somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্নেহার গালের টোল বনাম আমার শপিং লিস্ট

১৬ ই মার্চ, ২০১৮ সকাল ১১:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



অনেকদিন পর ড্রয়ার পরিষ্কার করতে যেয়ে হঠাৎ ৫০০ টাকার নোট পেয়ে গেলে যে আদিম মধ্যবিত্ত সুখ পাওয়া যায় এবং বইমেলার প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকার সুগন্ধির সাথে মেলে এমন কোন গন্ধ হঠাৎ নাকে বাড়ি দিলে যেমন করে বুকটা মোচড় দেয়, স্বপ্ন ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে স্নেহাকে এবং তার গালের টোলটাকে আবিষ্কার করে আমার তেমন আদিম সুখও হলো আবার বুকটা মোচড়ও দিয়ে উঠলো।

না, আমাদের কোন মিলিত অতীত নাই, আমি কোনদিন তার ঘাড়ে চুমু খাই নাই, আমার হাত কখনো তার হাতের উপর অবস্থান করে নাই, কোনদিন তাকে হলুদ খামে নীল চিঠি পাঠাই নাই, কিন্তু তবুও তাকে ও তার গালের টোল দেখে আমার প্রচন্ড সুখ হল। চিটাগাং পাবলিক স্কুলের সেই দিনগুলোর স্মৃতি ড্রয়ার থেকে পলকে উঠে আসলো আমার শপিং ট্রলি আর শপিং লিস্টের বাস্তবতায়।

স্নেহার গালের টোলের প্রেমে পড়েছিলাম ক্লাস ফাইভে থাকার সময়। পড়াশুনা ভাল লাগতোনা, কোন বন্ধু ছিলনা, খেলাধুলা পারতাম না, বইখাতা আকর্ষণ করতো না, স্কুলে যেতাম শুধু স্নেহার গালের টোল দেখবার জন্য। খুব করে লুকাতে চাইতাম যে আমি তার গালের টোল দেখি কিন্তু পারতাম না। এর মধ্যে কোন যৌন উদ্দীপক ব্যাপার ছিল না, এর মধ্যে কোন অশ্লীল কামনা ছিল না, এর মধ্যে কোন গুপ্ত রহস্য ছিল না, আমি শুধু নিষ্পাপ ভাবে তার টোলের প্রেমে পরেছিলাম। আমাকে নিয়ে ছেলেরা মশকরা করত, স্নেহা ও তার বান্ধবীরা হাসাহাসি করত, জহির স্যার পানিশমেন্ট দিতেন কিন্তু নিজেকে আমি কোনভাবেই শুধরাতে পারতাম না। ক্লাসে যেতাম আর প্রায় প্রতিদিনই অপমানিত হতাম।

বাবার ছিল বদলির চাকরি তাই বেশিদিন এই অপমান সহ্য করতে হয় নাই। আমরা চলে আসলাম ঢাকায়। আমার জীবন থেকে স্নেহার গালের টোল চিরতরে হারিয়ে গেল। ঢাকায় আসার দিন বসেছিলাম ট্রেনের জানালার ধারে। কান্না পাচ্ছিল, কাঁদছিলাম সারাটা পথ জুড়ে, আব্বা আম্মা মনে করেছেন বন্ধুদের জন্য কাঁদি অথবা স্কুলের জন্য।
কিন্তু আমি কাঁদছিলাম স্নেহার গালের টোল হারিয়ে ফেলার দুঃখে।

কলেজে পড়ি যখন, একদিন স্নেহার সাথে দেখা। ওকে চিনতে পেরেছিলাম, না পারার তো কোন কারন নাই, আমি ওকে সারাজীবন চিনতে পারব, কিন্তু বিস্ময়, সেও আমাকে চিনতে পেরেছিল। এরপর ব্যাংকে চাকরি নিলাম যে বছর, তাও ১৫-১৬ বছর আগের কথা, সে বছর স্নেহার সাথে একদিন এক বিয়ে বাড়িতে দেখা। আমাকে চিনে নাই, আমি আগ বাড়িয়ে যখন পরিচয় দিলাম, তখন দুই-তিনটা কথা বলল তারপর বিয়ে বাড়ির হৈ-হুল্লোড়ে হারিয়ে গেল।

