ঘটনাটা কমবেশী সবার মনেই আলোড়ন তুলেছিল। একদমই হঠাৎ করে ঘটে গেল ঘটনাটা। এই ঘটনাটা ছিল একজন মানুষের মৃত্যু। মৃত্যুটা অধিকাংশ পাঠকের মনেই দুঃখের গভীর একটা রেখা টেনে দিয়েছিল। কিন্তু সবার মনে দাগটা সমান গভীর হয়নি।
মানুষটা খুব যে ভাল ছিল তা বলা যাবে না; ভালই ছিল। কিন্তু তার একটা খারাপ বৈশিষ্ট্যও ছিল। সেটা হল সে তার দুঃখকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাইত। এই চাওয়াটা ছিল সেই বিখ্যাত লেখিকা পাপিয়া সুলতানার। এক বছরের মধ্যে পত্রিকায় লেখালেখি করে নাম কামিয়ে নিয়েছিল সে। এজন্য শিতি সমাজেই তার নামটা বেশি পরিচিত ছিল।
২.সম্ভবত পাপিয়ার সবচেয়ে পছন্দনীয় লেখার বিষয় ছিল ‘মৃত্যু’। এই জিনিসটা ওকে ভাবাত প্রচুর। পরিচিত-অপিরিচিত কারও মৃত্যু দেখলেই কেমন বিষণ্ণ হয়ে পড়ত। এর পেছনে একটা কারণ আছে। সে তার পরিবারের দ্বিতীয় সন্তান। প্রথমে ভাই তারপরে বোন। ভাইয়ের জন্মের দশ বছর পরে তার জন্ম হল। জন্ম নিয়ে আর মাকে দেখতে পায়নি। তারও সাত বছর পর ভাইয়ের মৃত্যু হল। ছোট পাপিয়া বোধহয় তখন থেকেই মৃত্যুকে পৃথিবীর সবচেয়ে অদ্ভুত জিনিস বলে ভাবত। সেই সময় থেকেই কারও মৃত্যু দেখলে ও কান্না না করে চুপচাপ বসে থাকত। এভাবে পাপিয়ারবেড়ে ওঠা আর পড়াশুনা শেষ হয়। পড়াশুনার লাইনটা সাইন্স হলেও সে এই লাইনে আর আগায়নি। যা হোক পড়াশুনা শেষ হবার পর পাত্র খোঁজা শুরু হল তার জন্য। কিন্তু পাপিয়ার ভাগ্যে সম্ভবত বিয়ে না হওয়াটাই ঠিক করা ছিল। পাপিয়া লম্বা আর হালকা পাতলা; দেখতে মোটামুটি ভালই। চরিত্র সম্পর্কে কোন খারাপ কথা ছিল না বা পড়াশুনাতেও ও পিছিয়ে ছিল না। কিন্তু বারবার বিয়ে ঠিক করা হলেও ছেলেপরে কিছু মারাত্মক দোষ বের হওয়ায় ওর আর বিয়ে করা হয়নি। তারপর পাপিয়া লেখালেখি শুরু করে। তখন থেকে শুধু পাপিয়া লেখিকা পাপিয়া হয়ে উঠল।
৩.পাপিয়ার খারাপ বিষয়টা ছিল ‘বিষণ্ণতা’। মনে হয় অনিচ্ছাকৃতভাবেই তার লেখায় মৃত্যু শব্দটা চলে আসত। আর লেখার এই ধরণটা কিছু পাঠককে কষ্টও দিত। বই পড়ুয়ার সংখ্যা এখন অনেক। কিন্তু কয়জন পাঠক হৃদয় দিয়ে লেখাটা অনুভব করতে পারে।কতজনই বা লেখকের মনের সুখ-দুঃখের অনুভুতি পুরোপুরি অনুভব করতে পারে। ঠিক এজন্যই পাপিয়ার লেখাটায় গাঢ় বিষণ্ণতার ছাপ থাকলেও তার সব ভক্তের হৃদয়ে ছাপটা পড়েনি। পাপিয়া শুধু একজন পাঠকের মনেই ছাপটা ফেলতে পেরেছিল। ছাপটা পড়েছিল সাগরের মনে। সে তার প্রিয় লেখিকার একটা ছোট্ট নামও দিয়েছিল। তার ডায়েরীর পাতায় পাতায় লেখার মাঝে নামটা দেখা যেত। দুই অক্ষরের ছোট্ট নাম - ‘নদী’। কারণ নদীর মনে যে নদীটা ছিল সেটা শান্তই থাকত। আবার স্রোতও ছিল নদীতে। স্রোতের এই ধাক্কাটাই সাগর অনুভব করত। সাগর যত বড়ই হোক সে এই ধাক্কাটা অনুভব করতে পারত। হয়তোবা এই যুগেও চিঠি চালাচালির প্রভাবেই।
