নিষ্কাম মিত্র :
রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী ১৮৭৭-৭৮ সালের দিকে হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রতীক স্বরূপ বর্গী দস্যু শিবাজীকে জাতীয় বীর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি সেই শিবাজীর মহিমা কীর্তন করেছেন, যার পিতা মারাঠা দলপতি শাহজী ভোঁসলা ছিলেন দাক্ষিণাত্যের সুলতানদের জায়গীরদার। শিবাজী নিজেও সুলতানদের জায়গীর খেয়ে তাদেরই বিরুদ্ধে লুটতরাজ, দস্যুবৃত্তি করে তার সামরিক জীবনের সূত্রপাত করেন। ধূর্তামির আশ্রয় নিয়ে বন্ধুবেশে কোলাকুলি করতে গিয়ে পোশাকের নিচে লুকিয়ে রাখা ‘ব্যাঘ্রনখ' নামক অস্ত্র দিয়ে বিজাপুরের সুলতানের সেনাপতি আফজাল খাঁকে হত্যা করে খ্যাতি অর্জন করেন। হিন্দুরাজ্য প্রতিষ্ঠাই ছিল শিবাজীর উদ্দেশ্য। কেবলমাত্র এই কারণেই সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী এমনকি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এই নৃশংস দস্যু লুটেরা শিবাজীকে জাতীয় বীর হিসেবে আখ্যায়িত করেন। আজ শিবাজীর সাধকরাই সারা ভারতে বিস্তার লাভ করেছে। ভারত হিন্দু ভারত হয়েই টিকে থাকতে চাচ্ছে।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে পুঁড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায় ফরমান জারি করেছিলেন যে, যারা দাড়ি রাখবে আর গোঁফ ছাঁটবে, তাদের দাড়ি প্রতি আড়াই টাকা আর গোঁফপ্রতি পাঁচসিকা খাজনা দিতে হবে। কাঁচা মসজিদ তৈরি করলে পাঁচশত টাকা আর পাকা মসজিদের জন্য এক হাজার টাকা খাজনা দিতে হবে। আরবি নাম রাখলে নামপ্রতি পঞ্চাশ টাকা খাজনা দিতে হবে। গো-হত্যা করলে হত্যাকারীর ডান হাত কেটে দেয়া হবে, যাতে সে আর গো-হত্যা করতে না পারে।
পরবর্তীকালেও গো-কুরবানী করতে গিয়ে মুসলমানদের রক্ত কম ঝরেনি। মহাত্মা গান্ধীজীও স্বীকার করেছিলেন যে, হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার দু'টো কারণের মধ্যে প্রথমটি গো-হত্যা। জওহরলাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিপান চন্দ্র তার ‘আধুনিক ভারত ও সাম্প্রদায়িকতাবাদ' গ্রন্থে লিখেছেন, হিন্দুদের গো-রক্ষা আন্দোলন মূলত পরিচালিত ছিল মুসলমানদের বিরুদ্ধে।
অপরদিকে বৃটিশ ফৌজি ছাউনিগুলোতে ব্যাপকহারে গো-হত্যার স্বাধীনতা থেকে যায়। এই গ্রন্থে তিনি আরও লিখেছেন, হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাবাদ পরোক্ষভাবে তার যাত্রা শুরু করে ১৮৮০ এবং ১৮৯০-এর দশকে পাঞ্জাবে এক তেজিয়ান গো-রক্ষা আন্দোলনের মাধ্যমে। এই আন্দোলন মূলত পরিচালিত ছিল মুসলমানদের বিরুদ্ধে।
গো-হত্যা নিয়ে প্রথম দাঙ্গা হয় উত্তর প্রদেশের আজমগড় জেলার ‘মউ' নামক মুসলমান তাঁতীদের একটি ছোট শহরে। ১৮০৬ সালে গো-কুরবানীকে কেন্দ্র করে হিন্দুরা মুসলমানদের ওপর চড়াও হয়ে বেশকিছু নিরীহ মুসলমান হতাহত করে। ওই অঞ্চলে আগে থেকেই হিন্দুরা গ্রামাঞ্চলে চাপ সৃষ্টি করেছিল। এমনকি মুসলমান জমিদারদেরও ঈদের সময় নিজ বাড়িতে গো-কুরবানী করা থেকে নিবৃত রেখেছিল। ১৮০৬ সালের দাঙ্গার পর ১৮০৮ সালে নিজামত আদালত এক রায়ে আদেশ জারি করে যে, হিন্দু অধিবাসীদের ধর্মীয় বিরূপতার জন্য মুসলমানদের দ্বারা গো-কুরবানী পূর্ববর্তী নওয়াব উজিরের সরকার করতো না, তাই অতঃপর গো-কুরবানী নিষিদ্ধ থাকবে। এই আদেশ ১৮৬৩ সাল পর্যন্ত বলবৎ ছিল। অবশ্য ১৮৯৩ সালে কুরবানীর ঈদ উপলক্ষে আজমগড়, উত্তর প্রদেশ ও বিহারের পশ্চিমাঞ্চলে বহু মুসলমানের রক্ত ঝরে।
