somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চট্টগ্রাম সেনা বিদ্রোহের ২৯ বছর পর ফিরে দেখা। পর্ব-৭

০৫ ই জুন, ২০১০ রাত ১০:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পর্ব-১ পর্ব-২ পর্ব-৩
পর্ব-৪
পর্ব-৫
পর্ব-৬

পূর্বাহ্ন, ২রা জুন, ১৯৮১।

রিয়ার ভিউ মিররে নিজেকে দেখতে চেষ্টা করছি। সামনে মানুষের ছবি ফুটে না উঠে, ক্যাবিন লাইটে দেখা যাচ্ছে একটা অতিকায় ব্যাংএর ছবি, চোখ দুটো এতই ফুলেছে। রং টকটকে লাল। আমার ১৯৭১ সালের কথা মনে পড়ে গেল। তখনো এ রোগটির প্রাদুর্ভাব দেখা গিয়েছিল।গায়ে প্রচন্ড জ্বর। জ্বরটা খারাপ লাগছেনা, বরং ভাল লাগছে, খুব হাল্কা হয়ে ঊড়ে যাচ্ছি উড়ে যাচ্ছি ভাব। কিন্তু চোখের যন্ত্রনায় কাতর। তার চেয়েও বড় যন্ত্রনা নতুন একটা হিসেব কষা।

বাজে ভোর চারটা। একটু আগেই কথা হয়েছে মেজর মাওলার সাথে। মেজর দোস্ত মোহাম্মদ সিকদারের কথা বলতেই উনি জোর গলায় বলে উঠলেন " মেজর দোস্ত আবার গাদ্দারী করল নাকি?" বুঝতে না পেরে আমি চুপ করে থাকলাম। মেজর মাওলা জানালেন যে মেজর দোস্ত মোহাম্মদ কচুক্ষেত কমিশন, (2nd SS এর অফিসার), মুক্তি যোদ্ধা, প্রত্যাগত নয়।

অনেকক্ষন চিন্তা করে কোন কুল কিনারা না পেয়ে আমি রাস্তার দিকে মনোনিবেশ করলাম। এক পাশে ঘন জংগল আরেক পাশে ঝোপ ঝাড়ের পরেই সরু নালা। তার পরেই ভারত। ভাবতে লাগলাম " আচ্ছা, মেজর ইয়াজদানী যখন আমাদের হেফাজতে আসেন তখন মুক্তি তারঁ কাছ থেকে কতদুর ছিল? পঞ্চাশ ফুট? ২৫? ১৫?

সকাল এগারোটা পয়তাল্লিশ। উচুঁ নীচু পাহাড় ঝোপ ঝাড় আর জঙ্গলে ভরা এলাকায় আমাদের VHF সেটগুলো ভাল যোগাযোগ রক্ষা করতে পারছেনা। আমার মূল সেনাদলের সাথে তো দূরে থাক, মেজর মাওলার সাথেই প্রায়ই যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে পড়ছে। আমাদের রাতের খাবার, সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার কিছুই আসেনি। ৩০ তারিখ থেকে একবারো চোখের পাতা মিনিট খানেকের জন্যেও বন্ধ করতে পারিনি। অধিনস্ত সৈন্যেদের অবস্থা আরো খারাপ। আমি ব্রিগেড সদর থেকে তাদের সাথে যখন যোগ দিয়েছি তখন তারা সবে ফেনী নদী তীরের প্রতিরক্ষা অবস্থান ত্যাগ করেছে।
কারু সাথে কোন যোগাযোগ করতে না পেরে একক সিদ্ধান্তে ২ ঘন্টার বিরতি দিলাম সবাইকে। কিন্তু পেটে প্রচন্ড খিদে নিয়ে সবাই ইতস্ততঃ হাঁটা চলা করতে লাগলো।

কি করা যায়?


হঠাৎ মনে পড়ে গেল গাড়িতে টহল দেবার সময় রাস্তায় পাহাড়ের মত উচুঁ করে স্তুপ করা অনেক কাঠাঁল দেখেছি। আমি আমার রানার ও অপারেটরকে সংগে করে জীপ নিয়ে বের হয়ে পড়লাম। তিন চারটি পরিত্যাক্ত কাঠাঁল ডিবি পার হয়ার পর একটি ডিবির পাশে বিরস বদনে একজনকে বসে থাকতে দেখলাম। সে বল্ল যে ৩০ তারিখ থেকে রামগড়ের কাঠাঁল বাইরে পাঠানো যাচ্ছে না। পরিবহনের কোন গাড়ি নেই। আমি অগোচরে আমার ওয়ালেট বের করে টাকা গুনলাম-সাকুল্যে সত্তুর টাকা। বললাম তার ডিবিটা আমাকে কত হ'লে দেবে। সে একশো টাকা চাইলো। দামাদামী করে সত্তুর টাকায় এক পাহাড় কাঠাঁল কিনে ফেললাম। Volvo আনিয়ে সেগুলো আমার উপদলের বিশ্রামের স্থানে নিয়ে গেলাম।

