somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বৃষ্টিবন্দি

০১ লা অক্টোবর, ২০১৫ রাত ১১:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


অতিপ্রাকৃত গল্পের ব্যাপারে আমার আকর্ষণ অনেক, যদিও এমন কিছু বাস্তবে ঘটে নি আমার সাথে। কেউ যখন বলে খুব আগ্রহ নিয়ে শুনি। এসব গল্পের বড় সুবিধা হচ্ছে, সত্য না মিথ্যা তা নিয়ে ভাবতে হয় না, গল্প আর বলার ধরনেই অতিপ্রাকৃত গল্প গুলো শোনার আনন্দ। ভূমিকা আর বড় করছি না। আমার গল্পে চলে যাই।


আমি তখন সদ্য পাশ করা ডাক্তার। সদ্য পাশ করা তাই একটু গায়ে হাওয়া বাতাস লাগিয়ে নিচ্ছি। কিছুদিন পর উচ্চতর পড়াশোনা শুরু করতে হবে। হাওয়া বাতাস লাগানোটা খুব একটা হৈ-চৈ রকমের হলো না। আমার এক কাছের বন্ধুর বাড়ি গেলাম। ২/৩ দিন থাকলাম তারপর না হয় অন্য কোথায় যাবো এরকমই ইচ্ছা।
যে সময়টার কথা বলছি সেটা ১৯৯৭ সাল। বর্ষাকাল। গ্রামটার পাশে বেশ বড় নদী আছে, একটা ছোট বাজারের মত আছে, বাজারটা আমার বন্ধুর বাড়ি থেকে ১০ মিনিটের পথ। যা হোক, আমার গল্পের পরিধি এই বাজার আর নদী ঘিরেই।
প্রথম দিন কাটলো আমার নদীর পাড়ে হেঁটে আর বসে থেকে, মাঝে বাজারে গিয়ে চা খেয়ে আসা। নদীর পাড়ে একটা ভাঙ্গা বাড়ির মত আছে, সেটার বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখতেও ভালো লাগে। আমি ভিজছি না কিন্তু চারপাশে আঝোর ধারা! আর দ্বিতীয় দিন কাটালাম বাড়িতে খেয়ে আর বাজারে ঘুরে।

ঐ চায়ের দোকানী, গণি হোসেন, বেশ গল্পবাজ মানুষ। একের পর এক গল্পে আটকে রাখতে পারেন। সখ্যতা গড়ে উঠতে সময় লাগলো না। বলা বাহুল্য, আমাদের গল্পের অনেকটা জুড়ে থাকতো অতিপ্রাকৃত গল্প গুলো। স্ত্রী মারা গেছেন অনেক আগে। বাড়ি নাই, নদী নিয়ে গেছে। এখন দোকানেই রাত কাটান। বিছানা বালিশ খাট রাখা দোকানের ভেতরের দিকটায়।


“আমি আগামীকাল চলে যাচ্ছি”। চায়ের কাপ নামিয়ে রাখতে রাখতে বললাম, “আপনাদের গ্রামটা অনেক ভালো লেগে গেছে”।
“চইলা যাবেন? আপনার সাথে গল্প কইরা আরাম লাগে। চইলা গেলে চা-নাড়া ছাড়া কোন কাম থাকবো না”।
“কেন? আপনার গল্প কেউ শোনে না নাকি? এত ভালো গল্প বলেন”।
গণি সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, কিছু বললেন না। মনে হয় বলতে চাইছেন না।
“আচ্ছা, আসি আজকে। কাল যদি আসতে পারি যাওয়ার আগে একবার, দেখা করে যাবো”। উঠে দাড়ালাম।
“কালকে অবশ্যি আইসেন। আপনারে একটা গল্প শোনামু। সত্য ঘটনা”। খানিকটা আনমনে বললেন গণি সাহেব।
“নিশ্চয়ই আসবো”


