পর্ব-১
(ফেইসবুক হরনের প্রচন্ড ডামাডোলে আমার এই পোষ্ট কতখানি যথাযথ সে ব্যাপারে যথেষ্ঠ সন্দিহান থেকেও----- ছাড়লাম- অনেক আগেই দিনের ঘটনা দিনে প্রকাশ করার ইচ্ছে থেকে।)
৩০ শে মে, ১৯৮১।
সকাল দশটায় ছোট ভায়ের প্রচন্ড ধাক্কায় ঘুম ভাংগলো। বাসার সবাই আমার খাটের চার পাশে। প্রেসিডেন্ট জিয়াকে চিটাগাং এ মেরে ফেলা হয়েছে- ছোট ভাই ঘোষনা করলো। লাফ দিয়ে করে উঠে পড়লাম। মাথা ভোঁ ভোঁ করে ঊঠলো
- একসাথে অনেক স্মৃতি ভীড় করলো- ১৯৭৫এ ডিসিএএস থাকা অবস্থায় আমাদের কলেজ পরিদর্শন যেখানে আমাদের সিনিয়র ব্যাচ অনুপস্থি্ত থাকাতে আমারাই (ক্লাস ইলেভেন-১৯৭৫) ছিলাম জেষ্ঠতম, আমাদের সাথে তাঁর মধ্যাহ্ন ভোজ, ভোজ শেষে ডাইনিং হলের সামনে আমাদের সাথে তার গ্রুপ ছবি, তাঁর এডিসি ক্যাপ্টেন জিল্লুর (পরে ব্রিগেডিয়ার, প্রয়াত), আমাদের ড্রিল প্রশিক্ষক হাবিলদারের সাথে তাঁর আন্তরিক কথোপকথন........... .....................................................যশোর সেনানিবাসে সেকেন্ড লেফটেনেন্ট থাকা অবস্থায় শুধু মাত্র তাকে বিব্রত করতে আমার প্রশ্ন করাঃ Sir, just the other day you came back from a visit from India, would you please tell us what all good qualities you have marked among Indians (স্যার, আপনি মাত্র ভারত সফর করে এলেন, ভারতীয়দের মধ্যে কি কি ভাল গুণ লক্ষ্য করেছেন)? আমার দিকে অনেকক্ষন(আমার মনে হয়েছিল এক যুগ, আসলে বোধ হয় পনেরো সেকেন্ড) এক দৃষ্টে (যদি ভাষায় প্রকাশ করতে পারতাম কী ভয়াবহ, কী অপ্রাকৃত সে দৃষ্টি)) তাকিয়ে থেকে উনি স্মিত হেসে, অতি সপ্রতিভ উত্তর দিলেন "They have patriotism, we don't have (ওদের দেশপ্রেম আছে আমাদের নেই)" ....................,....................................................................................................... "ভারতের বিরুদ্ধে যদি যুদ্ধেই যেতে হয় তা'লে আমাদের সেনাবাহিনীর একমাত্র ঊপায়- অনিয়মিত যুদ্ধ (unconventional warfare-1980)" সেটা ছিল তাঁরই মস্তিষ্ক প্রসুত- এবং সে যুদ্ধের প্রথম এবং শেষ প্রশিক্ষনের সময় আমাদের সেনাদলে তার পরিদর্শন এবং তাঁর সামনে আমাদের কামানবাহী ভেলার খরস্রোতা গোমোতীতে ঢুবে যাওয়া ............................... ................................মাসেক পরেই ৪৪ পদাতিক ব্রিগেড কমান্ড পোষ্টে তার সাথে লালমাই পাহাড়ের খরগোসের মাংস দিয়ে নৈশ ভোজন, আমাদের প্রশিক্ষণে তাঁর ক্যাবিনেটের দুই সদস্যকে সারা রাতের জন্যে রেখে যাওয়া কটাক্ষ করে "আপনারা (মন্ত্রীদ্বয়) তো মনে করেন আর্মিরা হারাম খায়..............." .................. ....................................................২৫ শে মার্চ, ১৯৮১ র রাতে তাঁর সাথে মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের অনেক বিষয়ে বিতন্ডা (ততদিনে জেনে গেছি শাহ আজিজ ছাড়া আর কি কি বিষয়ে তাঁর সাথে মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের তর্ক হয়েছিল সেদিন)............... ....................................................................................................
