আমি আগাগোড়া একজন সিনেমাপ্রেমী। কিছু মুভি আমি শুধু দেখি না, পারলে খেয়ে ফেলি। তবে হালের গুটিকয়েক সিনেমা আমার নজর কেড়েছে। বিগত পাচ বছরে হলিউড বলিউডের তেমন কোন ভাল মুভি দেখতে পাই না। গত একদশকের মুভিগুলোর অতিরঞ্জিত গ্রাফিক্স, দুর্বল প্লট, নিম্নমানের অভিনয় কলা আমার মনে ধরেনি কখনোই। তাই এই লকডাউনে বারবার আমি ফিরে যাই ১৯৬০-৯০ এর দশকে! হলিউড, ঢালিউড, বলিউডের অনেক পুরোনো মুভি রয়েছে যা যেকোন কালের দর্শকের মন কাড়বেই। এমন একটি হলিউড মুভির নাম হল ব্রিজ অন রিভার কাগায়ুই
ডেভিড লীন পরিচালিত এই মুভিটি সে সময় অস্কারের সাতটি ক্যাটাগরিতে বিজয়ী হয়েছিল। এছাড়াও এই মুভির ঝুলিতে ব্রিটিশ অ্যাকাডেমি ফিল্ম এওয়ার্ড, ব্রিটিশ সোসাইটি অব সিনেমেটোগ্রাফ, ডিরেক্টরস গিল্ড অব অ্যামেরিকা এওয়ার্ড, গোল্ডেন গ্লোব, গোল্ডেন স্কিন ও গ্রামি অ্যাওয়ার্ড সহ অসংখ্য পুরস্কার জিতেছিল। মজার বিষয় হল এসব পুরস্কারের বিষয়টি আবিস্কার করলাম মুভি রিভিউ লিখতে গিয়ে। এই মুভিতে অভিনিত ব্রিটিশ লেফটেন্যান্ট কর্নেল নিকলসন চরিত্রটির জন্যে অ্যালেক গুইনিয়েস সেরা অভিনতা হিসেবে অস্কার জিতেন। সিসেয়ু হায়াকাওয়া সেরা পার্শ্বনায়ক হিসেবে জাপানী কর্নেল সাইতো চরিত্রে অভিনয়ের জন্যে অস্কার পুরস্কার লাভ করেন। তবে এতো কিছু পেলে পরিচালক বাদ যাবেন কেন? তিনিও সেরা পরিচালকের অস্কার জিতে নেন! মুভিটির কিছু দৃশ্য দেখে আপনার কান্না চলে আসতে পারে। কেন আসবে তার ব্যাখ্যা হয়ত পাবেন না। কিছু দৃশ্যে শিহরিত হবেন বারবার। আর এই মুভিটির বেস্ট পার্ট হল প্রতিটি চরিত্রের অভিনয় ও ডেডিকেশন! মোটকথা, একজন পরাজিত সৈনিকের জাত্যাভিমান, দৃঢ সংকল্প, অটুট মনোবল, ধৈর্য, সাহস ও শৌর্যের উপর ভিত্তি করে নির্মিত এই মুভিটি আপনাকে নাড়া দিবেই!
আজকাল অনেকে বিভিন্ন রেটিং দিয়ে মুভির মান বের করে ফেলেন। এই মুভিটি অনেক পুরনো হলেও রেটিং এ কম যায়নি। আধুনিক যেকোন মুভির সাথে টক্কর দিতে সক্ষম এই মুভির রোটেন টোম্যাটোর স্কোর ৯৫%।
প্লট অত্যন্ত শক্তিশালী হওয়াতে এর আই এম ডি বি রেটিং দশে আট দশমিক এক
কাহিনী সারসংক্ষেপঃ ১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিয়ানমারের ঘনজংগলে জাপানীজ সোলজারদের হাতে একদল ব্রিটিশ সোজলার বন্দী হন। জাপানীজ কমান্ডার সাইতো এই বন্দী ব্রিটিশ সোলজারদের শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করে কাগায়ুই নদীতে ব্রিজ নির্মান করতে চান। এই ব্রিজ নির্মানে জাপানিজ সেনা অফিসারদের নির্দেশনায় ব্রিটিশ বাহিনীর বন্দি সকল সদস্যকে শ্রমিক করতে চায় কমান্ডার সাইতো। কিন্তু একগুঁয়ে ব্রিটিশ লেফটেন্যান্ট কর্নেল নিকলসন এতে বেকে বসেন। নিকলসন জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী ব্রিটিশ অফিসারদের শ্রমিকের কাজ করতে দিতে অসম্মতি জানান