যদিও আমার ইচ্ছা ছিল না আবার গণি সাহেবের গল্প শুনতে যাওয়ার, কিন্তু বন্ধু ফিরোজ জানালো গাড়ি ম্যানেজ করতে বিকাল হবে। বৃষ্টিতে রাস্তার অবস্থা খারাপ। বাড়ি বসে থেকে কোন কাজ নেই, গণি সাহেবের আমন্ত্রণ রক্ষা করাই যায়।
বাড়ি থেকে বের হয়ে কিছু দূর আসতেই বুঝলাম বের হওয়া ভুল হয়েছে। আকাশ কালো করে ফেলেছে। গত কয়দিন থেকেই তুমুল বৃষ্টি। একবার শুরু হলে থামতে চায় না।
দ্রুত পা চালালাম, বৃষ্টি যেন আমাকে তাড়া করে নিয়ে চললো গণি সাহেবের দোকানে। যেন দেরী করা যাবে না। অনেক কিছু অপেক্ষা করে আছে সেখানে। সময়ের হেরফেরে সব ভণ্ডুল হয়ে যাবে।


দোকানের চালের নিচে ঢুকতেই বৃষ্টি আছড়ে পড়লো টিনের চালে।
“কেমন আছেন?” কথা চাপা পড়ে গেল টিনের চালে ভারী বৃষ্টি পাতে।
তবে গণি সাহেব কথা বুঝেছেন। মাথা নেড়ে বসতে ইশারা করলেন। দোকানের ভেতর থেকে এসে চা বানাতে বসলেন।
“আপনার গল্প শুনতে এলাম”। গণি সাহেব অপ্রস্তুত হাসি দিলেন।
ভ্রু কুচকে গেল, “শোনাবেন না?”
“জ্বি, শোনাবো। চা খাইয়া নেন আগে”।
চায়ে চুমুক দিতেই গণি সাহেবের গল্প শুরু হলো।

“গ্রামে বছরে বছরে মেলা বসে, জানেন তো। বৈশাখ মাসে। ঘটনা দুই বছর আগের, মেলার দিন সন্ধ্যার। পোলাপাইন সারাদিন মেলায় মেলায় ঘুইরা সন্ধ্যার দিকে নদীতে গোসল করতে গেল। আমিও গেছিলাম, এত মানুষ দেইখা আইসা পড়লাম, ভাবলাম সন্ধ্যার পর নামমু।
আমি আসলাম সন্ধ্যার পর। দেখলাম একটা বাচ্চা পোলা নদীতে নামতেছে, আশপাশে কেউ নাই। সব তখন চইলা গেছে। আমি জিগাই,

“তোমার লগে কেউ নাই?” পোলায় কিচ্ছু না কইয়া ইশারা করে, বোবা। সে পানিতে নামে। আমিও কিচ্ছু কইলাম না আর। সন্ধ্যার পর পানিতে বেশীক্ষণ থাকা ঠিক না, বুঝছেন। পানির দেও আছে। কতক্ষণ হইলো? এই মনে করেন ২/৩ মিনিট। হঠাৎ শুনি "আল্লাহ গো" কইয়া চিক্কুর। ঝটকায়া পেছনে তাকাই... দেখি পিচ্চি পোলাটারে কে জানি পানি থেইকা উপরে তুইলা আবার আছড়ায়া ফালাইতেছে পানিতে”।
গল্পের এই পর্যায়ে আমি থামিয়ে দিলাম, “বাচ্চাটা চিৎকার করছিলো?”
“জ্বি”
“সে না বোবা?”
“জানের ভয়ে দিছে, দেও পরীর হাতে মরা আর সাধারণ মরা এক জিনিস না। ভয়ে চিক্কুর বাইর হইছে”।


আমি এই ব্যাপারে আর তর্কে গেলাম না। গল্পে “কিন্তু” ঢুকে গেছে। কিন্তু, আমার নীতি অনুযায়ী, এইসব গল্প শুধু শুনে মজা নেয়ার, কিন্তু মনে আনা যাবে না। কিন্তু, এসে পড়ছে। সরানো যাচ্ছে না।
“আচ্ছা, তারপর কি হলো?”
“আপনে মনে হয় বিশ্বাস করতেছেন না চিক্কুরের কথা? ইন্সপেক্টর সাব সাক্ষী, তিনি একটু দূর দিয়াই যাচ্ছিলেন। চিক্কুর শুইনাই নদীর দিকে আগাইছেন। আমি পাড়ের কাছে ছিলাম, কোন মতে জান নিয়া উইঠা দেখি বাচ্চাটারে লইয়া যাইতেছে দূরে। ইন্সপেক্টর আর আমি চোখ বড় বড় কইরা শুধু দেখলাম। বাচ্চাটারে নিয়া গেল”।
গণি সাহেব চুপ করে গেলেন।