৪.সাগর নদীকে অনুভব করতে পারত না। কিন্তু পেরেছে। তার সাথে নদীর জীবনের একটা মিল আছে। সাগরের বাবা-মা আলাদা হয়ে গিয়েছিল সাগর ছোট থাকতেই। সাগর তখন তার মামীর কোলে বড় হয়। মামীর কোন সন্তান ছিল না বলে সাগর খুবই আদর পেত। তবুও সে মৃত্যু কামনা করত।
নদী আর সাগরের পানিতে যে পার্থক্যটা থাকে সেটা সবার জানা। তেমনি লেখিকা নদী আর পাঠক সাগরের কাছেও পার্থক্য ছিল মৃত্যুর সংজ্ঞাটায়। সাগর মৃত্যু কামনা করত আর নদী ভাবত তাকে মারা যেতে হবে। সাগর হয়ত মারাই যেত কারণ তার কাছে জীবনের স্বাদটা সমুদ্রের পানির মতই লোনা ছিল। নদী সেটাতে বিষণণ্ণতার ছাপ এনে দিয়েছিল। এটাই ছিল নদীর দোষ। সে যখন সাগরের মনে পরিবর্তনই এনেছিল সেটা আনন্দের হলেই বা কি সমস্যা হত।
৫.পাপিয়া তখন জীবনের প্রথম বইটা লেখা শুরু করেছিল। বইটার নাম ছিল ‘অসমাপ্ত গল্প’। শেষ পর্যন্ত অসমাপ্ত গল্প রূপ নিল অসমাপ্ত জীবনে, অসমাপ্ত বইয়ে। এই বইটা লেখা শেষ করার আগেই পাপিয়া মারা গেল। এদিকে সাগর তখন চোখের নিচের কালি দূর করতে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যেত। কারণ পাপিয়ার সাথে দেখা করার পূর্বপ্রস্তুতিগুলোর একটা ছিল এটা। কিন্তু এই কাজটাও অসমাপ্ত থেকে গেল। সাগর যার কাছ থেকে জীবন নিয়ে ভাবতে শিখেছিল সেই আবার ওকে মন থেকে জীবনের চিন্তা বাদ দিতে শিখাল। সাগর কে তখন প্রকৃতির সমুদ্র কাছে টানতে লাগল। যাহোক সাগর সমুদ্র দেখতে গেল। ওখানে সাগর সূর্যাস্ত দেখল। কখোন আবার সমুদ্রের বুকে নদীর পানিকে বৃষ্টি হয়ে ঝরতে দেখল। দেখতে দেখতে সাগর বিলীন হল সমুদ্রে।
হ্যাঁ, সাগর বিলীন হল সমুদ্রে।
৬.সমুদ্র অনেক বড়। সমুদ্র অনেকেই দেখেছে; অনেকেই তাকে ভালবাসে, কেউ বা ভয় পায়। সমুদ্র নিয়ে কত গবেষণা হয়, কত আবিষ্কার হয়। তবে একটা জিনিস কখনই আবিষ্কার হবে না। সেটা হল সমুদ্র এখনও নদীর ধাক্কা অনুভব করছে, এবং করবে। এগুলো হল সমুদ্রের কথা। তবে সাগরের যে কি হল সেটা আমি আর বলতে চাইনা। আমি চাই আমার গল্পটাও অসমাপ্ত থাকুক।
(সেই অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় এটা লিখেছিলাম। লেখাটির গঠনমূলক সমালোচনা পেলে খুশি হব।
লেখাটি পূর্বে ব্লগে প্রকাশ করা হয়েছে।)
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মে, ২০০৮ রাত ১:৪৫