আচ্ছা বলতে পারেন, বাংলাদেশের বেশিরভাগ ছেলে বা মেয়ে ঠিক কিভাবে বড় হচ্ছে?
ছেলে বা মেয়েটার বয়স যখন ৪-৫ বছর, তখনই প্রতিদিন সন্ধ্যায় জোর করে তাকে পড়তে বসানো হয়। পড়া না পারলে পিটানো হয় কিংবা বকা হয়। কারণ তাকে "ভালো স্কুলে চান্স পেতে হবে"। ভালো স্কুলে চান্স না পেলে পড়াশুনার কোন অর্থ নাই।
ধরি, ছেলে বা মেয়েটা ভালো স্কুলে চান্স পেয়ে গেলো। তাহলেই কী হ্যাপি এন্ডিং? না। তখন শুরু হয় নতুন যুদ্ধ । ক্লাসে ফার্স্ট হতে হবে, নাইলে জীবন শেষ।
সেদিন পাশের বাসার ছোট্ট নীলার কান্নার আওয়াজ শুনলাম। ড্রয়িং পরীক্ষায় ৫ নাম্বার কম পেয়েছে বলে তার মা তাকে পিটিয়েছে।
আচ্ছা, ধরে নিই, ছেলে বা মেয়েটা ফার্স্ট সেকেন্ড হয়েই উপরের ক্লাসে উঠছে । এইবার সবাই খুশি? না। এইবার আসবে ক্লাস ফাইভ এর বৃত্তি। বৃত্তি তো পেতেই হবে। নাইলে মান সম্মান থাকে না!
ভাবী! আমার মেয়েটা তো ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে, আপনার মেয়েটা পায় নাই? আহারে!
পাশের বাসার ভাবীর এই কথা শুনে নীলার মা রাগ সামলাতে পারে না। আচ্ছামত বকা দেয় নীলাকে।
নীলা অনেক কষ্ট পেয়ে জিদ নিয়ে পড়তে থাকে। ক্লাস এইটে গিয়ে সে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পায়। সব চাওয়া-পাওয়া তাহলে এইখানেই শেষ? না। সামনে আরো বড় বিপদ!
এসএসসি তে গোল্ডেন পেতেই হবে, নাহলে বেঁচে থাকার কোন মানে নাই। নীলা দিনরাত পড়তে থাকে। সব কয়টা পরীক্ষা ভালো দেয় সে।
সেদিন সকালে নীলা জানতে পারে, তার ইংরেজিতে এ প্লাস আসেনি। নীলার পৃথিবীটা ছোট হয়ে আসতে থাকে। বন্ধু-বান্ধবের আনন্দ, পাশের বাসার মেয়েটার রেজাল্টের মিষ্টি আর ভালো কলেজে ভর্তি না হতে পারার হতাশা এই সব মিলে নীলাকে অসুস্থ করে ফেলে।
নীলা নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দেয়। অনেক কষ্টে ঐ দুঃসময়টা পার করে।
সামনে তার এইচ এস সি পরীক্ষা। গোল্ডেন না পেলে দুনিয়ায় কোথাও তার জায়গা নেই। এমন পরিস্থিতিতে নীলা পড়তে থাকে।
না, এবার আর নিরাশ হতে হয়নি। গোল্ডেন জিপিএ ৫ পেয়ে যায় নীলা। তাহলে এখানেই সব চাওয়া-পাওয়া এর সমাপ্তি? না। সামনে ভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষা। "ভালো" ভার্সিটিতে চান্স না পেলে জীবন শেষ।
নীলা খুব ভয় পাচ্ছে, যদি চান্স না পায়, নাহলে এতদূর আসাটা পুরাই বৃথা।
রাত ১১ টার দিকে বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট দেয়া হয়। নীলা নিজের নামটা কোথাও খুঁজে পায় না।
নীলার শেষ ভরসা ঢাকা ভার্সিটি, সেখানেও চান্স হলো না তার। এখন কী করবে নীলা?
