বালানীর ব্যবহার বা ফসিল জ্বালানীর ব্যাপক ব্যবহারের কারণে পরিবেশে মারাত্মক দূষণ দেখা দেয়ায় বিশ্বের সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এ ধরনের জ্বালানী ব্যবহার যথাসম্ভব কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে। বিশ্বে বর্তমানে ৪৪০ টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। এগুলো বন্ধ হয়ে গেলে বিশ্বের আবহাওয়ায় প্রতি বছর আরো ৬০ কোটি টন কার্বন যুক্ত হবে বলে গবেষণায় দেখা গেছে।
অন্যান্য জ্বালানীর তূলনায় পরমাণু জ্বালানী অনেক বেশি জ্বালানী তৈরি করতে সক্ষম, আর তাই দামী হওয়া সত্ত্বেও এ জ্বালানী অর্থনৈতিক দিক থেকে সাশ্রয়ী। বর্তমানে পরমাণু জ্বালানীর যে দাম রয়েছে তা দ্বিগুণ বাড়লেও বিদ্যুতের মূল্য মাত্র ২ থেকে ৪ শতাংশ বাড়বে। কিন্তু গ্যাসের মূল্য দ্বিগুণ বাড়লে গ্যাস-ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোর খরচ বেড়ে যাবে শতকরা ৬০ থেকে ৭০ ভাগ। কিন্তু সমস্যা হল, পরমাণু জ্বালানী অর্জনের পথে অনেক বাধা রয়েছে। পারমাণবিক জ্বালানী কেন্দ্র তৈরি করার জন্য যে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি দরকার তা কেবল কয়েকটি পশ্চিমা সরকারের হাতে রয়েছে। পশ্চিমারা এই উন্নত প্রযুক্তি অন্য কাউকে দিচ্ছে না এবং পারমাণবিক জ্বালানীর জন্য চুল্লী বা স্থাপনা নির্মাণের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ দাবী করে থাকে। তাই গরীব দেশগুলা পরমাণু প্রযুক্তির ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহী নয়।
বর্তমানে বিশ্বের পরমাণু বিদ্যুৎ-কেন্দ্রগুলোর মধ্যে ২০৪ টি রয়েছে রাশিয়াসহ ইউরোপ মহাদেশে। ১২২ টি রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায়। ১০৮টি পরমাণু বিদ্যুৎ-কেন্দ্র রয়েছে এশিয়ায় এবং আফ্রিকায় রয়েছে মাত্র দুটি পরমাণু বিদ্যুৎ-কেন্দ্র। তৃতীয় বিশ্বের পরমাণু বিদ্যুৎ-কেন্দ্রগুলো বিশ্বের পরমাণু বিদ্যুতের শতকরা মাত্র ৬ ভাগ উৎপাদন করে। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা বা আই এ ই এ'র দায়িত্ব হল এ সংস্থার সদস্য দেশগুলোকে পরমাণু জ্বালানীর শান্তিপূর্ণ ব্যবহারে কারিগরি ও প্রযুক্তিগতভাবে সহায়তা করা। কিন্তু সংস্থাটি এ পর্যন্ত এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কোনো সহায়তা দিতে পারে নি। বেইজিংয়ে একবিংশ শতকে পারমাণবিক জ্বালানী শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আই এ ই এ-তে নিযুক্ত ইরানের প্রতিনিধি বলেন, বর্তমানে অধিকাংশ দেশই মনে করে যে আই এ ই এ তার সদস্য দেশগুলোকে পরমাণু কর্মসূচী এগিয়ে নেয়ার কাজে সহযোগিতা করার দায়িত্ব থেকে অনেকাংশেই বিচ্যুত হয়েছে, অথচ আই এ ই এ'র মূল দায়িত্ব ও লক্ষ্য এটাই।
আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা বা আই এ ই এ বৃহৎ শক্তিগুলোর মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে পরমাণু জ্বালানীর শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের জন্য সচেষ্ট দেশগুলোর ওপর অন্যায় চাপ জোরদার করেছে। অথচ যেসব দেশ পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী তাদের পরমাণু অস্ত্রের বিস্তার রোধ করা ছিল এই সংস্থার অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। তাই বেইজিং সম্মেলনে আই এ ই এ'র রাজনীতিকরণ নিষিদ্ধ করা এবং এ সংস্থাটির নিরপেক্ষতা রক্ষার ওপর জোর দেয়া হয়েছে।
পরমাণু-বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর আরেকটি সমস্যা হল, এসব চুল্লীর জন্য প্রয়োজনীয় পরমাণু-জ্বালানী সংগ্রহ করা তাদের জন্য খুবই কঠিন ও ব্যয়বহুল। পরমাণু-জ্বালানী তৈরির প্রযুক্তিও কেবল কয়েকটি বৃহৎ শক্তির হাতে রয়েছে। তাই তারা এ জ্বালানী বিক্রির জন্য অযৌক্তিক ও মাত্রাতিরিক্ত মূল্য আদায় করে থাকে। এক্ষেত্রের রাজনৈতিক বিবেচনার আলোকে তারা পরমাণু জ্বালানী বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। তাই বেইজিংয়ে একবিংশ শতকে পারমাণবিক জ্বালানী শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ন্যায্যমূল্যে পরমাণু জ্বালানী সরবরাহের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানানো হয়। পরমাণু জ্বালানীর আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর আই এ ই এ'র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দাবীও জানানো হয় এ সম্মেলনের ঘোষণায়।
