১
মসৃণ রেসমের মত কাপড়ের পাড় জুড়ে তারার মত স্বর্ণখচিত কারুকাজ। আঁচলের ভাঁজে ভাঁজে গোল গোল ফুলের মাঝে দামি স্টোন বসানো!..... কত হতে পারে এই শাড়িটির দাম?.........দুই লাখ, তিন লাখ, হয়ত আরো বেশি!
এই শাড়ির চকচকা এতই প্রকট যে কিছুটা অচকচকে মেয়েকেও এতে পরীর মতন দেখাবে। অনেকটা রাতের সাথে মিল আছে এর। রাতের অন্ধকারে যেমন সব মেয়েই সমান সুন্দরী! এই শাড়ি অঙ্গে জড়ালেও তাই!
এই যা কি আবল তাবল ভাবছি! চার দেয়ালের ভেতর থাকতে থাকতে হয়ত মাথার স্ক্রুর মাঝে কিছুটা ময়লা জমেছে। ডার্টি ডার্টি ময়লা! লাল ডার্টি, নীল ডার্টি, কালো ডার্টি, হলুদ ডার্টি! আরো কত রকমের ডার্টি। এই শাড়িটা ইয়োলো কালারের ডার্টি!
ইসস!! তাহেরের এত শখ করে কেনা শাড়িকে ডার্টি বলছি! সে জানলে না জানি কি ভাববে?
ঘোড়ার ডিম! সে কিছুই ভাববে না। সে ভাবতে জানে না! সে শুধু জানে হাসতে, কাঁদতে, আর রাগ করতে। গলা টিপে ধরে অস্ফুট গোঙ্গানিতে 'ভালোবাসি' শুনে সে ভাবে মেয়েটি আমায় কত ভালোবাসে!
আমার নাম তন্দ্রা। তাহের আমার স্বামী! বছর খানেক হবে আমাদের বিয়ে হয়েছে! ও আমাকে অনেক ভালোবাসে। অনেক অনেক! এত ভালো হয়ত কোন স্বামী তার স্ত্রীকে বাসে না!
তাই আমি কখনো তাকে 'ভালোবাসি না' বললে সে রাগ করে। সে বেশ ভালোভাবে 'রাগ' নামক অনুভূতিটা ধারণ করতে পারে! তার চোখের পিউপিলের চারিদিকে কনজাংটিভা রক্তের মত লাল হয়ে যায়! মনে হয় কেউ যেন এক ব্যাগ রক্ত বা লাল রঙ এনে ঢেলে দিয়েছে সেখানে! এটা হল লাল ডার্টি!
আজ আমাদের বিয়ের প্রথম বর্ষপূর্তি! এই উপলক্ষ্যে শাড়িটা তাহের আমাকে উপহার দিয়েছে! এক সময় ভাবতাম এমন দুস্পাপ্য পুঁজিবাদীতার উপঢৌকনেই হয়ত সুখের পরশ পাথরটি লুকিয়ে আছে! কিন্তু হৃদয়ের খুব গভীরে আমি পড়ে দেখেছি- অমসৃণ জরজেট গায়ে জড়িয়েও যদি সেটিস্ফেকশানের ঢেকুর তোলা যায় তবে তার চেয়ে বেশি তৃপ্তির আর কিছু নেই। কানের ভাঁজে কয়েকটি গোলাপ ক্লিপ দিয়ে সেটে দিয়েও সুখী হওয়া যায়! কিন্তু আমার বাবা মা ভাবতো অন্যরকম! তারা ভাবতো অর্থের মাঝেই হয়ত জীবনের সুনীল আকাশ মেলা। তাই তারা আমার জন্য এক টুকুরো স্বচ্ছ অনুভুতি না খুঁজে এক বাক্স অর্থ খুঁজেছে! সেই অর্থের সাথেই আমার বিয়ে, এক বছরের সংসার! আর আমার আকাশটি চুপটি করে হারিয়ে গেছে এই ইট পাথরের অনুভূতিহীন শক্ত দেয়ালের পাষণ্ড নির্দয় ছাদের সাদা ক্যানভাসের উপরে!