আমার জীবনে প্রেম আসে নাই তাই টোল পরা গাল ছুঁয়ে দেখবার সুযোগ হয় নাই কখনো। মেনে নিয়েছি টোল পরা গাল ছুঁয়ে দেখবার বাসনা অতৃপ্ত থেকে যাবে সারাজীবন। বিয়ে হয়েছে পরিবারের পছন্দে। এছাড়া আমার গতি ছিল না। প্রেম করে কোন নারীর ভালোবাসা অর্জন করার সামর্থ্য নেই আমার।

আমার বউয়ের গালে টোল নাই।

স্বপ্ন ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে স্নেহা ও তার গালের টোলটাকে পুনরায় আবিস্কার করে আমি যতটা না আপ্লুত হয়েছি, দেখলাম আমাকে দেখে তার চেয়েও বেশি আপ্লুত হয়েছে সে। সে এগিয়ে এলো, আমিও এগিয়ে গেলাম। বিস্ময়, সে আমাকে এত বছর পরও চিনতে পেরেছে। প্রশ্ন করাতে বলল - চিনতে অসুবিধা হয়নি তোমাকে; মাঝে টিভির টকশোগুলোতে দেখেছি তো। বাব্বা, কত জ্ঞানী জ্ঞানী কথা বল তুমি। এই কথা শুনে আমার খুশী লাগে, RTV ও বাংলাভিশন কে মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানাই তাদের সেকেন্ড গ্রেড অনুষ্ঠানগুলোতে আমার মতো থার্ড গ্রেড বিশেষজ্ঞকে ডাকার জন্য। অনুষ্ঠান শেষে সাদা খাম বা প্রডিউসারের প্রশংসাবাণী বা সহবক্তাদের মুগ্ধ চাহুনি কখনো এত খুশি আমাকে করে নাই যা স্নেহার কথায় করেছে।

আমার ট্রলির উপচে পরা ক্যাপিটালিজম দেখে স্নেহা বুঝে নেয় আমার বড় পরিবার; প্রশ্ন করে - কজন ছেলে মেয়ে তোমার? আমিও তাকে মাপি; তার হাতের দামী ব্যাগ আর কপালে উঠিয়ে রাখা ভালো ব্র্যান্ডের সানগ্লাস দেখে বুঝি কোনো ব্যবসায়ীর স্ত্রী সে। ব্যবসায়ীর স্ত্রী বলে নির্ণয় করি তাকে কিন্তু ঝুঁকি নেই না; প্রশ্ন করি - কি করছ তুমি? উত্তর দেয় - শিক্ষকতা; IUB তে বিজনেস কোর্স নেই। আমি তার কথায় চমকাই কিন্তু বুঝতে দেইনা।

বনানী এলাকা জুড়ে আরবানাইজেসন আর ক্যাপিটালিজম। এই উপচে পরা আরবানাইজেসন আর ক্যাপিটালিজম আমাকে, স্নেহাকে আর স্নেহার গালের টোলকে প্ররোচিত করে কোন একটা কফিশপে বসতে। আমরা অবাধে প্ররোচিত হই, Rio Coffee তে যেয়ে বসি। বসেই বউকে টেক্সট করি - পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা, কফিশপে বসছি, আসতে দেরি হবে।

স্নেহা লক্ষ্য করে সেটা, জিজ্ঞেস করে - বউকে জানাচ্ছ? আমি মাথা নাড়ি। এবার প্রশ্ন করে - তোমার বউ কিছু করে? হালকা গরম কফির আভা উপভোগ শুরু করার মুহূর্তে এই প্রশ্ন শুনে আমি বিব্রত হই। শিক্ষকতা পেশায় থাকা ব্রাইট এই নারীর যে আমার দেয়া উত্তর পছন্দ হবে না এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। বলি - আমার বউ ফুলটাইম গৃহিনী। স্নেহা খুব মিষ্টি একটা হাসি দেয় যেন সে এটা আপ্রিসিয়েট করে। গতানুগতিক প্রশ্ন বা মন্তব্য থেকে সে আমাকে রেহাই দেয়। প্রশ্ন করেনা - টকশোতে এবং সেমিনারে বড় বড় কথা বলে নিজের বউকে ঘরে আটকে রেখেছো? প্রশ্ন করেনা - এই যুগে বাস করেও মানসিকতা তোমার মধ্যযুগীয় রয়ে গেল?