আমি মনে মনে একটু হতাশ হলাম। এই গল্পের জন্য আসলাম? চারপাশ সাদা করে বৃষ্টি হচ্ছে। টিনের চালে প্রচন্ড শব্দ। মানুষজন উধাও, মনে হচ্ছে পৃথিবীতে শুধু গণি সাহেব, আমি আর বৃষ্টির প্রচন্ড শব্দ আছে। আর কিছু নেই।

“পরের দিন সন্ধ্যায় লাশ ভাইসা উঠলো নদীতে। যে জায়গায় নিছিলো, ঐ জায়গায়”। আবার বলে উঠলেন গণি সাহেব।
“জ্বি!" আমি চায়ের কাপ রাখলাম, "লাশ ভেসে উঠলো?”

ঠিক সে সময় ভিজে অবস্থায় প্রায় দৌড়ে এসে ঢুকলেন দুইজন পুলিশ। ইউনিফর্ম দেখে বুঝা গেল একজন ইন্সপেক্টর আরেকজন কনস্টেবল।
গল্পে বাধা পড়লো।


“গণি, চা দাও ২ টা। পুরা ভিজ্জা গেছি গা রে” ইন্সপেক্টর সাহেব আমাকে লক্ষ্য করেন নি তখনও। “আর এইটা রাখো” বলে একটা ছোট কাগজ মোড়ানো প্যাকেট দিলেন গণি সাহেবকে।
চোখে পড়ার মত ব্যস্ত হয়ে উঠলেন গণি সাহেব, প্যাকেটটা ক্যাশ বক্সে ঠেলে দিতে দিতে বললেন, “ইনি একজন ডাক্তার, গ্রামে বেড়াইতে আইছেন। আজকে চইলা যাবেন”।
ইন্সপেক্টর সাহেব তাকালেন আমার দিকে। বেশ বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। সুদর্শনও।

“আসসালামুয়ালাইকুম, আড়ালে বসছেন তাই খেয়াল করি নাই আপনাকে। ভালো আছেন?”
“ওয়ালাইকুম সালাম। জ্বি, ভালো”।
“আপনার নাম?”
“আসিফ আনোয়ার। গণি সাহেবের গল্প শুনছিলাম। আপনি নাকি উনার সাথে ছিলেন বাচ্চাকে পানির দেও টেনে নিয়ে যাওয়ার সময়?”
ইন্সপেক্টর সাহেব কড়া চোখে তাকালেন গণি সাহেবের দিকে, গণি সাহেব মাথা নিচু করে চা বানাচ্ছেন। একটু যেন আড়ষ্ট।
কনস্টেবল উৎফুল্ল হয়ে উঠলো, “জ্বি, স্যার নিজের চোখে দেখছেন। পরের দিন ডেড বডি পাওয়া গেছিলো ঐ জায়গায়। আমরাও দেখছি। চোখ যেন মনে হইতেছিলো বাইর হইয়া যাইবো, মুখ কুচকাইয়া তাকাইয়া আছে, দেখলেই ডর লাগে। হাত পা ক্যামনে জানি ভাঁজ হইয়া শক্ত হয়ে গেছে”।
ইন্সপেক্টর সাহেব নিঃশব্দে চায়ে চুমুক দিচ্ছেন, গণি সাহেব চুপ করে বসে আছেন।
“আচ্ছা! তারপর?”
“আহারে, ফুটফুইট্টা বাচ্চাটা”। কনস্টেবল চুপ হয়ে গেলেন। দোকানে কোন শব্দ নেই আর। পরিবেশ হালকা করার জন্য বললাম, “হু, পানি খেয়ে ফুটুফুটে হয়ে গেছিলো!”
কনস্টেবল আনমনে বলে, “নাহ, পানি টানি খায় নাই, দেও টাইনা নিছিলো। পানি খাওনের সময় কই?”
ইন্সপেক্টর সাহেব শব্দ করে চায়ের কাপ রাখলেন। গণি সাহেব কেঁপে উঠলেন কেন জানি। বেখেয়ালেও এত জোরে কাপ রাখার কথা না।
“গণি, তোমার গল্পের অভাব পড়ছে?” ধমকে উঠে গেলেন ইন্সপেক্টর সাহেব। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বের হয়ে গেলেন দোকান থেকে।
“কিছু মনে কইরেন না, স্যার নরম মনের মানুষ। ঘটনাটা ভুইলা থাকতে চান”। বলে কন্সটেবলও পিছু নিলো স্যারের, ভারী বৃষ্টি সাদা হয়ে পড়ছে। তারা হারিয়ে গেল তার মাঝে।

