আসল ভ্রমণ শুরু হবে রাত দশটায় 'দার্জিলিং মেইল' ট্রেনে যা শিয়ালদহ স্টেশন থেকেই ছাড়বে। তার আগে একটা ঘড়ি কিনতে হবে (নিজের জন্য না, শিলিগুড়ি নিবাসী আমার এক দাদার জন্য গিফট হিসাবে)। সময় বেশি নেই, তাই স্টেশনের সুপরিসর রেস্টরুমে হাত মুখ ধুয়ে তারাতাড়ি উবারে চেপে বসলাম রওনা দিলাম ঘড়ির দোকানের উদ্দেশ্যে। কোন জায়গায় দোকান কিছু জানিনা, গুগল মেপে 'টাইটান শোরুম নিয়ার মি' সার্চ দিয়ে সবচেয়ে কাছের শোরুম এর উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছি। জায়গামতো পৌছে দেখি সেখানে আশেপাশে কোন ঘড়ির দোকান নেই; অগত্যা উবার ছেড়ে দিলাম। অচেনা শহর রাতের কলকাতায় জীবনে প্রথম বার, হাতে সময়ও কম - সব মিলিয়ে কেমন একটা থ্রিলার টাইপের অনুভূতি হচ্ছিল। যাই হোক আশেপাশের দোকানের লেখা দেখে বুঝলাম জায়গাটার নাম রাধাবাজার। বেশিরভাগ দোকান তখন বন্ধ হয়ে গেছে, একটা সিরামিক এর দোকান খোলা পেয়ে জিজ্ঞাসা করে জানলাম ঘড়ির দোকান আরো সামনে, বড়বাজার নামক জায়গায়। রিকসা বা বাসে যাওয়া যায় সেটাও বলে দিলেন। উনাকে বাংলায় জিজ্ঞাসা করলেও উত্তর দিলেন হিন্দিতে। যাইহোক হিন্দি বেশ ভালোই বুঝি ও বলতে পারি তাই কোন অসুবিধা হয়নি কথাবার্তা চালাতে। হঠাৎ দেখলাম একটা বাস আসছে আর কন্ডাক্টর বিভিন্ন জায়গার নামের সাথে বড়বাজারও বলছে। পড়িমরি করে বাসে উঠে পরলাম, সাত রূপি দিয়ে বড়বাজার নামলাম বেশ দ্রুতই। সেখান থেকে ঘড়ি কিনে উবার নিয়ে যখন শিয়ালদহ স্টেশনে পৌছলাম তখন প্রায় সাড়ে নয়টা বাজে। ট্রেন ছাড়তে আধাঘন্টা থাকলেও প্ল্যাটফর্ম এতো বেশি আর বড় যে তখনই ট্রেনের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। 9A প্লাটফর্ম এ তৈরি ছিল দার্জিলিং মেইল, যাওয়ার সময় চার্টে নিজের নামটাও দেখে নিলাম। ভারতীয় রেলে দূরপাল্লার ট্রেনগুলোতে যাত্রার আগে চার্ট তৈরি করা হয় যেখানে সেই ট্রেনে যেসব যাত্রী ভ্রমণ করতে পারবেন তাদের নাম ও সিট নাম্বার দেয়া থাকে। যেহেতু ভারতীয় রেলে দুই মাস আগে থেকে অগ্রিম টিকেট কাটা যায়, অনেক যাত্রী টিকিট ক্যানসেল করে, ওয়েটিং টিকিট কাটা যায় এবং ট্রেন ছাড়ার দিনেও 'ততকাল' ব্যবস্থায় টিকিট করা যায় তাই এই চার্টের ব্যবস্থা। যাহোক ট্রেনে উঠে পড়লাম আমাদের নির্দিষ্ট বগিতে, সেটি ছিল একটি 3AC বগি মানে ৩*৩ এসি স্লিপিং কোচ। এখানে বলে রাখা ভালো আমি বাংলাদেশ থেকে ক্রেডিট কার্ড দিয়ে নিউ জলপাইগুড়ি - কলকাতার রিটার্ন টিকিট করতে পারলেও কলকাতা - নিউ জলপাইগুড়ির টিকিট কিছুতেই করতে পারছিলাম না ওই সময়ে ফরেন ক্রেডিট কার্ড পেমেন্টে আইআরসিটিসি এর সার্ভার সংক্রান্ত জটিলতার জন্য। তখন শংকর দা আমাদের যাওয়ার টিকেট করে দিয়েছিলেন 'ততকাল' ব্যবস্থায় যাওয়ার ঠিক আগের দিন। ভারতীয় রেলে খাবার বেশ ভালো দেয়া হয় এটা জানতাম তাই রাতের খাবার ট্রেন থেকেই নিবো এমনটাই প্ল্যান করেছিলাম। কিন্তু সাধারণ আলাপচারিতায় কলকাতার এক বাবুমশাই এর কাছে জানলাম এটি একেবারে রাতের ট্রেন বিধায় কোন ক্যাটারিং সার্ভিস নেই, লোকজন বাড়ি থেকে খেয়ে আসে বা খাবার নিয়ে আসে। ঘড়িতে সময় তখন রাত ০৯ঃ৪৫, ১৫ মিনিট আছে ট্রেন ছাড়তে। কিন্তু না খেয়ে কিভাবে থাকবো সারা রাত, দৌড়ে চলে গেলাম দূরের ফুড কোর্টে, স্যান্ডউইচ কেক পানি নিয়ে ট্রেনে উঠার ৬০ সেকেন্ড এর মাথায় ট্রেন ছেড়ে দিল। হালকা শীতের মাঝেও, এসির নিচেও তখন আমি ঘামছিলাম - যদিও অল্প কিছুখন পরেই সস্তি অনুভব করতে লাগলাম দার্জিলিং মেইল এ প্রথমবার ভ্রমণ করার উদ্দীপনায়।