আমি বহুদিন আকাশ দেখি না! এখনো আকাশের কোণায় শুকতারাটা আগের মত করে ওঠে কিনা জানি না। তাহের আমার আকাশ দেখা পছন্দ করে না! তার ধারণা আকাশের সাথে আমার সখ্যতা গড়ে উঠবে আর আমি তাকে ভুলে যাবো। তাকে আর ভালোবাসবো না। আকাশের সাথে পরকিয়ার সম্পর্ক গড়ে তুলবো! তাই সে আমাকে বন্দি করে রেখেছে তার চার দেয়ালের নিজেস্ব কারাগারে! অবশ্য চার দেয়ালও না। আমাদের বাড়িতে অনেকগুলো দেয়াল! অনেকগুলো রুম। দু তলা বিশাল ভবন নিয়ে আমরা থাকি। শুধু আমি ,তাহের আর দু জন কাজের লোক। একজন কাজ করে দিয়ে দিন থাকতেই চলে যায়। আরেক জন থাকে সার্বক্ষণিক পাহাড়ায় আমি যেন জানালার সূক্ষ্ম ছিদ্র দিয়েও আকাশ দেখতে না পারি!
মাঝে মাঝে তাহের আমাকে জিজ্ঞাসা করে ''আচ্ছা তন্দ্রা তুমি আমাকে কতটুকু ভালোবাসো? পঞ্চাশ পারসেন্ট, আশি পারসেন্ট, একশ পারসেন্ট? আমি দুই হাত একশ আশি ডিগ্রী এঙ্গেলে সোজা করে বলি একশ পারসেন্ট। সে খুশিতে ভ্রু নাচিয়ে বলে ,'দেখেছো তোমার ভালোবাসা আমি জয় করে নিয়েছি! বিয়ের আগে খুব তো বলেছিলে তুমি আমাকে কোন দিন ভালোবাসবে না। আমাকে ছেড়ে বিয়ে করতে চেয়েছিলে তোমার এক ক্লাসমেটকে। দেখেছো সে দিন তোমাকে জোড় করে তুলে এনে কত ভালো করেছি?''
তার এ সব কথায় আমার পুরনো স্মৃতিগুলো চাঙ্গা হয়ে ওঠে! সেই কলেজের দিন! আমার গল্প কবিতার বন্ধু বান্ধবেরা! উচ্ছ্বল আড্ডা, একসাথে কাব্যের আকাশে মনের ঘুড়ি উড়িয়ে দেয়া, স্বাধীন পাখি হবার স্বপ্নে বিভোর বিকেল! সেই দিনগুলোই ছিল আলাদা! অথবা ওরা মানুষই ছিল অন্যরকম। সংকীর্ণ চেতনার অনেক ঊর্ধ্বে! সুশিক্ষায় শিক্ষিত। তাদের সাথে কি করে সকাল পার হয়ে বিকালে গড়াত আমি টেরই পেতাম না! একটা সুন্দর ক্যারিয়ার, তারপরে সুন্দর মানবী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে গোল টেবিলে তপ্ত ডিসকাশন, তারপর বইয়ের পাতায় মুখগুজে মধ্যরাত, হঠাৎ ঘড়ি দেখে আঁতকে ওঠা ,'ওহ কাল তো খুব সকালে আমার পরীক্ষা!'' এভাবেই পার হত আমাদের দিন। কখনো ভাবি নি এত বড় ঝড় এসে লন্ড ভন্ড করে দিবে সাজানো সব স্বপ্ন! তাহের জোর করে আমাকে বিয়ে করে বন্দি করে নেবে পরাধীনতার খাঁচায়। এতটুকু মূল্য দেবে না আমার ইচ্ছা অনিচ্ছার! বোবাপুতুলের মত আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখবো আমার সব স্বপ্ন আশা আকাঙ্ক্ষার আহত হয়ে নিশ্চুপে রক্তক্ষরণ! অতপর মৃত্যু!
মাথা ধরে আসে আমার! আমার মাঝে ঘুমিয়ে পড়া তন্দ্রাচ্ছন্ন মেয়েটি হঠাৎ জেগে ওঠে! আমি দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলি, 'জানোয়ার আমি তোকে কোন দিন ভালোবাসিনি। কোন দিন না! কোন দিন বাসবোও না, কোন দিন বাসব না!''তাহেরের মুখ বিকৃত হয়ে আসে। ভয়াবহ কোন জীব যেন মানুষের অবয়ব কেটে বের হয়! ''তুই আমাকে কোন দিন ভালোবাসবি না? একটা সন্তান হয়ে যাক তারপর দেখবো ভালো না বেসে কোথায় যাস।''
২
তাহের জোর করে পেতে চায় তার অধরার ভালোবাসা! তন্দ্রার শরীর ভেঙে যেন চুরমার হয়ে যেতে চায়। তাহের শক্ত করে বুকে চেপে ধরে তন্দ্রাকে। অসহায় নিথর দেহ থেকে টুপ টুপ করে ঝোরে পড়ে গোঙানি। গাল বেয়ে নেমে আসে অশ্রু! সে অশ্রু আবদ্ধ ছাঁদের দিকে তাকিয়ে বিধাতাকে খুঁজে ফেরে! কিন্তু কোথাও দেখা যায় না এতটুকু আশার আলো!