গো-হত্যা বন্ধের জন্য বারংবার দাঙ্গার পেছনে হিন্দু পুনরুত্থানের আদর্শ কার্যকর ছিল। আর্য সমাজের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী দয়ানন্দ ছিলেন এই হিন্দু পুনরুত্থানের উদগাতা। তার বক্তৃতা ও কার্যকলাপের ফলেই পরবর্তীকালে গো-কুরবানী নিয়ে ভারতের বিভিন্ন স্থানে মুসলমান নিধনযজ্ঞ শুরু হয়েছিল। পাঞ্জাবের গো-রক্ষিণী সভার মাধ্যমে ১৮৮০ সালের গোড়ার দিকে আর্য সমাজের সাংগঠনিক রূপ দানা বাঁধে এবং ধীরে ধীরে মধ্যভারত ও উত্তর ভারতের বহু স্থানে এর শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে পড়ে।
এমতাবস্থায় আমরা যদি অতীত ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নেই এবং সাবধান না হই তাহলে বাংলাদেশের ১৪ কোটি মুসলমানকে স্পেনের মুসলমানদের মতোই অগ্নিদগ্ধ হয়ে মরতে হবে। আর সেদিন হিন্দুরা রাজা ফার্ডিনেন্ডের মতো হাততালি দিয়ে বলবে, মুসলমানেরা তোমরা এপ্রিল ফুল। অনেকে বলতে পারেন, এসব পুরনো ইতিহাস নতুন করে তোলার দরকার কি? আমাদের মনে হয় পুরনো ইতিহাসগুলো নতুন প্রজন্ম জানে না বলেই কোন পরিস্থিতিতে মুসলমানদের পৃথক নিজস্ব আবাসভূমি অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল।
গুজরাটের গোধরা রেলস্টেশনে একটি চলন্ত ট্রেনে সংঘটিত অগ্নিকান্ডের ঘটনাকে অজুহাত বানিয়ে ৩/৪ মাস পর্যন্ত রাজ্যের সর্বত্র মুসলমানদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। তাদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। একযোগে চলেছে সর্বাত্মক মুসলিম নির্যাতন। অথচ প্রতিটি ভারতীয় এবং আন্তর্জাতিক তদন্তেই প্রমাণিত হয়েছে যে, গোধরা রেলস্টেশনে উক্ত ট্রেনে সংঘটিত অগ্নিকান্ড ছিল সুপরিকল্পিত এবং এর পেছনে ছিল বিজেপি'র ষড়যন্ত্র।
ভারতের পক্ষ থেকে সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হওয়ার দাবি জানানো সত্ত্বেও ভারত এখনো উগ্র হিন্দুত্ববাদকেই অাঁকড়ে রয়েছে। আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এই যে, তারা এখনো উগ্র হিন্দুবাদী প্রচারণাকে জোরদার করে চলেছে। মুখে ধর্মনিরপেক্ষতার বুলি আওড়ালেও ভারতের উল্লেখযোগ্য সকল রাজনৈতিক দলই মূলত উগ্র হিন্দুবাদী এবং মুসলমানবিরোধী। উগ্রবাদী হিন্দুরা ১৯৯২ সালে অযোধ্যায় বাবরী মসজিদ ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিলে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা বেধে যায়। এই দাঙ্গার সময় সারা ভারতে দুই হাজার মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছিল নির্মমভাবে। হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা দাবি করেছে যে, রামের জন্মস্থানের পাশে