সে জানায় তার স্বামী ব্যবসায়ী। তার দুই ছেলে। পড়ে ISD স্কুলে। বুঝি আমার অনুমান ঠিক হয়েছে, স্নেহার জীবনযাত্রার মান নির্ধারণ করেছে তার ব্যবসায়ী স্বামীর অর্থ-বিত্ত। আমি মনে মনে তার ব্যবসায়ী স্বামীর ক্যারেক্টার আঁকি। নিশ্চয়ই তার স্বামী কিছুটা কর্মঠ, কিছুটা ধার্মিক এবং পুরোটা বাটপার। এই কম্বিনেশনই এখন চলছে। এর বাইরে তো কেউ টাকা বানায় না। এই কিছুটা কর্মঠ, কিছুটা ধার্মিক এবং পুরোটা বাটপার লোকটা স্নেহার গালের টোলটার মূল্য দিচ্ছে কিনা সে ভাবনা আসে আমার মাথায় কিন্তু আমি তা দ্রুত সরিয়ে দেই।

কথা আগায়, এত বছরের ফিল-ইন-দ্যা-ব্লাঙ্কস পুরন হতে সময় লাগে। এই কথা, সেই কথা চলে আর আমি সন্তর্পনে তার গালের টোলের দিকে তাকাই। পৌষের হীম রাতে মুরব্বীদের চোখ এড়িয়ে খেজুর গাছের রস চুরির যে আনন্দ পায় কিশোরের দল, এই কফি শপে বসে আসেপাশের মানুষের চোখ এড়িয়ে স্নেহার গালের টোলটা দেখে আমি সেই আনন্দ অনুভব করি। কিন্তু ক্লাস ফাইভে থাকতে যেমন ব্যর্থ হতাম, এত বছর পরও এবারও ব্যর্থ হলাম। স্নেহা বলে, সে নিশ্চয়ই জানে আমি বিব্রত হবো, তবুও বলে - তুমি আগের মতন নিষ্পাপ দৃষ্টিতে আমার গালের টোলটা দেখছো বারে বারে, যেন আমি এখানে নেই, আছে শুধু আমার গালের টোল, শুধু এই টোলটাই তোমার কাছে বাস্তব।

আমি চোখ নামিয়ে ফেলি, লজ্জা পাই কিন্তু পরক্ষণে বুঝি তার গালের টোলের প্রতি আমার আসক্ততা আমাকে না যতটা তৃপ্তি দেয় তার চেয়ে বেশী তৃপ্তি দেয় তাকে। স্নেহা বলে - আমাকে কত মানুষ ভালোবেসেছে, কত মানুষ রূপের প্রশংসা করেছে, কত মানুষ আমার শরীর কামনা করেছে, কত প্রেমিক আমার শরীর ছুঁয়েছে কিন্তু কারো চোখে তোমার মত মুগ্ধতা দেখিনি কখনো। আজও সেই একই মুগ্ধতা নিয়ে তুমি যখন তাকাচ্ছো তখন মনে হচ্ছে এমন মুগ্ধতাকে পুঁজি করে কয়েকশো বছর বাঁচা যায়। তার কথার মানে পুরোপুরি বুঝতে পারিনা আমি, অস্পষ্ট লাগে, মনে হয় সে যেটা বলছে আমি হয়তো সেই মানেটা ধরতে অপারগ অথবা বুঝবার সামর্থ্য আমার নেই, তাই বলি ...
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মার্চ, ২০১৮ সকাল ১১:৫৭
৯টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

দুলে উঠে

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৫৬

দুলে উঠে
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

মন খুশিতে দুলে দুলে ‍উঠে
যখনই শুনতে পাই ঈদ শীঘ্রই
আসছে সুখকর করতে দিন, মুহূর্ত
তা প্রায় সবাকে করে আনন্দিত!
নতুন রঙিন পোশাক আনে কিনে
তখন ঐশী বাণী সবাই শুনে।
যদি কারো মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তরে নিয়ে এ ভাবনা

লিখেছেন মৌন পাঠক, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩০

তরে নিয়ে এ ভাবনা,
এর শুরু ঠিক আজ না

সেই কৈশোরে পা দেয়ার দিন
যখন পুরো দুনিয়া রঙীন
দিকে দিকে ফোটে ফুল বসন্ত বিহীন
চেনা সব মানুষগুলো, হয়ে ওঠে অচিন
জীবনের আবর্তে, জীবন নবীন

তোকে দেখেছিলাম,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি পথখাবার খান? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য

লিখেছেন মিশু মিলন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৪

আগে যখন মাঝে মাঝে বিকেল-সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, তখন খাবার নিয়ে আমার জন্য ওরা বেশ বিড়ম্বনায় পড়ত। আমি পথখাবার খাই না। ফলে সোরওয়ার্দী উদ্যানে আড্ডা দিতে দিতে ক্ষিধে পেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

×