হাত মুখ ধুতে ধুতেই স্থির করলাম এ অভাবনীয় পরিস্থিতিতে আমার কি করতে হবে। প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা/কর্মচারীদের ছুটি এ ধরনের পরিস্থিতিতে আপনা আপনি বাতিল হয়ে যায় (মন্ত্রীদের যায় কিনা সে ব্যাপারে আমি যথেষ্ঠ সন্দিহান-সোহেল তাজ বিডিআর হত্যা কান্ডের সময় ছুটিতে ছিলেন, পুরো ছুটি কাটিয়ে ফিরেছিলেন)।
ড্রুইংরুমে টিভি চলছিল। বিচারপতি সাত্তার শ্লেষ্মা জড়িত, কাঁপা কাঁপা গলায় বলে চলেছেন ".......একদল দূষ্কৃতকারী.....................যারা যারা আগামী পহেলা জুন সকাল ৬টার মধ্যে আত্মসমর্পন করবে তাদেরকে সাধারন ক্ষমা .................. ।
লাইন না পেয়ে সাড়ে দশটার আগেই ফোনে যোগাযোগ করলাম সেনাসদরে । উত্তর এল যে আমি সেনাসদরেও যোগ দিতে পারি আর ইচ্ছে করলে ময়নামতিতে চলে যেতে পারি।
আমি গুলিস্তান-ফুলবাড়িয়া চলে গেলাম। আন্তঃ জেলা কোন বাস না পেয়ে ওখান থেকে গেলাম কমলাপুর, দুপরের কোন ট্রেন যদি ধরতে পারি, পুরো প্লাটফর্ম খা খা করছে। ঈদের দিনেও কমলাপুর এত ফাঁকা থাকেনা। এমন কি একটা ফকিরও নেই। টিকেট কাঊন্টারে কাঊকে না পেয়ে স্টেশন মাস্টারের অফিসে ঢুকলাম। একটা রেডিওর চারপাশে কয়েকজন জড়ো হয়ে কি যেন শুনছে। আমি আমার পরিচয় দিয়ে জানতে চাইলাম ট্রেনের খবর। মাস্টার জানালেন চিটাগাংগামী সব ট্রেন যাত্রা বাতিল হয়েছে। রাত ন'টায় নোয়াখালী এক্সপ্রেসে আমি কুমিল্লা যেতে পারি। টিকেট কেটে বাসায় ফিরে এলাম। আবার চেষ্টা করলাম কুমিল্লায় কথা বলতে, না পেরে সেনাসদরে ফোন করে জানালাম আমার খবর। আমাকে জানানো হ'ল যে ওয়্যারলেস বার্তার মাধ্যমে আমার ডিভিশন সদরে (৩৩ পদাতিক ডিভিশন) জানিয়ে দেয়া হবে আমার খবর।
বাসায় রান্না চড়েনি। ক্ষিদেও নেই। আমি ৩৫/এ, ইন্দিরা রোডের(এখন ধানসিঁড়ি এপার্টমেন্টস) সেই বাসার ৯টি কুল গাছের একটির নীচে বসলাম, একা--জিয়ার প্রতি কোন বিশেষ দুর্বলতা আমার ছিল না, কিন্তু গলা আমার ধরে এল, চোখ বাস্পাচ্ছন্ন হয়ে গেল। নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলাম আমি।
সেদিন ছিল সম্ভবতঃ এইচ এস সি র শেষ পরীক্ষা। আমার মনে আছে এই জন্যে যে আমার স্ত্রী (তখনো নয়) সে পরীক্ষা দিচ্ছিল। তো, পনেরো দিনের ছুটিতে এসে তার সাথে দেখা না করেই আমি আবার ফিরতি পথে।
সারা ঢাকার রাস্তা খালি । আমি সাত মিনিটে ইন্দিরা রোড থেকে কমলাপুর পৌঁছুলাম।
নোয়াখালী এক্সপ্রেসের আমার পুরো বগীর যাত্রী ছিলাম শুধু আমি। টংগীতে আমাকে আমার কামরার এটেন্ডেন্ট জানায় যে সে ট্রেনে মোট যাত্রী সংখ্যা সে রাতে সাকুল্যে ৯ জন।
কাটায় কাটায় রাত ন'টায় অনিশ্চিত গন্তব্যে যাত্রা করলাম। কোন উত্তেজনা নেই, কোন উদ্দিপনা নেই, নেই কোন প্রনোদন......নিজেরা নিজেরা মারামারি করতে চলেছি....বুক ভরা হাহাকারের সাথে বেরিয়ে এল দীর্ঘশ্বাস........... ।
-চলবে।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুন, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:৪৭