নীলার মা সারাক্ষণ কাঁদতে থাকে। নীলার বাবা তার সাথে দুইদিন ধরে কোন কথা বলে না। তার কলিগের ছেলে চান্স পেয়েছে, অথচ তার মেয়ে চান্স পায় নি, এই লজ্জা সে কোথায় রাখবে?
নীলার চোখের সামনে ভাসতে থাকে ছোট্টবেলা থেকে একটার পর একটা বাধা ডিঙ্গানোর ছবিগুলো। কখনো তো খারাপ স্টুডেন্ট ছিল না সে। মাত্র তিন ঘন্টা বা এক ঘন্টার একটা পরীক্ষায় তার জীবনটা এইভাবে এলোমেলো হয়ে গেলো? মাত্র কয়েক ঘন্টায় তার সব অর্জন ধ্বংস হয়ে গেলো??
নীলা এর মাঝে বহুবার আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে, অনেক কষ্টে নিজেকে দমিয়ে রাখে। তার বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে এখন আর যোগাযোগ নেই। কেউ বুয়েট, কেউ মেডিকেল, কেউ ঢাকা ভার্সিটি। সেই দলছুট হয়ে গেলো। মাত্র কয়েকটা ঘন্টায় সে সব হারালো।
এই তো সেদিন এক আন্টি নীলাকে জিজ্ঞেস করলো, "কী খবর? তুমি কোথায় পড়ো?"
নীলা হাসিমুখে বললো, "অমুক ভার্সিটিতে।"
আন্টি মুখ বাকিয়ে বললো, "অ... বুয়েটে হয় নাই?"
নীলা মাথা নাড়লো। আন্টি এমন এক দৃষ্টিতে তাকালো যেন নীলা কোন মানুষ না, একটা দলামোচড়া করে ফেলে রাখা কাগজ।
নীলাকে প্রায়ই শুনতে হয়ঃ "কোথাও চান্স হয় নি?, অমুক পাইলো, তুমি পাইলা না?" ইত্যাদি ইত্যাদি। নীলাকে প্রায়ই দেখতে হয় "অবজ্ঞার চাহনি"। মাত্র কয়েকটা ঘন্টা তার জীবনটাকে এইভাবে ওলট পালট করে দিলো!
জ্বী, এতকিছুর পর আপনি প্লিজ জিজ্ঞেস করবেন না, "একটা ছেলে বা মেয়ে কেন রেজাল্ট খারাপ হলে সুইসাইড করে?"
এতকিছুর পর আপনি প্লিজ জিজ্ঞেস করবেন না, "কেন কোথাও চান্স না পেলে একটা ছেলে বা মেয়ে এতটা হতাশ হয়ে যায়?"
"যারা চান্স পাওনি, তারা মন খারাপ কইরো না, হতাশ হইও না" - এই কথাটা না খুবই বুলশিট একটা কথা। একটা মানুষ পুকুরের পানিতে পড়ে যাওয়ার পর যদি বলেন, "তুমি কিন্তু ভিজে যাইও না" - ব্যাপারটা যেমন অর্থহীন, ওটাও সেরকম।
বাবা-মা, গার্ডিয়ান লেভেল, বন্ধু-বান্ধব, সমাজের লোকজন থেকে শুরু করে পুরা পরিবেশটাই যখন একটা চান্স না পাওয়া ছেলে বা মেয়েকে মন খারাপ আর হতাশার আনলিমিটেড উপকরণ ফ্রি তে সাপ্লাই দিচ্ছে, সেখানে মন খারাপ না করার কিংবা হতাশ না হওয়ার কোন কারণ নাই।।
গল্পটা তখন আমি আর শেষ করি নাই................................................
নীলা তার ক্যারিয়ারে শেষ পর্যন্ত শাইন করেছিল, নাকি হতাশ হয়ে ঝরে পড়েছিল জানা হয় নাই আর।।
_________________________________________-স্পর্শনীল
ফেসবুকে আমি_ https://www.facebook.com/sparshonil
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জানুয়ারি, ২০১৬ সকাল ৮:১৯