আমার এক দোস্ত; জ্যাক – জাকির আকরাম। আমরা ওরে খ্যাপাই “হাড্ডির লাগি হুগাইতে পারিনা মা” বলিয়া। ও বলে, “ব্যাপারস না”। অলস বসিয়া আছি এ মুহূর্তে। তো ঠিক করিলাম আজ আমার সেই দোস্তের দুঃখের কাহিনী বয়ান করিব।
বেচারার এই লইয়া তিন তিনখানা মোবাইল চুরি গিয়াছে। ইহাতে সে “অল্প শোকে কাতর” এর ন্যায় হইয়া পড়ে। কিন্তুক ক্ষণকাল পরেই সকল দুঃখ শার্টের কাঁধে পড়া ধূলির ন্যায় ঝাড়িয়া ফেলিয়া (ভাবখানা এমনতর যে, রাস্তায় হাঁটিলে ধূলিকণা তো পড়িবেই!!!) “আমি কি ডরাই সখি ভিখারী রাঘবে” বলি চতুর্থবারের ন্যায় বেলতলায় গেলেন এবং একখানা মোবাইল খরিদ করিয়া আনিলেন। কিন্তুক গুরুজনেরা তো আর এমনি এমনি বলেন নাই যে, “বুদ্ধিমানেরা বেলতলায় গমন করেন কেবল দুইবার। প্রথমবার যান বেল পাকিল কিনা তাহা দেখিবার নিমিত্তে এবং দ্বিতীয়বার যান যে বেলটি মাথায় পড়িল তাহার গুষ্টি উদ্ধার করিতে। অতঃপর তাহাকে বগলদাবা করিয়া লইয়া আসেন সরবত বানাইবার তরে”। কিন্তুক এহার গূঢ়তত্ত্ব না বুঝিয়া আমাদের জ্যাক বাবাজী নিজেকে তাহাদের চাহিতেও বুদ্ধিমান ভাবিয়া বসিল। অতঃপর বাল্যকালের ধারাপাতের জ্ঞানকে সম্বল করিয়া দুই কে দুই দিয়া গুণ করি চার বানাইয়া ফেলিলেন এবং এই ভাবিয়া নিশ্চিত হইলেন যে এইবার ভাগ্যদেবী আর তাহাকে ফাঁকি দেবেন না। কিন্তুক কলিকাল, ছাগলে চাঁটে বাঘের গাল!!! সুতরাং যাহা হইবার তাহাই হইল। সুতরাং যে লাউ সে কদুই হইল। মাগার বাট কাহিনীতে আসল প্যাঁচগী তখনি লাগিল যখন ঐ মোবাইল তাহারে ছলনাময়ী মাইয়্যার ন্যায় ছাড়িয়া অন্য প্রেমিকের হাত ধরিল এবং ইহাতে সে “অধিক শোকে পাথর” এর ন্যায় নির্বাক, নিশ্চল হইয়া পড়িল। তাহার ছলছল চোখ, তাহাতে সে কি এক বোবা চাহনি, কিছু বলিবার তরে দু’দন্ডের তরে কাঁপিয়া উঠি স্তব্ধ হওয়া কণ্ঠ; তাহার এহেন দেবদাসরূপ দেখিয়া বন্ধুমহলে আমাদের সকলের হৃদয় ভাঙ্গিয়া আসিতে চাহে। কিন্তুক আমাদের মত অভাজনেরা স্বান্তনা ব্যতীত কিবা দিতে পারি এক ছ্যাঁক খাওয়া প্রেমিক পুরুষকে? কিন্তু প্রেমিকের মন স্বান্তনায় কি মানে? সুতরাং তথাস্থু কহিয়া “ফেভিকল” দিয়া নিজ নিজ ভাঙ্গা হৃদয় অতীব কষ্টে জোড়া লাগাইয়া ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলা ব্যতীত আমাদের করিবার আর কিছুই রহিল না সেই প্রেমিকপুরুষের লাগিয়া!
