ডাকাতের হাতে আমার বাবার মৃত্যুর পর প্রথম যিনি অকুল পাথারে পড়লেন তিনি আমার মা । সবে পয়ত্রিশে পা দেওয়া এই গ্রাম্য মহিলার প্রতি পদক্ষেপে বিপদ আসতে লাগলো । বাবার রেখে যাওয়া ব্যাংক ঋণ মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে আমার মায়ের উপর যুক্ত হল । আগে যে মা আমাদের রাতে ঘুম পাড়িয়ে দিতে গিয়ে নিজেই সারাদিনের কর্মক্লান্ততায় চোখ বুজে ঘুমিয়ে পড়তেন , বাবার মৃত্যুর পর সেই মা সারারাত বারান্দায় পায়চারি করতেন । বারান্দায় এককোণে একটা ছোট শামিয়ানা টানানো থাকতো ,এখনো আছে । বাবা এই শামিয়ানার নিছে খাটের উপর বসে আমাদের সাথে সকালের খাবার খেতেন । মার সেদিকে নজর যেতেই তিনি হু হু করে কেঁদে উঠেন ।
আমার বাবা গ্রামের স্কুলের মাস্টার । সবার বড় মাস্টার । ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা বাবা কে এই নামে ডাকতো । আমি আর ছোট বোন টগর যে কত তাকে এই নামে ডেকেছি তার শেষ নেই । আমরা দু ভাইবোনে তার স্কুলে পড়তাম । সবার বড় মাষ্টার ডাক শুনে সত্যি ই আমরা বিভ্রান্তিতে পড়ে জেতাম । দুরান্ত থেকে একবার বাবার খালাত ভাই এসেছিল আমাদের বাসায় । আমি উঠানে মাটির লাঙ্গল নিয়ে খেলতে খেলতে অতিথির প্রশ্নের জবাবে বলেছিলাম যে এটা বড় মাস্টারের বাড়ি । উনুন থেকে মা হন্তদন্ত হয়ে বিড়াম্বনায় পড়ে গেল তার ভাসুর কে দেখে । আমার অনিচ্ছাকৃত ভুল সেদিন আমার মা এবং আমাকে লজ্জায় ফেলেছিল । আমি দৌড়ে পালিয়েছিলাম ।
মফস্বল থেকে সাত কিলোমিটার দূরে এই গ্রাম । চারদিকে সবুজ ধান খেত পরিবেষ্টিত এই গ্রামে সাবের মাস্টারকে চেনে না এমন কেউ নেই । অন্য দশ জন মানুষের চেয়ে অবস্থা সম্পন্ন এই মানুষটা সারা জীবন অন্য মানুষের জন্য কিছু করার চেষ্টা করে গেছেন। যেদিন মারা গেলেন সে দিন ও তিনি গ্রামের অন্য প্রান্তে বসবাসরত অতসী পিসীর মেয়ের বিয়ের জন্য নিজের বিয়ের আংটিটা হাত থেকে খুলে দিলেন । মা খুব রাগ করেছিলো । মা বলেছিল বিয়ের আংটি অন্য কে দিলে অমঙ্গল হয় । বাবা হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিল আমি মরে যাবার সময় গ্রামের সবাই আমাকে জমের কাছ থেকে কেড়ে নেবে দেখো । মা আর কিছু বলে নি শুধু বাবার পাতে আরেক চামচ ডাল তুলে দিয়েছিল । বাবার প্রিয় মুগ ডাল । বাবা তার শেষ খাওয়া কেমন খেয়েছিল তা আমার জানা নেই , আমার মনে শুধু মায়ের কথাগুলো বারবার ঝঙ্কার তুলছিল "বিয়ের আংটি অন্য কে দিলে অমঙ্গল হয়, বিয়ের আংটি অন্য কে দিলে অমঙ্গল হয় । "
বাবা তার খাওয়া শেষ করে আমার দাদির পাশে গেলেন । বাবা সাধারণত এই সময়টুকুই দাদিকে দেন । সারাদিনের কর্মময়তার বর্ণনা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দাদি শোনেন । কখনো বাবার আজগুবি কাজ শুনে প্রাণ খুলে হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন । আমার আশ্চর্য লাগতো আমার আম্মু যেভাবে আমাকে আর টগর কে আদর করেন , দাদি ও ঠিক বুকে টেনে , মাথায় হাত বুলিয়ে বাবাকে আদর করেন । মা বলতেন তোমার দাদির আহ্লাদের শেষ নেই , বুড়ো খোকাকে এখনো আদর করতে হচ্ছে । দাদি হেসে হেসে বলতেন ,তোমার মানিক আর টগর কি তোমার কাছে কখনো বুড়ো হবে ,আমার সাবের ও তেমনি এখনো ছোট আছে ।
আজ বাবা দাদির সাথে খুব কথা বললেন না । দাদির পানের ডালাটা এগিয়ে নিলেন । বাবা পান পেশাদার পানখোর না, শুধু দাদির পাশে যখন থাকেন তখন ই পান খান । বাইরে যখন কেউ বাবাকে পান খেতে দেন তখন দেখেছি পান খান না বলে বিনম্রভাবে এড়িয়ে যেতেন । আজ ছোট এক খিলি পান দাদির হাত থেকে নিয়ে নিজের মুখে পুরে বললেন , "আজ অতসীর মেয়ের বিয়েতে কিছুই দিতে পারলাম না মা । কোথায় যেন একটু খটকা লেগে আছে । তাছাড়া তোমার বউমা রাগ করছে আংটিটা দিলাম বলে । তুমি বল, ঠিক করেছি না । " দাদি হাসলেন , তিনি জানেন তার এই পাগল ছেলেটা আর যায় হোক কোন খারাপ কাজ করতে পারেনা । দাদি শুধু বললেন কোন এক সময় তাদের জন্য বড় কিছু করতে ।
অতসী পিসীর মেয়ের জন্য বাবা আর কিছু ই করতে পারেন নি । তখন রাত অনেক । মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে অনেক আগে ই । বাবা আজ আমাদের সাথে শোন নি । পাশের ঘরের সাথে টানা বারান্দায় শুয়ে ছিলেন একা একা । আমি আর টগর মায়ের সাথে ।দাদি তার ঘরে ।বাইরের দরোজায় খট খট শব্দ শুনে দাদি জেগে গেলেন । আম্মুর দরজার কড়া নেড়ে জানতে চেয়েছিলেন বাবা কোথায় । ততখনে বাবা জেগে আলো জ্বালিয়েছেন । প্রায় ই এই রকম আমাদের বাড়িতে মাঝরাতে কেউ না কেউ আসে । গ্রামের যে কোন ভালো বা মন্দ খবর প্রথমেই আমরা জানতে পারি । তেমনি ভেবে বাবা বাইরের দরোজায় গেলেন , পিছু পিছু আমার মা । আমি আর টগর দাদির সাথে । এর মাঝে আমি টগরের সাথে বাজি ধরে ফেলেছি ,খবর খারাপ হবে । দশ টাকার বাজি । সুতরাং খবর খারাপ হতেই হবে ।আমি মনে প্রাণে প্রার্থনা করছি খবর যেন খারাপ হয় ...............
............
(চলবে)