দার্জিলিং মেইল সেই ব্রিটিশ আমল থেকে কলকাতা - জলপাইগুড়ি রুটে চলাচল করছে। ১৯২৬ সালের দিকে দার্জিলিং মেইল পূর্ণাঙ্গভাবে যাত্রা শুরু করে এবং ট্রেনটি তখন বাংলাদেশের (তদানীন্তন পূর্ব বাংলা) উপর দিয়েই চলাচল করত। তখন এর রুট ছিলঃ শিয়ালদহ - রানাঘাট -ভেড়ামারা - হার্ডিঞ্জ ব্রিজ - ঈশ্বরদী - সান্তাহার - হিলি - পার্বতীপুর - নীলফামারী - হলদিবাড়ি - জলপাইগুড়ি - শিলিগুড়ি। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হয়ে ভারত পাকিস্তান দুই দেশের জন্ম হবার পরেও দার্জিলিং মেইল এই রুটেই চলাচল করেছে ১৯৬৫ সালের পাক ভারত যুদ্ধ পর্যন্ত। এর পর এই ট্রেনের রুট পরিবর্তন হয়ে বর্ধমান - মালদা - কিষাণগঞ্জ দিয়ে পুরোপুরি ভারতের অভ্যন্তরে চলে যায় এবং শতবর্ষ পেরিয়েও এই ট্রেন তার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। যাহোক সহযাত্রীদের সাথে পরিচয় হল - অনেকেই মালদা নামবে, বাকিরা জলপাইগুড়ি। বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে বেশ আগ্রহের সাথে কথাবার্তা বললো; অনেকের পূর্ব পুরুষের বাড়ি বাংলাদেশে এবং ১৯৪৭ এ তারা ভারতে পাড়ি জমিয়েছে। মাঝে টিকেট চেকার এসে সবার নাম জিজ্ঞাসা করলেন এবং তার কাছে থাকা লিস্টের সাথে মিলিয়ে দেখলেন। মাঝেমধ্যে তিনি আইডি কার্ড/পাসপোর্টও চেক করছিলেন (ভারতীয় রেলে এভাবেই টিকেট চেক হয়, টিকেট দেখাতে হয়না কিন্তু যাত্রীর নাম পরিচয় দেখা হয় যাতে বিনা টিকিটে এবং অবাঞ্চিত কেউ ভ্রমণ করতে না পারে)। ট্রেন তখন বেশ স্পীডে যাচ্ছিলো, রাতের খাবার খেয়ে আমার জন্য নির্ধারিত আপার বার্থে এ উঠে শুয়ে পড়লাম। প্রতিটি বার্থ এ ধবধবে পরিস্কার কভার সহ বালিশ, বেড কভার, কম্বল, কম্বলের কভার দিয়েছে। সারাদিনের ভ্রমণ ক্লান্তির কারণে ঘুমের সাগরে ঢলে পড়তে একদমই সময় লাগলো না। রাতটা বেশ নিরূপদ্রক কেটে গেল, ভোর ৬: ৩০ এর দিকে ঘুম ভাংগলো। একটু শীত শীত লাগছিলো, জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি কুয়াশার চাদর ভেদ করে তীব্র গতিতে ছুটে চলেছে ট্রেন। আর শুয়ে থাকতে ইচ্ছা হলোনা, ফ্রেশ হয়ে নিচের বার্থ এ বসলাম, বেশিরভাগ লোকজন তখন উঠে পড়েছে। বাইরের প্রকৃতি দেখছিলাম, হঠাৎ ফোনে মেসেজের শব্দ। ফোন হাতে নিয়ে দেখি বাংলাদেশের সিমে আসা কয়েকটি মেসেজ, গ্রামীণফোনের ফুল নেটওয়ার্ক। বুঝলাম বাংলাদেশ বর্ডারের খুব কাছ দিয়ে যাচ্ছে ট্রেন। শিয়ালদহ - নিউ জলপাইগুড়ি ৫৭২ কিলোমিটার পথে এই ট্রেন মাত্র ৪ টা স্টপেজ দেয়ঃ বর্ধমান, বোলপুর শান্তিনিকেতন, মালদা, কিষাণগঞ্জ। আলুয়াবাড়ি রোড নামক একটি স্টেশন (ট্রেন দাড়ায় না ওখানে) পার হবার কিছুক্ষণ পর দূরে দেখা দিতে লাগলো একগুচ্ছ পাহাড়। সহযাত্রীদের কাছে শুনলাম ওগুলো কালিম্পং এর পাহাড়, জলপাইগুড়ি বেশি দূরে নয়। আমরা শীত মৌসুম শুরু হবার কিছু আগে ভ্রমণ করছিলাম, সহযাত্রীরা বললেন কলকাতায় যখন খুব গরম পড়ে তখন বেশিরভাগ লোক দার্জিলিং যায় পাহাড়ে শীতল প্রশান্তি পেতে, তবে এই সময় কাঞ্চনজঙ্ঘা স্পষ্ট দেখতে পাবার সম্ভাবনা বেশি এটাও জানলাম। যাহোক ১০ ঘন্টার ট্রেন জার্ণি শেষ হল সকাল ৮ টায়, ট্রেন এসে পৌছলো নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে। বাতাসে বুনো পাহাড়ের গন্ধ আর হিম শীতল আবহাওয়া মনে করিয়ে দিলো 'কুইন অফ হিলস' দার্জিলিং আর বেশি দূরে নয়।
(ক্রমশ প্রকাশ্য)
আগের পর্বঃ Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে মে, ২০২০ রাত ৮:০৫