তবে সাধারণ সৈন্যদের সে কাজের অনুমতি দেয় । এতে ক্ষিপ্ত হয়ে কমান্ডার সাইতো তাকে এবং তার সকল অফিসারকে সারাদিন তপ্ত রোদে দাড় করিয়ে রেখে শাস্তি হিসেবে ছোট্ট ছোট্ট বন্দিঘরে বন্দি করে রাখে। নিকলসনের সকল সৈন্যদলকে শ্রমিকের কাজ করাতে বাধ্য করে। কর্নেল সাইতোর মতে পরাজিত ব্রিটিশ অফিসারদের কোন সন্মান নেই। তাদেরও সৈন্যদের পাশাপাশি শ্রমিকের কাজ করতেই হবে নয়ত অনাহারে কালকুঠুরিতে মরতে হবে। কঠোর সেনা অফিসার কর্নেল সাইতো ব্রীজ বানাতে তার সর্বশক্তি নিয়োগ করে। কিন্তু দুমাস গড়িয়ে গেলেও কোন অগ্রগতি হয় না। জাপানিজ কমান্ডারদের নির্দেশনায় ব্রিটিশ সাধারণ সৈনিকেরা ঠিকমত কাজ সম্পন্ন করতে অসমর্থ হয়। এরমাঝে হুট করে একদিন কালকুঠুরী থেকে পলায়ন কালে কর্নেল সাইতোর সৈন্যদল দুজন অফিসারকে কুকুরের মত গুলি করে মারে। ক্যাম্পে বন্দি আরেকজন অ্যামেরিকান নেভি লেফটেন্যান্ট কমান্ডার শেয়ার্স আহত হয়ে মিয়ানমারের জংগলে পালিয়ে যায়। পরে স্থানীয় বিদ্রোহীদের ক্যাম্পে চিকিৎসা নিয়ে সে সুস্থ হয়ে জাপানিজদের ক্যাম্প আক্রমণের ছক কষতে থাকে। এদিকে কর্নেল সাইতোর ব্রীজ নির্মাণের অগ্রগতি না হওয়ায় দিনদিন হতাশায় পাগল হয়ে ওঠে! তবে জেদি নিকলসনের জিদের কাছে তার পরাজয় অনিবার্য হয়ে ওঠে। সে নিকলসনকে সাময়িক মুক্তি দিয়ে তার কাছে ব্রিজ নির্মানের জন্য সহযোগিতা চায়। নিকলসন জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী সকল অফিসারদের শ্রম মুক্তির যুক্তিতে অটল থাকে। কর্নেল সাইতো ক্ষুধার্ত দুর্বল শীর্ণ শরীরের নিকলসনের উপর ভয়ানক ক্ষেপে ওঠে। কিন্তু ব্রীজ নির্মানে নিজেদের ব্যার্থতা তাকে মনে মনে আগেই ধ্বসিয়ে দেয়। ইন্ডিয়ায় ব্রিজ নির্মানে অভিজ্ঞ নিকলসন বাহিনীর উপর তার ভরসা না করে উপায় থাকে না। এদিকে নিকলসন যুদ্ধে পরাজিত হলেও ব্রীজ নির্মানে নিজ জাতির মাথা উচু রাখতে জাপানিজদের সহায়তা করতে চায়। সে মনে করে এই অঞ্চলে জাপানীজদের কেউ মনে রাখবে না। একদিন এই ব্রীজে যারা চলাচল করবে তারা এই পরাজিত ব্রিটিশ বাহিনীর গুনগান করবে। এটাই হবে তাদের পরাজয়ের মাঝে বিজয়। এমন সময় মাত্র এক মাসের মধ্যে প্রায় তিনশত মিটার লম্বা একটি ব্রিজ খরস্রোতা কাগায়ুই নদীর উপর নির্মান করতে পারবে কি নিকলসন? পলায়নরত শেয়ার্স কিভাবে প্রতিশোধ নিবে জাপানীজদের উপর? কর্নেল সাইতো কি পারবে নিজের লক্ষ্যপূরণ করতে? বন্দী ব্রিটিশ সেনাদের ভাগ্যে কি ঘটবে?
তপ্ত রোদে দাড়িয়ে থাকার দৃশ্য
ব্রিজ নির্মাণে লেফটেন্যান্ট কর্নেল নিকলসন
পোস্টার
এসব প্রশ্নের উওর পেতে আজই সিনেমাটি দেখতে পারেন। লকডাউনে এমন মুভি মিস করবেন না। এই মুভির রেটিং আমার কাছে ৯.৫/১০. নিচে ইউটিউব লিংক সংযুক্ত করা হলঃ
পার্ট - ১
পার্ট- ২
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মে, ২০২০ দুপুর ২:৩২