somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ময়মনসিংহ জেলার কয়েকটি উপজেলার একটি স্বতন্ত্র ঐতিহ্যবাহী খেলা ‘হুমগুটি’

১৭ ই জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ৮:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া কিছু খেলা গ্রামাঞ্চলের মানুষ এখনো ধরে রেখেছে যুগ যুগ ধরে। সেরকমই একটি খেলা ময়মনসিংহের ঐতিহ্যবাহি 'হুমগুটি' খেলা।
‘হুমগুটি’। ময়মনসিংহ জেলার কয়েকটি উপজেলার একটি স্বতন্ত্র ঐতিহ্যবাহী খেলা। এতে থাকে হাজারো মানুষের অংশগ্রহণ। সারা দেশের অন্য কোথাও এ খেলা হয় কীনা জানা যায় না। তবে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা, ফুলবাড়িয়া, কোতোয়ালীসহ পার্শ্ববর্তী উপজেলাগুলোতে এ খেলার প্রচলন রয়েছে।

প্রচলন:
শতাধিক বছরের প্রাচীন এ খেলাটি প্রবর্তন করেন মুক্তাগাছার তৎকালীন ষোল হিস্যার জমিদার। হুমজিক্যালি কাড়াকাড়ি করে নিজের আয়ত্তে একটি গুটি নেওয়া হয় বলেই এই খেলার নাম হুমজিক্যালি গুটি বা হুমগুটি। জমিদারদের নানাবিধ শোষণের দিক থেকে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে রাখতে এই খেলার প্রচলন করা হয় বলে অনেকের ধারণা। আবার কারো কারো মতে, জমি নিয়ে জমিদারদের মধ্যে বিরোধ হলে শক্তি পরীক্ষার জন্য হুমগুটি খেলার প্রবর্তন করা হয়।

আঞ্চলিক শব্দে ‘হুম’ মানে শক্তি বা আজগুবি কিংবা বৃহৎ কোনো বিষয়। আর ‘গুটি’ হলো গোলাকার বস্তু বা খেলার জন্য ব্যবহৃত কোনো উপকরণ। আমন ধানের ফসল ঘরে উঠার পর মাঠ থাকে পতিত। তখন খোলা মাঠে এই খেলা জমে উঠে। বিশেষ করে ফাল্গুন ও চৈত্র মাসে এ খেলা বেশি হয়ে থাকে।

খেলোয়াড় সংখ্যা:
মজার ব্যপার হল, এ খেলায় অংশ নেয়ার জন্যে খেলোয়াড়েরা নির্দিষ্ট সংখ্যা, বয়স, উচ্চতা বা অন্য কোনো মাপকাটি নেই। জাতি, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল বয়সের পুরুষ এ খেলায় অংশ নিতে পারে। এমনও দেখা গেছে এ খেলায় একই সঙ্গে ২০-৫০ হাজার লোকও অংশ নিয়েছে।

খেলার উপকরণ:
এ খেলার উপকরণ হচ্ছে একটি বড় আকারের গুটি। যাকে বলা হয় ‘হুমগুটি’। পিতলের কলসির মাথার অংশ কেটে ফেলা কলসির ভিতরে চিনি, গুঁড় অথবা বালুমাটি দিয়ে ভরাট করা হয়।
কলসির মুখ ঝালাই করে বন্ধ করে পরে সেটিকে চটের বস্তা দিয়ে মুড়িয়ে নিয়ে সুতলি দিয়ে বিশেষ কৌঁশলে পেঁচিয়ে দেয়া হয়। ফলে কলসি ফেটে গেলেও কোনো খেলোয়াড়ের আঘাত পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। এভাবে ‘হুমগুটি’ প্রস্তুত হয়ে যায়। আবার অনেক সময় কলা গাছের গুঁড়ি, নারিকেলকাঠ কেটে গোল করে ‘গুটি’ তৈরি করা হয়। যা আকারে একটি ফুটবলের তিন গুণের কাছাকাছি।



খেলার স্থান/ মাঠ:
সাধারনত, কোন পতিত জমিতে গুটিটি রেখে খেলা শুরু করা হয়। কিন্তু এর মাঠের কোন সীমানা নেই!!! আমন ধানের ফসল ঘরে উঠার পর মাঠ থাকে পতিত। তখন খোলা মাঠে এই খেলা জমে উঠে। বিশেষ করে ফাল্গুন ও চৈত্র মাসে এ খেলা বেশি হয়ে থাকে। এমনকি এক উপজেলা থেকে অন্য উপজেলাও এই গুটি টি চলে আসে খেলতে খেলতে। মাইল এর পর মাইল মাঠজুড়ে এই খেলা হয়। তবে এক্ষেত্রে সবার সজাগ দৃষ্টি থাকে কারো কোনো ফসল বা গাছপালা নষ্ট না হয়।