এই মসজিদ নির্মাণ করা হয়। মুসলমানরা এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, ইতিহাসে এমন কোনো প্রমাণ নেই যে, এখানে রামের জন্ম হয়েছিল। এলাহাবাদে কুম্ভমেলায় তিন দিনব্যাপী ধর্মীয় মহাসমাবেশের দ্বিতীয় দিনে ২০ জানুয়ারি ২০০১ শনিবার ভারতের কট্টর হিন্দু ধর্মীয় নেতা বিশ্ব হিন্দু পরিষদের চেয়ারম্যান আচার্য ধর্মেন্দ্র মহারাজ ঘোষণা দেন যে, সরকার সংকট নিরসনে ব্যর্থ হলে আমরা অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণের কাজ শুরু করবো। পৃথিবীর কোনো শক্তি আমাদের এ কাজ বন্ধ করতে পারবে না। দেশের সরকার, বিচারবিভাগ কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করে তারা হিন্দুধর্ম এবং হিন্দু মর্যাদা রক্ষার জন্য পাঁচশ' বছরের পুরাকীর্তি বাবরী মসজিদ ভেঙ্গে দিয়েছিল।
আর্য সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রাচীন বৈদিক বিশ্বাসের প্রতি হিন্দু সমাজকে আহবান জানানোর জন্য, পক্ষান্তরে ইসলাম ধর্মের মূলোচ্ছেদ করার জন্য। গো-হত্যা নিষিদ্ধ আন্দোলন যতো না গো-মাতার প্রতি ভালবাসা থেকে উদ্ভূত ছিল, তার চেয়েও বেশি মুসলমান নিধনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে আর কতো ধর্মপ্রাণ মুসলমান প্রাণ দিয়েছে এই ক্ষুদ্র পরিসরে সে তালিকা দেয়া সম্ভব নয়। শত শত দাঙ্গায় হাজার হাজার মুসলমান প্রাণ দিয়েছে দিল্লী, আগ্রা, মুম্বাই, অযোধ্যা, জুনাগড়, লাহোর, সাহারানপুর, সাহাবাদ, ফৈজাবাদ, কর্ণাট, ডেরাগাজি, বালাকোটে। গো-কুরবানীকে কেন্দ্র করে তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে।
ভারত মূলত হিন্দুরাজ্য। এ পর্যন্ত তারা যে ধর্মনিরপেক্ষ ভাব বজায় রেখে এসেছে তা কেবল ইংরেজদের কাছ থেকে অখন্ড ভারতপ্রাপ্তির আকাংখায়। বৃটিশ ভারতের সর্বভারতীয় কংগ্রেস নেতারা ধর্মনিরপেক্ষতার আর অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলতেন। কিন্তু গোপনে তারা হিন্দু মহাসভা, রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ, আর্য সমাজ প্রভৃতি সংগঠনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতেন।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, একদিকে ধর্মনিরপেক্ষতার বাগাড়ম্বর অন্যদিকে হিন্দুত্বের হিংস্র থাবা বিস্তারই ভারতীয় রাজনীতির মূল দর্শন। আসলে ভারতীয রাজনীতিতে সব শেয়ালেরই এক রা। আর তা হলো হিন্দু জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা। এরা সবাই একই পথের পথিক। কেউ প্রকাশ্যে আবার কেউ রা অপ্রকাশ্যে একই দাবি করে আসছেন। তা হলো, হিন্দু রাষ্ট্র চাই, অযোধ্যায় বাবরী মসজিদের স্থলে রামমন্দির চাই। শ্রী রামচন্দ্রই ভারতের রাষ্ট্রনায়ক, হিন্দুস্তান শুধু হিন্দুদের। সকলেই ভারতকে ‘রামরাজ্য' বানাতে চাচ্ছেন।
প্রশ্ন জাগে, আমরা বাংলাদেশীরা কি আমাদের স্বাধীন পরিচয়ে উগ্র হিন্দু ভারতের পাশে টিকে থাকতে পারবো, নাকি আমাদের স্বাধীন জাতিসত্তার পরিচিতি মুছে দিয়ে ‘রামরাজ্যে' লীন হয়ে যাবো? এর ফয়সালা বাংলাদেশের ১৪ কোটি মুসলমানদেরকে এখনই করতে হবে।