হঠাৎ এমন করলেন কেন ইন্সপেক্টর? নিতান্তই একটা তুচ্ছ গল্প, যেটার ফাঁক অনেক, চাইলেই ধরিয়ে দিয়ে গল্প নষ্ট করে দেয়া যায়।
“পোস্ট মর্টেম হইছিলো?”
“কার না কার পোলা, দেও মারছে, তারে লইয়া কে দৌড়াইবো? তারে কবর দিছে নদীর পাড়ে”। গণি সাহেবের মাঝে প্রাণচাঞ্চল্য উধাও হয়ে গেছে।

আমার কেন যেন অস্থির লাগছে। গল্পটা ঠিক মত বানানো হয়নি, অনেক অনেক ফাঁক গল্পে। গণি সাহেবের সাথে যায় না। কিন্তু, ইন্সপেক্টর কনস্টেবল সাক্ষী দিয়ে গেছে যা ঘটনা সব সত্য। তাহলে, কি সমস্যা!

“গণী সাহেব” বৃষ্টির দিক থেকে চোখ সরাই না, যেন উত্তর হারিয়ে যাবে চোখ সরালেই।
“হু”
“সিগারেট দিন তো একটা”
সিগারেট ধরাতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম আমার হাত কাঁপছে। প্রচন্ড শব্দ বৃষ্টির।

বৃষ্টির মাঝেই দেখলাম একটা বাচ্চা ছেলে বেশ ধীরে সুস্থে দোকানের সামনে আসলো। নয় বা দশ বছর হবে বয়স। আমি তার দিকে তাকিয়ে বসতে ইশারা করলাম, বসলো আমার পাশে।
“গণি সাহেব, এক কাপ চা দিন। মেহমানকে খাওয়াই”। হাসি হাসি মুখ করে বাচ্চাটার দিকে তাকালাম। মায়াকারা চেহারা। চুপ করে আছে। কি যেন একটা বিশেষত্ব আছে তার মাঝে। ধরতে পারলাম না।
আমার হাত ধরলো। চমকে উঠার মত ঠান্ডা হাত, অবশ্য যা বৃষ্টি ঠান্ডা হতেই পারে। ছ্যাত করে উঠলো বুক। বিশেষত্বটা কি আমি ধরতে পেরেছি। ছেলেটা একটুও ভিজেনি। আমি আড়ষ্ট হয়ে গেলাম। আমার কানের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিস করলো সে দু’টো শব্দ।
আমি তখন ঘোরের মাঝে। ছেলেটা উঠে গেল, বের হয়ে হারিয়ে গেল বৃষ্টির মাঝে।
জীবনের প্রথম অতিপ্রাকৃতিক ঘটনা ঘটে গেল, বুঝতে পেরেও শিহরিত হলাম না, মাথায় চিন্তার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর কোন কিছু অযথা হয় না। এই ঘটনাও অযথা হয়নি।