এদিকে ইরানের মত কোনো কোনো উন্নয়নশীল ও স্বাধীনচেতা দেশ নিজস্ব প্রচেষ্টায় পরমাণু জ্বালানী তৈরির মত অত্যাধুনিক প্রযুক্তি আয়ত্ত্ব করতে সক্ষম হয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলোর ব্যাপক চাপ, নিষেধাজ্ঞা ও বাধা উপেক্ষা করে ইরান পরমাণু জ্বালানীসহ পরমাণু স্থাপনা তৈরিতেও স্বনির্ভরতা অর্জন করেছে। বর্তমানে ইরান বুশাহর পরমাণু স্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানী নিজেই উৎপাদন করতে সক্ষম। ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার প্রযুক্তি আয়ত্ত্ব করায় ইরান আগামী দশ বছরের মধ্যে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণকারী দেশগুলোর তালিকায় যুক্ত হবে। ইরানের পরমাণু বিজ্ঞানীরা যে খুবই দক্ষ এবং তারা যে বিস্ময়কর ও দর্শনীয় সাফল্য অর্জন করেছেন তা বহুজাতিক পরমাণু সমিতির সভাপতি ব্রুনো পোলাদও স্বীকার করেছেন। ইরানের পরমাণু শক্তি সংস্থার উপপ্রধান ডক্টর সাঈদী একবিংশ শতকে পারমাণবিক জ্বালানী শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বলেছেন, চলতি বছরেই ইরানের পরমাণু বিদ্যুৎ চুল্লীতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজ শুরু হবে। পাশ্চাত্যের দেশগুলো ইসলামী আদর্শের পতাকাবাহী হবার কারণে ইরানকে পরমাণু প্রযুক্তির ব্যবহার থেকে বঞ্চিত করতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের নিষেধাজ্ঞা এক্ষেত্রেও ইরানকে স্বনির্ভরতা ও বিস্ময়কর বা অভাবিত সাফল্য এনে দিয়েছে।
ইরান ১৯৭৫ সালে পারমাণবিক চুল্লী নির্মাণের জন্য জার্মানীর সাথে চুক্তি করেছিল। কিন্তু ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লব হবার পর জার্মানী এই চুক্তি বাস্তবায়নের কাজ বন্ধ করে দেয়। এরপর বহু চড়াই উৎরাই শেষে ১৯৯৫ সালে রাশিয়া এ চুল্লীর কাজ শুরু করে। অবশ্য রাশিয়াও অনেক গড়িমসি বা টালবাহানার আশ্রয় নিয়ে এই চুল্লী নির্মাণের কাজ বিলম্বিত করে। অবশেষে চলতি বছরেই এ চুল্লীতে উৎপাদনের কাজ শুরু হবে বলে জানানো হয়।
একবিংশ শতকে পারমাণবিক জ্বালানী শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে পরমাণু বিদ্যুৎ নিয়েই বেশী আলোচনা হয়েছে। কিন্তু এ প্রযুক্তি কেবল বিদ্যুৎ উৎপাদনেই নয় রোগ নির্ণয়ে, কৃষি-খামারের কীটনাশক হিসেবে ও উন্নত বীজ উৎপাদনে এবং এমনকি শিল্প ও খনিজ সেক্টরেও পরমাণু প্রযুক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার রয়েছে। পারমাণবিক সাবমেরিন বা জাহাজের মত পরমাণু শক্তি ব্যবহার করে ভবিষ্যতে ট্রেন ও মটরগাড়ী চালানো সম্ভব হবে বলেও আশা করা হচ্ছে।
বেইজিংয়ে একবিংশ শতকে পারমাণবিক জ্বালানী শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠান পারমাণবিক জ্বালানীর ক্রমবর্ধমান গুরুত্বকেই তুলে ধরেছে। ২০০৮ সালে জ্বালানী তেলের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির পর বহু দেশ এই প্রযুক্তির দিকে আরো বেশী ঝুঁকে পড়ে। তাই গত এক বছরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য বিশ্বে অনেক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে পরমাণু প্রযুক্তির ওপর কয়েকটি পশ্চিমা দেশের একচেটিয়া কর্তৃত্বের অবসান ঘটেছে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে যে বিপুল অংকের অর্থ খরচ হয় তা কমানোর জন্য পরমাণু প্রযুক্তি সংক্রান্ত জ্ঞানকে সহজলভ্য করা ও এর স্থানীয়করণ এবং এ ব্যাপারে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সাথে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা বা আই এ ই এ'র সহযোগিতা জরুরী বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।