somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে...

২৯ শে এপ্রিল, ২০০৮ সকাল ১০:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাইরে এখন উথাল পাথাল হাওয়া। দূরে কি কোথাও বৃষ্টি হয়েছে? কিছুক্ষণ আগেও কেমন ভ্যাপসা একটা গরম ছিল কিন্তু এখন ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে মাঝেমাঝেই। ছেলেটার গাঁয়ে কাঁটা দিয়ে উঠল হঠাৎ করে। কেমন বাড়াবাড়ি রকমের জ্যোৎস্না আজ। যেন চাঁদের আলোয় সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাবে এই বাঁধ ভাঙা জ্যোৎস্না। চেনা শহরটাকে কেমন অচেনা লাগছে এই অদ্ভুত আলোতে!


ছেলেটা একটা ছোট্ট ঘরে বসে আছে এখন। একটা মাটির কলসি আর একটা গ্লাস - আর কিছু চোখে পড়ছে না আশেপাশে। ছোট্ট গুলগুলিটা গলে জ্যোৎস্নার আলো এসে পড়ছে ছেলেটার পায়ের কাছে। মুগ্ধ চোখে ছেলেটা দেখছে আলোর আঁধারের এই খেলা। কি অদ্ভুত সব নকশাই না তৈরি করছে তারার ফুলগুলো! নিজের অজান্তে ছেলেটি হাত বাড়িয়ে দেয় তারার ফুলগুলোর দিকে... কি এক অদ্ভুত নেশায়...


সেদিনও কি এমন বাড়াবাড়ি রকমের জ্যোৎস্না ছিল? ছেলেটি বিস্মৃত হওয়া স্মৃতিগুলো হাতড়ে বেড়ায়। রাতের খাওয়া শেষ করে সবাই মিলে উঠোনটাতে পাটি পেতে বসেছিল। দিদি গাবে না গাবে না করেও সুর তুলেছিল - আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে... বসন্তের এই মাতাল সমীরণে... কি মিষ্টিই না গলা দিদিটার। মেয়েটা কেন যে সিরিয়াসলি গান শিখল না - ছেলেটা ভাবে। জানে কিছু বললেই বলবে, "আমাদের ছা- পোষা মধ্যবিত্তদের এসব বিলাসিতা মানায় নারে। তুই চাকরি করে যখন অনেক টাকা জমাবি তখন একটা হারমোনিয়াম কিনে দিস। তারপর দেখিস কি ফাটিয়ে গান গাই। কেমন?" বলেই পরিচিত সেই মিষ্টি হাসি। মায়ের বকুনিতে আসর ভেঙেছিল কেননা খুব ভোরে যে আবার ছেলেটিকে ট্রেন ধরতে হবে। একসময় রাত গভীর থেকে গভীরতর হয়। চাঁদের আলো ম্লান হয়ে আসে। ধীরে ধীরে নিভে যায় তাদের একতলা টিনশেডের বাড়িটির সবগুলো আলো। প্রথমবারের মত ঢাকা যাওয়ার উত্তেজনায় ঘুম আসছিল না ছেলেটির। হঠাৎ দরজায় দীর্ঘ একটা ছায়া দেখে চমকে উঠে। সে রাতে বাবা এসে দাঁড়িয়েছিলেন দরজায়। ছেলেটি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, "কিছু বলবে?" বাবা স্মিত হেসে পাশে এসে বসেছিলেন। বলেছিলেন, "নতুন জায়গায় যাচ্ছিস। প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হবে। পারবি তো?" তারপর সব শংকা নিজেই উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, "নিশ্চয়ই পারবি। তোকে পারতেই হবে। কত স্বপ্ন, কত গর্ব তোকে নিয়ে আমাদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাচ্ছিস। ভাবতেই তো গর্বে আমার বুক দশ হাত হয়ে যাচ্ছেরে!" ছেলেটি লাজুক হেসে বলেছিল, "কি যে বল না বাবা!" বাবা মৃদু হেসে বলেছিলেন, "যখন দেখবি আর পারছিস না তখন ভয় পাবিনা একদম। নিজেকে বলবি - তুমি হারবে না। কেননা তুমি হারতেই পারনা। কি পারবি না বলতে?" ছেলেটি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখেছিল বাবার চোখে চিকচিক করছে মুক্তোর মত অশ্রু আর হঠাৎ করেই ছেলেটির মনে হয়েছিল তার ছা- পোষা কেরানি বাবার বয়েসটা যেন কমে গেছে অনেকখানি!