কতক্ষণ এভাবে ছিলাম জানি না। গণি সাহেবের ভাষ্য মতে, আমি নাকি সিগারেটে দুই টান দিয়েই সামনের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, ঘোরের মাঝে ছিলাম মনে হয়েছে উনার কাছে। আমি নাকি এর মাঝে আরও দুই বার সিগারেট চেয়ে নিয়েছি। কিন্তু, আশ্চর্য্যের ব্যাপার, আমার এসব কিছুই মনে হচ্ছে না। আমার মনে হচ্ছে, সিগারেট শেষ হওয়ায় আগুনের ছ্যাক লেগে হুশ ফিরেছে।
আমি বললাম, “একটু আগে একজন এসেছিলো দোকানে। দেখেছেন?”
“এই বৃষ্টিতে কে আইবো! ভূত দেখছেন নাকি?” গণি সাহেব হেসে উঠলেন, “আপনে এই গল্পরে এত মনে নিবেন ভাবি নাই। চিন্তার কিছু নাই এইটা শুধু গল্প”।
চুপ থাকলাম। যেটা দেখেছি, সেটা শুধু আমিই দেখেছি। তার মানে তাহলে অন্য কিছু, যেটা শুধু আমার সাথেই হলো।


“আরেকটা সিগারেট দিন তো”। লক্ষ্য করলাম এখন আঙ্গুল কাঁপছে না। নার্ভ শান্ত হয়ে এসেছে।
বৃষ্টির বেগ কমতে শুরু করেছে। মনে হয় বিকাল হয়ে গেছে। আকাশ মেঘে ঢাকা তাই বুঝা যাচ্ছে না।
সিগারেটে জোরে টান দেই। কিছু ভাবতে পারছি না আসলে। এটা নিতান্তই একটা গল্প, কিন্তু, ফিসফিসানি কথাগুলোর পর কেন জানি একটা ভাবনা চলে আসছে মাথায়।
“গণি সাহেব, ইন্সপেক্টর সাহেব কি দিয়ে গেলেন আপনাকে?”
“ওহ! এইটা তো গিসরিন। আমার হাতের চামড়া শুকনা তো, ফাইটা যায়। তাই তিনি আমারে স্নেহ কইরা দেন। অনেক দামী ওষুধ”।
“গ্লিসারিন?”
“ঐরকমই হইবো”।

আস্তে আস্তে টেনে নিচ্ছি সিগারেটের গরম ধোঁয়া।
“গণি সাহেব, চিৎকার শুধু আপনি আর ইন্সপেক্টর শুনলেন। আর কেউ শুনলো না?”
“আর কেউ ছিল না তো”।
“মানে, আপনি, ইন্সপেক্টর আর বাচ্চাটা ছাড়া সেখানে কেউ ছিল না এবং বাচ্চাটা চিৎকার করেছিল”।
গণি সাহেব অস্ফুটে বললেন, “হু”
“বাচ্চাটার ডেড বডি পাওয়া যায় পরদিন নদীতে”।
“হু”
“ডেডবডি দেখে মনে হচ্ছিলো প্রচন্ড ভয় পাওয়া, ডেডবডি পানিতে ফুলে ছিল না”।
“হু”
“মানুষ হঠাৎ আতংকে মারা গেলে ঠিক যে অবস্থায় থাকে সে অবস্থাতেই শক্ত হয়ে যায়, আস্তে আস্তে শক্ত হওয়ার মত কিছু ঘটে না। পানিতে ডুবে মারা গেলে, সাধারণত হাত পা ছড়ানো থাকে। আর মারা যাওয়ার ব্যাপারটা বুঝে ফেলা যায় আগে ভাগে, তাই সেক্ষেত্রে আর এরকম শক্ত হয় না”।
গণি সাহেব চুপ করে থাকলেন।
“পোস্ট-মর্টেম না করে কবর দেয়া হলো”।
“হু”
“আপনি বুঝতে পারছেন, পুরো ব্যাপারটা থেকে আমি কি বাদ দিয়েছি?”
“জ্বি না”
“পানির দেও’কে বাদ দিয়েছি। পানির দেও’কে বাদ দিলে কি দাঁড়ায় বুঝতে পারছেন?”
“আপনি কি বলতে চাইতেছেন? আমরা মারছি বাচ্চাটারে?”
“আমি কিছুই বলি নাই এখনও। আপনি কেন ধরে নিলেন আপনাদের খুনি ভাববো?”
গণি সাহেব চুপ করে থাকলেন। প্রচন্ড বৃষ্টির শব্দের মাঝেও একটা অস্বস্তিকর নীরবতা।