চার ভাগের একভাগ পাহাড় দিয়ে ১০০+ লোক রাতের খাবার, সকালের নাস্তা আর দুপুরের খাবার খেলাম, এক বসায়, পেট পুরে।

খিদে মিটতেই চোখের ব্যাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। মেডিক্যাল এসিস্টেন্ট জ্বর মেপে তাপমান দেখতে গিয়ে বিষম খেল। ঝেড়ে আবার মাপলো। তারপর ঘোষনা করলো আমাকে বিশ্রামে যেতেই হবে আর যে কোনভাবে মাথায় পানি ঢালতে হবে, কারন আমার জ্বর ১০৫.৮। যেহেতু আমার বেঁধে দেয়া বিশ্রামের আরো আধ ঘন্টা বাকী , তাই আমি পাশের স্কুলের ক্লাস রুমে একটি বেঞ্চির ওপর শুলাম এবং জ্ঞান হারালাম।

একটি ঝরনার পাশে আমি আর রফিক বসা। রফিক বলছে "দোস্ত, ওরা আমাকে ঝুলিয়ে দেবে। আবার একটু দ্যাখনা হাতটা। কুল কুল শব্দে ঝরনা বয়ে চলছে। আমরা হাটহাজারীর বন জংগলে ভরা একটি পাহাড়ের নীচে বসে আছি। রফিক গাওয়া শুরু করলোঃ

Chiquitita, tell me what's wrong
You're enchained by your own sorrow
In your eyes there is no hope for tomorrow
................



সবকিছু মিলিয়ে গেল এক সময়, শুধু ঝরনার শব্দ ছাড়া। ধীরে ধীরে চোখ মেলে দেখি আমার উপদল সুবেদার আমার মাথায় পানি ঢালছে, পাশে মেডিক্যাল এসিস্ট্যান্ট, অদুরে রানার ও অপারেটর। লাফ দিয়ে উঠে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি বিরতির সময় শেষ হবার আর মিনিট পাঁচেক বাকি। ঊপদল সুবেদারকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে বেরিয়ে এলাম। এক জায়গায় একটি জটলা। আমার উপদলের প্রায় সবাই সেখানে। আমি কাছে যেতে না যেতেই সবাই ছত্র ভংগ হয়ে পড়লো।

পাঁচ মিনিটেই আবার টহল শুরু করলাম। স্বাভাবিক সময়ে যেটা করা আমার স্বভাব বিরুদ্ধ, আমি সেটাই কলাম। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম জটলার কারন। ইতস্তত করে সে জবাব দিল "স্যার জেনারেল মঞ্জুরকে সেনা প্রধানের আদেশে মেরে ফেলা হয়েছে।" আমি চুপ মেরে গেলাম। যেটুকু বলেছে সে টুকুর তার প্রাণ যাবার জন্যে যথেষ্ঠ।

এবার আর কোন সন্দেহ রইলো না আমার বন্ধু রফিকের ভাগ্যে কি আছে। অনেকক্ষণ forward-rewind করে গানটি ছাড়লাম । Beatles এর I wanna hold your hand এর পরই এ গানটি ছিল রফিকের সবচেয়ে প্রিয়ঃ
Chiquitita, tell me the truth
I'm a shoulder you can cry on
Your best friend, I'm the one you must rely on
You were always sure of yourself
Now I see you've broken a feather
I hope we can patch it up together

Chiquitita, you and I know
How the heartaches come and they go and the scars they're leaving
You'll be dancing once again and the pain will end
You will have no time for grieving
Chiquitita, you and I cry
But the sun is still in the sky and shining above you
Let me hear you sing once more like you did before
Sing a new song, Chiquitita
Try once more like you did before
Sing a new song, Chiquitita

So the walls came tumbling down
And your love's a blown out candle
All is gone and it seems too hard to handle
Chiquitita, tell me the truth
There is no way you can deny it
I see that you're oh so sad, so quiet

Chiquitita, you and I know
How the heartaches come and they go and the scars they're leaving
You'll be dancing once again and the pain will end
You will have no time for grieving
Chiquitita, you and I cry
But the sun is still in the sky and shining above you
Let me hear you sing once more like you did before
Sing a new song, Chiquitita
Try once more like you did before
Sing a new song, Chiquitita
Try once more like you did before
Sing a new song, Chiquitita ...

স্বপ্নটিও rewind হয়ে বার বার চেতনাকে আচ্ছন্ন করতে থাকলো

-চলবে।

(আগামীকাল কোন পর্ব বের হবে না অনিবার্য কারনে।)
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুন, ২০১০ রাত ১০:৫৫
২০টি মন্তব্য ২০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×