তাহেরের নিশ্বাসের সাথে ফুলে ওঠা বুকের দিকে তাকিয়ে তন্দ্রা ভাবে যদি ছুরি দিয়ে এই বুক চিড়ে একটা দরজা বানাতে পারতাম! তবে সেই দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়ে আমি মুক্ত আকাশে ওড়াতাম আমার স্বাধীনতার কপোত! কিন্তু সে স্বপ্ন, স্বপ্নই থেকে যায়। আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ে তার নিস্তেজ দেহ।
সকালে উঠে তন্দ্রা তাহেরকে বোঝায় -''শোনো আমি তোমাকে ভালোবাসি! অনেক অনেক! যদি আমাদের ঘরে শিশু আসে তবে তোমার ভালোবাসা সে ভাগ করে নেবে। তাই কি হয়? বলো!''তাহের কিছুক্ষণ ভেবে বলে ,'তাই তো! নাহ থাক! সন্তানের দরকার নেই! কিন্তু তুমি আবার আমার সাথে বিট্রে করবা না তো? আবার বলবা না তো আমাকে ভালোবাসো না?'তন্দ্রা তাহেরের মাথার দিব্যি কেটে বলে,'' কোন দিন না! ওটা তো রাগের রাগের মাথায় বলেছি! আমি তোমাকে কত্ত ভালোবাসি!''তাহের আহ্লাদ করে বলে ,''আচ্ছা ঠিক আছে! তাহলে আজ রাতে আমাকে ওই শাড়িটা পরে দেখাবা। আর খুব সুন্দর করে সাজবা।'' তন্দ্রা মাথা ঝাঁকিয়ে তাহেরের সব কথা মেনে নেয়। ছলনাটুকু ধরার মত ভাবনা তাহেরের মাঝে আসে না। কারণ সে ভাবতে জানে না! সে শুধু জানে জোর করে ভোগ!
৩
তাহেরের ফোন বেজে ওঠে। তার বন্ধু নিলয় ফোন দিয়েছে! তাহেরের এই বন্ধুটি মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতে আসে। আমি ঢের বুঝতে পারি ছেলেটা আমাকে পছন্দ করে! আচ্ছা আমি কি ছেলেকে ঢাল হিসেবে ইউজ করতে পারি না? আজকাল তো প্রয়োজনে মানুষ কত অনাচারই করে। আমিও না হয় একটু করলাম। ক্ষতি কি?
প্রথমে তাকে ভালোবাসার ছলনায় ভোলাবো। তারপর পালিয়ে যাব ওর হাত ধরে এই নিস্তব্ধ শ্মশান থেকে!
তখন পত্রিকাগুলো নিশ্চয়ই খুব মজার একটা নিউজ পাবে কাটতি বাড়ানোর জন্য। তারা ফলাও করে প্রচার করবে ,''নারী যখন প্রতারক! স্বামীকে ছেড়ে প্রেমিকের হাত ধরে পলায়ন!'' অথবা ,''আরেকটি পরকিয়ার বলি-সুন্দর সাজানো সংসার!'' কেউ খতিয়ে দেখবে না প্রতিটা ছলনার গভীরে কত কষ্ট লুকিয়ে থাকে! বাহ্যিকতা দেখার মত চোখ জগতের আছে, কিন্তু অন্তর অতল গহ্বরে বহমান মহা সমুদ্র দেখার মত চোখ জগতের নেই! এ জগত হাতির বিশালত্ব দেখে। তার অন্তঃসার শুন্য ভাবনার জমিন দেখে না!