হাতের উপর দিয়ে কিছু একটা দৌড়ে গেল। সৎবিৎ পেয়ে ছেলেটি বাস্তবতায় ফিরে আসে। চারিপাশে তাকায়। না তার সেই টিনশেডের ছোট্ট বাসায় বা হলের রুমে বন্ধুদের আড্ডায় নেই সে। এমন একটা রাতে হয়ত সেখানেই থাকার কথা ছিল তার কিন্তু ছোট্ট একটা ভুল করে ফেলেছিল সে।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সারাদেশে উত্তপ্ত পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে গত ২২শে আগস্ট রাত ৮টা থেকে কার্ফিউ জারির আগে তিন ঘন্টার নোটিশে সকল সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হল খালি করার নির্দেশ দেওয়া হলে মধ্যবিত্ত ছা- পোষা পরিবারের এই খেঁটে খাওয়া ছেলেটি সাভার পর্যন্ত হেঁটে গিয়েও হলে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিল। কেননা চার কোটি মানুষের এই শহরে একটি দিনের জন্যেও সে খুঁজে নিতে পারেনি শক্ত মাটির আশ্রয়। গভীর রাতে হলে রেইড করা হলে তাকে ধরে আনা হয়। প্রশাসনেরই বা দোষ কি – আপনমনেই ভাবে ছেলেটি। আসলে বড় বড় মানুষগুলোর বড় বড় কথা ছেলেটির ছোট্ট মাথায় ঢুকতে চায় না। ঘুরে ফিরে মায়ের মুখটা চোখে ভেসে উঠে ছেলেটির। একসময় হঠাৎ করেই সেই মুখটা দখল করে নেয় প্রক্টর স্যারের করুণ দৃষ্টি। কি অসহায়ত্বই না ছিল সেই দৃষ্টিতে। নিজের ব্যর্থতা আর অপারগতায় লজ্জিত একটা মুখ। আহা, বারবার বলছিলেন তাকে ছেড়ে দিতে। কিন্তু উলটো তাকেই অপমানিত হতে হয়েছিল। ছাত্রের সামনে অপমানিত হওয়ার লজ্জায় স্যারের বিব্রত মুখটা অসহ্য ঠেকছিল ছেলেটির কাছে। মনে মনে প্রার্থণা করেছিল, "হে খোদা, চারিদিক অন্ধকার করে দাও তুমি। যদি সত্যিই থেকে থাক, এই লজ্জা থেকে মানুষটাকে তুমি রক্ষা কর।" পরমকরুণাময় সেদিন তার ডাক শুনেননি। বোধকরি আমাদের দেশের বড় বড় মানুষগুলোর মত তিনিও দূর থেকে নিভৃতে দেখে যান তার সৃষ্টির লীলাখেলা আর নীরবে হাসেন তাদের ছেলেমানুষীতে। নাহ, পরমকরুণাময় সেদিন অন্ধকার করেননি বরং বাঁধভাঙা জ্যোৎস্নার আলো যেন পরিহাস করেছিল সেই বোকা ছেলেটিকে।


এখন চাঁদের আলো ফিকে হয়ে গেছে অনেকটাই। আর কিছুক্ষণ পরেই পূবাকাশে ছড়িয়ে পড়বে আবিরের রং। আচ্ছা মা কি ওযু সেরে নামাযের পাটিতে বসেছে? হয়ত তার বুকের ধনের জন্যে হাত তুলেছেন তিনি - ছেলেটি আপনমনেই ভাবে আর হাসে। তারপর একসময় সেই বোকা ছেলেটা তারার ফুল ধরার চেষ্টা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তবুও পরাজিত সেই ছেলেটির কানে বাজতে থাকে বাবার শেষ কথাগুলো - তুমি হারবে না। আর আমাদের মত সুখী মানুষগুলোর ঘরে বাজতে থাকে - আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে, বসন্তের এই মাতাল সমীরণে...

২৪/ ০৮/ ০৭, ঢাকা।


[ বিঃ দ্রঃ আমি কল্পগল্প লিখতে পারি না। তবে মাঝে মাঝে অপচেষ্টা চালিয়ে ফেলি। আশা করি পাঠক নিজগুণে এই ধৃষ্টতা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

বলাই বাহুল্য লেখাটি অনেককাল আগের। নতুন করে কিছু লেখা হয়ে ঊঠে না আজকাল। তাই আগের একটি লেখাই পোষ্ট করে দিলাম। লেখাটি ২০০৭ সালের আগস্ট মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে লেখা হয়েছিল।

শুভ কামনা রইল সকলের জন্যে। ]
১৯টি মন্তব্য ১৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×