বিজয়নগর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অনীল স্যার। আদর্শ বাংলা বই বা বাংলা চলচিত্রে শিক্ষকদের যেমন দেখানো হয় তার থেকে বেশি এই স্যার। স্যারের অনেক গুলো গুণ ছিল। তার ভিতর একটি হল, সমস্ত বিদ্যালয়ের দেওয়ালে নানা মনীষীগনের বিখ্যাত কথা, কবিগনের বিখ্যাত কবিতার চরণ, নানা উক্তি, উপদেশ বানী ইত্যাদি রং বেরংয়ের কালি দিয়ে লিখে রাখতেন। সামনে-পিছনে, ডান-বাম দেওয়ালের কোন জায়গা খালি পাওয়া যেত না। স্যারের হাতের লেখা ছিল অসাধারন, যখন ব্লাকবোর্ডে লিখতেন মনে হতো প্রতিটি অক্ষর একটা একটা করে স্কেল দিয়ে মেপে মেপে লিখে রেখেছেন।
প্রাইমারি স্কুলটি ছিল আমাদের গ্রাম ও বিজয়নগর দুগ্রামের মাঠের মাঝে। স্কুল থেকে দুই গ্রাম আধা কিলোমিটার করে দুরত্ব হবে। (বিজয়নগর গ্রামে জন্ম বাংলাদেশের বিখ্যাত ৩ অভিনেত্রী ববীতা, চম্পা, সুচান্দা। তাদের ভাতিজী আমাদের সাথে পড়তো।) আশেপাশে কোন বসতবাড়ি নেই, কাচাঁ মেঠে রাস্তা, বিদ্যুৎ ব্যবস্থাও ছিল না। এগুলো এখনো নেই মনে হয়। গ্রীষ্মে হাটু আবদি ধুলা আর বর্ষায় হাটু আবদি কাদা নিয়ে স্কুলে পৌছাতাম আমরা।
স্কুলের চারপাশে পাতাকপি, ধান,পাট, নানা শাকসবজির চাষ। ক্লাসে বসে এগুলোর গন্ধ নাকে চলে আসতো। দক্ষিনমুখ করা স্কুল থেকে মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে তাকিয়ে যেন আলাদা একটা জগৎতে হারিয়ে যেতাম। অনেকটাই স্বপ্নের স্কুল ছিল তখনই। এখনতো ভাবলে আরও মায়া বেড়ে যায় সেই সোনালী দিনের ভাবনায়। আর এই স্বপ্নের স্কুলেটা স্বপ্নের মত করে গড়ে ছিল আমাদের অনিল স্যার নিজের হাতে।
স্কুলের আঙিনা থেকে শুরু করে স্কুলের মাঠ প্রতিদিন দুবার করে পরিস্কার করাতেন নিজে দাড়িয়ে থেকে। মাঠের চারপাশের মেহেগনি গাছের পাতা পড়তো মাঠে। চাষীরা মাঠে পাতা কপি, নানা সবজি রাখতো। চাষীরা সবজি নিয়ে চলে গেলে ছাত্র দিয়ে সব পাতা বা আবর্জনা পরিস্কার করে গাছের গোড়ায় রেখে দিতেন। স্কুলের মাঠ অবশ্যই আগাগোড়া সমান থাকতে হবে কোথাও উচুনিচু থাকবে না এবং এক ইঞ্চি জায়গাও ঘাস ছাড়া থাকা চলবে না। স্কুলের একপাশে ফুল গাছের বাগান। সব কিছুই ছিল সাজানো গোছানো।
স্যারের শিক্ষাদানও ছিল চমৎকার। বিশেষ করে ঐ সময় যারা ক্লাস ফাইভে বৃত্তি দিতো স্যার তাদের একটু বেশি যত্ন করে পড়াতেন। স্যার মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের একটু বেশি ভালবাসতেন। অনেকেই বলতেন স্যারের ৫ কন্যা, কোন ছেলে নেই তার জন্য ছেলেদের বেশি ভালবাসতেন। আমাদের ক্লাসে বলতেন, তুই (আমার নাম ধরে) সম্রাট আর আমার মা ফাতিমা থাকলে আমার আর কারো দরকার নেই। স্যার হিন্দু ধর্মের হলেও মুসলিম ধর্মের প্রতি অন্য রকম ভালবাসা ছিল।
স্যার বেঁচে আছেন কিনা জানিনা। আমাদের গ্রামে অনেক আগে দেখতাম রেনেসাঁ ফাউন্ডেশনে একটা মেয়ে সাইকেল চালিয়ে এসে চাকরি করতেন। অনেক দিন পর জানতে পারলাম তিনি আমাদের স্যারের মেয়ে। একদিন ডেকে বললাম, আপনি অনিল স্যারের মেয়ে?? স্যার কেমন আছেন? দিদি বললেন, বাবা ভাল আছেন তবে বেশি হাঁটাচলা করতে পারেন না। বেশির ভাগ সময় বিছানায় থাকতে হয় উনার বার্ধক্যর জন্য।
স্যার যেখানেই থাকুক, যেভাবে থাকুক ভাল থাকুক। স্যারের মত এমন শিক্ষক প্রতিটা স্কুলে গড়ে উঠুক। মিস ইউ স্যার.....
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে নভেম্বর, ২০১৯ রাত ৯:৫৯