আরেকবার সিগারেটে কষে টান দিলাম। গণি সাহেব আমার প্রিয় মানুষগুলোর একজন সেটা বুঝতে পারছি, কিন্তু কথা গুলো এখন আমাকে বলতে হবে।

“গণি সাহেব, আমার ধারণা ইন্সপেক্টর সাহেবের সাথে আপনার স্নেহের বাইরে অন্য কোন সম্পর্কও আছে”।
“এসব আপনে কি বলতেছেন”! রীতিমত চিৎকার করে উঠলেন গণি সাহেব।
“স্নেহের বাইরে শত্রুতার সম্পর্কও তো হতে পারতো। আপনি এভাবে উত্তেজিত হলেন যে? ধরে নিতে হচ্ছে, আমার অনুমান সঠিক”।
আমি শান্ত থাকলাম, কথাটা বলে ফেলেছি, এখন আর থামা যাবে না।

“মনে হয়, সেদিন মেলায় আপনারা বাচ্চা ছেলেটাকে পান। হতে পারে হারিয়ে যাওয়ায় পুলিশের সাহায্য চেয়েছিল ইন্সপেক্টরের কাছে। নদীর পাড়ের দিকে ভাঙ্গা বাড়ির দিকটায় কেউ যায় না। সেখানে ইন্সপেক্টর সাহেব নিয়ে গেলেন বাচ্চাটাকে, সাথে আপনিও থাকলেন। কারণ, যে কাজটা এখন হতে যাচ্ছে সেটা আপনারা নিজেদের মাঝে করে অভ্যস্ত। প্রচন্ড যন্ত্রণার শেষে তাকে খুন করা হয়। খুন কেন করা হলো সেটা হতে পারে ঘটনা প্রকাশ পাওয়ার ভয় বা পারভার্সন। তবে ভয়ের সম্ভবনাই বেশি। ডেডবডির বর্ণনা শুনে মনে হচ্ছে, তাকে ভয় দেখিয়ে মারা হয়েছে। বাচ্চা মানুষকে ভয় দেখিয়ে মারলে সব চেয়ে বড় সুবিধা আঘাত করা লাগে না।
ঠান্ডা মাথায় গল্প সাজালেন। পানির দেওয়ের গল্প। গ্রামের মানুষ বিশ্বাস করলো। এসব রহস্য তারা খুব পছন্দ করে। পরদিন ঐ সময় পানিতে ডেডবডি পাওয়া গেল। মানুষজনের আর সন্দেহ রইলো না দেওয়েরই কাজ। আপনারা সময় বুঝেই ফেলেছিলেন। এরকম বেলা হিসেব করে নিশ্চয়ই খুনি লাশ ফেলবে না। এই স্বাভাবিক ভাবনার সুযোগ নিলেন আপনারা। ইন্সপেক্টর পোস্ট-মর্টেম এড়িয়ে নিলেন”।


গণি সাহেব এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমিও তাকিয়ে থাকলাম। নার্ভ হারানো যাবে না এখন, সিগারেটে টান দেই আবার।
“কি দেখিয়ে ভয় দেখানো হয়েছিলো?”
“সাপ”।


“আপনি এ গল্প কেন করতে গেলেন? কেন বললেন একটা সত্য ঘটনা বলবেন? এটা আড়ালে পড়ে গেলে কেউ জানতেও চাইতো না। ইন্সপেক্টর সাহেব আপনাকে নিষেধ করেছেন, তারপরও আপনি এ গল্প করেন, কেন?”
গণি সাহেব কিছু বলছেন না।