খেলা শুরু:
পূর্ব নির্ধারিত স্থান, দিন তারিখ অনুযায়ী বিভিন্ন অঞ্চল থেকে খেলোয়াড় এসে জমায়েত হয়। মাঠে আয়োজক কমিটির লোকজন ‘হুমগুটি’টি নিয়ে হাজির হলে খেলোয়াড়েরা মাঝখানে ‘গুটি’ রেখে সবাই গোল হয়ে হাত তালি দিতে থাকবে। এসময় ওপর দিকে মুখ করে একজন ‘আ -- বা -- দে --রে—’ বলে উচ্চ স্বরে ডাক দিবে। এসময় অন্য সকলে দাঁড়িয়ে এক সঙ্গে বলবে, ‘হিওঁ’। এটাকে খেলায় ‘আবা’ দেয়া বলে।

এভাবে ‘আবা’ চলবে কমপক্ষে তিনবার। এসময় খেলায় অন্যান্য পক্ষ সুবিধা মতো স্থানে একত্রিত হয়ে পূর্বের ন্যায় একজন ‘ফিরের আ ---বা --দে –রে-’ বলে উল্টো ‘আবা’ দেবে। এক্ষেত্রে অন্য সবাই বলবে “হিওঁ।”। একে ফিরের ‘আবা’ বলা হয়। এভাবে খেলা স্থলের চতুর্দিকে থেকে ভেসে আসা ‘আবা’ আর ফিরের ‘আবার’ ধ্বনি-প্রতিধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠে পুরো এলাকা।

এ অবস্থায় খেলা শুরু হয়। খেলার শুরুকে বলা হয় ‘গুটিছাড়া’। কমিটির লোকজন মিলেই খেলতে থাকেন প্রথমে। তখন ‘গুটিছাড়া’ হয়েছে শোনে অন্যান্য পক্ষের লোকজন খেলায় অংশ নিতে থাকে। এসময় কমিটির লোকজন খেলা ছেড়ে খেয়াল রাখে কোনো পক্ষ যেন ‘গুটি’টি বেশি দূর নিয়ে যেতে না পারে। আর তেমনটা হলে তারা আবারো খেলায় অংশ নিয়ে নিজেদের গণ্ডির ভেতর ‘গুটি’ রাখার চেষ্টা করে।

এভাবে খেলা চলতে থাকে। বাড়তে থাকে খেলোয়াড়ের সংখ্যা। এক এলাকা থেকে খেলা ভিন্ন এলাকায় চলে যেতে পারে। খেলায় লোক সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পেতে বিশ-পঞ্চাশ হাজার পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে। তখন ‘গুটি’টি কোথায় আছে তা বুঝা অনেকটা কঠিন হয়ে যায়। নিজেদের দিকে ‘গুটি’ নিতে একজন আরেক জনকে শক্তির জোরে ধাক্কা দিতে থাকে। তবে এক্ষেত্রে সবার সজাগ দৃষ্টি থাকে যেন কেউ ব্যথা না পায়।


খেলার সময়সীমা:
এই খেলার খেলোয়াড়, মাঠের সীমানার যেমন কোন ঠিক নাই তেমনি এর সময়েরও কোন ঠিক নেই!!! এমনও হয় এ খেলা তিন-চার দিন পর্যন্ত চলতে থাকে। আগের দিনে গ্রামের লোকজন মিলে খেলোয়াড়দের খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করে।

ফলাফল নির্ণয়:
খেলতে খেলতে ‘গুটি’টি কোনো বাড়িতে নিয়ে লুকিয়ে ফেলা হয়। একে ‘গুটিতোলা’ বলে। আর গুটিতোলা হয়ে গেলে খেলা শেষ হয়ে যায়।

যার বাড়িতে ‘গুটি’ উঠানো হবে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে সবাইকে চিড়ে, মুড়ি, গুড়, চিনি খেতে দেবে। অনেক সময় পরবর্তীতে গরু জবাই করে এলাকার সকলকে নিয়ে ভুড়িভোজের ব্যবস্থা করা হয়। পরের দিন এলাকার যুবকরা দলবেঁধে ঢোল পিটিয়ে হুমগুটি সঙ্গে নিয়ে সারা এলাকা ঘুরে বেড়ায়। এ খেলায় জিতে যাওয়াটাকে এলাকার সম্মান হিসেবে ধরা হয়। তবে বর্তমানে বিজয়ীদের গরু অথবা টেলিভিশন দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়ে থাকে।

খেলোয়াড়-ই দর্শক, দর্শক-ই খেলোয়াড়



***ছবিগুলো নেট থেকে নেওয়া
৪টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×