সন্ধ্যায় তাহের আসে! কিন্তু একা না! তাকে ধরে নিয়ে আসে এলাকার লোকজন! বাড়ি ফেরার পথে তার গাড়ি এক্সিডেন্ট করেছে! রক্তে তার জামা কাপড় ভিজে উঠেছে! তাকে বেড রুমে শুইয়ে দিয়ে তার নিথর শরীর আমার হাতে সঁপে দিয়ে সবাই চলে যায়! আমি তাহেরের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বলি,''দেখেছো তাহের! মানুষ কত অসহায়! কত তুচ্ছ তার জীবন! কি পেয়েছো তুমি বলো আমার জীবন নষ্ট করে? ......অর্থ ক্ষমতার দাপটে তুমি মানুষ কিনে নাও! পেরেছো কি একটা মন কিনতে যে তোমাকে সব উজার করে দিয়ে ভালোবাসবে? তোমার এই অসহায় মুহূর্তে একটু সেবা করবে? পারো নি! বরং কোমল হৃদয় হত্যা করে জন্ম দিয়েছো আমার মত কালনাগিনীর! যে এখন নারী হবার স্বপ্নে বিভোর!''
৪
আমি খুব সুন্দর করে সাজি। আজ সাঁজতে আমার খুব ভালো লাগছে! হলুদ শাড়ি গায়ে জড়িয়ে কপালেতে বড় করে দেই লাল টিপ! যদি আজকেই হয় সেই মহেন্দ্রক্ষণ! যেই ক্ষণে আমি নারী হবো! তবে আমিও ভালোবাসবো শিশুকে, ফুলকে ,পাখিকে! জগতের সব সুন্দরকে! যদি আজ রাতে তাহের মারা যায়? তবে আমিও হবো একজন মানবী, একজন পরিপূর্ণ নারী!
আমি সাঁজগোজ করে এগিয়ে যাই দরজার দিকে। এমন সময় তাহেরের গোঙানি। ব্যথায় কাতরানো আর্তনাদ! ''আচ্ছা এভাবে একজন অসুস্থ মানুষকে ফেলে যাওয়া উচিত হবে কি? এটা ঠিক এই ঘরের চৌকাঠে আমি নারী নই। আমি কষ্টে জমাট বাঁধা বরফ খন্ড! তবুও! মনুষ্যত্ব বলেও তো কথা আছে নাকি! অতঃপর বাধ্য হয়ে পিছু হঠলাম! এই রাতটুকুই তো! না হয় একটু সেবা শুশ্রূষা দিয়ে তাকে ভালো করে তুলি। সকালে হয়ত সে নিজেই আমায় মুক্ত করে দেবে। আমাকে চলে যেতে দেবে আমার মত!
সকালের দিকে তাহেরের রক্তরক্ষণ বন্ধ হয়ে যায়। তার জ্ঞান ফিরে আসে। আমি তাকে বলি ,''তাহের এবার আমি যাই। আমি সেবা করে তোমাকে সুস্থ করে তুলেছি! বিনিময়ে তুমি আমাকে মুক্ত করে আমাকে একটু শ্বাস নিতে দাও?''
আমার মনে দৃঢ় বিশ্বাস তাহের আমার মহত্বে খুশি হয়ে আমাকে ছেড়ে দেবে! কিন্তু না! তাহের মুখ চোখ বাঁকিয়ে বলে ,'' কি তুমি চলে যাবে আমাকে ছেড়ে! আমি তবে কি নিয়ে বাঁচবো!'' তাহের তার দুর্বল শরীর নিয়ে কেঁপে কেঁপে উঠে গিয়ে কম্পমান হাত দিয়ে বাড়ির সামনের দরজায় তালা লাগিয়ে দেয়। তারপর সেখানে অবশ হয়ে শুয়ে পড়ে। সে জানে বাড়ির সামনের দিকেই আছে অদূরে পালিয়ে যাবার রাস্তা!
তবে এবার আমি কিছুতেই থামব না। আজ আমি যে করেই হোক পালিয়ে যাবোই! যে করেই হোক আমি আজ নারী হবো! আমি বাড়ির পেছনের দরজার দিকে ছুটে যাই! জানি এ দিকে দিয়ে কোন রাস্তা নেই! আছে শুধু সমুদ্র! হয়তবা তলিয়ে যাবো! তবুও আমি ছুটি!...... ছুটতেই থাকি। আস্তে আস্তে পানি বাড়তে থাকে! চলে আসে গলা পর্যন্ত! তবুও মনে আশা কোন নাবিক নিশ্চয়ই জাহাজ নিয়ে এসে আমাকে তার জাহাজে তুলে নেবে! তারপর সেই শুভ্র সকালে পাখিদের কিচির মিচিরে আমি নারী হবো! পরিপূর্ণ নারী!
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুলাই, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:১৬