“আমি একটা কারণ বলি, আপনি বাচ্চাটাকে হত্যার পক্ষপাতি ছিলেন না। আপনি একা এই দুঃসহ বোঝা বইতে পারছেন না। হয়তো চাইছিলেন, কেউ জানুক, গল্পের নামে কিছু আগাছা লাগিয়ে সত্যটাকে জানিয়ে আপনি হালকা হতে চাইছিলেন”।
“আপনি কি সবাইরে বইলা দিবেন?” ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করলেন গণি সাহেব।
সিগারেট ফ্লোরে পিষতে পিষতে বললাম, “আমার কথা মানুষ কেন বিশ্বাস করবে? এসব আমার অনুমান মাত্র”।
বৃষ্টি ধরে গেছে প্রায়। এখানে আর থাকা সম্ভব না, ভিজে ভিজেই যাওয়া যাক। “আসি। ভালো থাকবেন”।
গণি সাহেব কিছু বললেন না।


ঐ গ্রামের সাথে আমার কোন আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই। তাই আর যাওয়া হয় নাই সেখানে, যাবোও না হয়তো কোন দিন। সেদিনের মত আজকেও চারপাশ সাদা হয়ে বৃষ্টি হচ্ছে, রাস্তা-ঘাট ডুবে আছে পানিতে। হাসপাতালে যেতে পারছি না।
বৃষ্টিবন্দি।


টিং টং! কলিং বেলের শব্দে ঘোর ভাঙ্গে। দরজা খুলে হতভম্ব হয়ে গেলাম। গণি সাহেব!
“আপনি! বাসা চিনলেন কিভাবে!”
“জ্বি, ভালো আছেন?"
"জ্বি, তা আছি। কিন্তু..."
গণি সাহেব কথা বলেই যাচ্ছে, আমি থেমে গেলাম, "চলে যাবার আগে ভাবলাম দেখা করে যাই”।
"গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন?"
তিনি কিছু না বলে হাত বাড়িয়ে দিলেন। আমি এক ঘোরের মাঝেই হাত ধরলাম। ঠান্ডা হাত, গণি সাহেব ভিজেন নি। আমি চমকালাম না এইবার।
যেন এটাই হবে ভেবেছিলাম।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা অক্টোবর, ২০১৫ রাত ১১:৩২
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অণু থ্রিলারঃ পরিচয়

লিখেছেন আমি তুমি আমরা, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৭


ছবিঃ Bing AI এর সাহায্যে প্রস্তুতকৃত

১৯৪৬ কিংবা ১৯৪৭ সাল।
দাবানলের মত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে।
যে যেভাবে পারছে, নিরাপদ আশ্রয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। একটাই লক্ষ্য সবার-যদি কোনভাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পেইন্টেড লেডিস অফ সান ফ্রান্সিসকো - ছবি ব্লগ

লিখেছেন শোভন শামস, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:১৯

"পেইন্টেড লেডিস অফ সান ফ্রান্সিসকো", কিংবা "পোস্টকার্ড রো" বা "সেভেন সিস্টারস" নামে পরিচিত, বাড়িগুলো। এটা সান ফ্রান্সিসকোর আলামো স্কোয়ার, স্টেইনার স্ট্রিটে অবস্থিত রঙিন ভিক্টোরিয়ান বাড়ির একটি সারি। বহু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিরোনামহীন দুটি গল্প

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৫

গল্প ১।
এখন আর দুপুরে দামী হোটেলে খাই না, দাম এবং খাদ্যমানের জন্য। মোটামুটি এক/দেড়শ টাকা প্লাস বয়দের কিছু টিপস (এটা আমার জন্য ফিক্সড হয়েছে ১০টাকা, ঈদ চাদে বেশি হয়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

এশিয়ান র‍্যাংকিং এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান !!

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:২০

যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী 'টাইমস হায়ার এডুকেশন' ২০২৪ সালে এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে। এশিয়ার সেরা ৩০০ তালিকায় নেই দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়।তালিকায় ভারতের ৪০, পাকিস্তানের ১২টি, মালয়েশিয়ার ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজত্ব আল্লাহ দিলে রাষ্ট্রে দ্বীন কায়েম আমাদেরকে করতে হবে কেন?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:০৬



সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ২৬ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৬। বল হে সার্বভৈৗম শক্তির (রাজত্বের) মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) প্রদান কর এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) কেড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×