কিন্তুক এত আর আমি বা আপনি না যে এইবেলা রণে ক্ষান্ত দিয়ে ইহজনমে আর মোবাইল কিনিব না বলিয়া পণ করিয়া বসিয়া পড়িব। এ হইল আমাদের বিশ্বপ্রেমিক জ্যাক মিয়া। তাহার হৃদয় আকাশের মত বিশাল যাহাতে তিনি কত যে কপোতিনীকে উড়িবার তরে স্থান দিয়াছেন তা লিখিতে গেলে ভগবান সাক্ষী আজ পুনরায় এক মহাভারতের আবির্ভাব হইবে। যাই হোক, কি যেন বলিতেছিলাম – হ্যাঁ, এত আর আমি বা আপনি নই – এ হইল জ্যাক – দ্য গ্রেট ফিলানথ্রোপিস!!! সুতরাং এক শুভলগ্নে কনে দেখা আলোতে তিনি পঞ্চমবারের মত মোবাইল খরিদ করিলেন এবং এক রাংগা প্রভাতে তাহার মিছামিছি কল পাইয়া নিশ্চিত হইলাম যে আমাদের জ্যাক ফিরিয়া আসিয়াছেন স্বমহিমায়।
তো সেদিন ক্লাস শেষে আমাদের সাথে আসিয়া বসিলেন। দেখিয়া মালুম হইল বেশ খোশ মেজাজেই আছেন। কেননা বসিবা মাত্র তিনি যে বীরবিক্রমে তাহার চিড়িয়াখানার বান্দররূপী মোবাইলের নানাবিধ নর্তন কুর্দন দেখাইতে লাগিলেন তাহাতে তাহার । পিতা তাহার এক বৎসরের পুত্র সন্তানের নানান পিঁচকে ফাজিল কর্মকান্ড দেখিয়া এবং দেখাইয়া যেরূপ আনন্দ পান তাহার আকর্ণবিস্তৃত হাসি দেখিয়া তেমনি মালুম হইতেছিল। তবে এহাতে দর্শক ও শ্রোতাকূলের যে কিরূপ বিরক্তির উদ্রেক হয় তাহার দিকে বিন্দু পরিমাণও নজর থাকেনা এসকল পুত্র গর্বে গর্বিত জনকদের। কি আর করা; ব্যাপার না। মূল কাহিনীতে ফিরিয়া আসি।
আমাদিকে চমকাইয়া দিয়া ব্যাটা কহিয়া উঠিল, “জানিস আজকাল মনখারাপ হইলেই আমি মোবাইল লইয়া বসি। হাসিতে হাসিতে পেটে খিল ধরিয়া যায়”। আমি মনে মনে কহিলাম, “আহা বাছা! অল্প বয়সে এত দুঃখ। মালুম হয় দিলের তকলিফ দিমাগে উঠিয়া নাচিতে শুরু করিয়াছে”। কিন্তুক যেই কথা সেই কাজ। বলিবামাত্র ব্যাটা সেটিংস গিয়া ল্যাংগুয়েজ ঠিক করিল “বাংলা”। এহার পর যাহা ঘটিল তাহার জন্যে আমরা কেহই প্রস্তুত ছিলাম না। অল্প সময়ের মাঝেই তাহার বান্দর পোলা আমাদিগকে যে পরিমাণ নিষ্পাপ আনন্দ প্রদান করিল এবং সেই সাথে যে পরিমাণ ভাষা শিক্ষা দিল; তাহাতে আমাদের নিজ নিজ শব্দভাণ্ডার যে কি পরিমাণে সমৃদ্ধশালী হইয়া উঠিয়াছে তার একটি বিশেষ নমুনা তুলিয়া ধরিবার লোভ সামলাইতে পারিতেছিনা – “Missed Call” এর বঙ্গানুবাদ “অক্ষম কল”। এখানে চিন্তার বিষয় আছে!!! কার অক্ষমতার কথা বলা হইয়াছে এখানে? কলের নাকি কল যিনি ধরিবেন তাহার!!!
সবকিছু দেখিয়া শুনিয়া আমাদের এক বন্ধু বলিয়া উঠিলেন, “বাস্তবিকই এ শুধু বাংলাতেই সম্ভব”!!!!
অভাজনের কিছু কথাঃ যে কোন ভাষার সবচেয়ে শক্তিশালী দিকগুলোর একটি হচ্ছে সে ভাষায় পারিভাষিক শব্দের সাবলীল ও স্বতঃস্ফূর্ত ব্যবহার। স্বীকার করছি বাংলা এ ব্যাপারে বেশ অনুদার বটে কিন্তুক তাই বলিয়া “Missed Call” এর বঙ্গানুবাদ “অক্ষম কল” এহা মানিতে বিবেকে বাঁধছে বৈকি। আর তাহার উপরে একাজটি যখন এমন কেউ করেন যাহাদের দাবি, “এ শুধু বাংলাতেই সম্ভব”-তখন এহেন বাংলা প্রহসনসম ঠেকে। যাই হোক, খানিকটা আতলামির জন্যে অভাজন ক্ষমাপ্রার্থী।
বিঃদ্রঃ সম্প্রতি বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গিয়াছে যে আমাদের জ্যাক বাবাজীকে পুনরায় তাহার প্রেমিকা ছ্যাঁক দিয়াছেন ষষ্ঠবারের মত। সত্যিই সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ!!!
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মে, ২০০৮ রাত ১:৩৯