মেঘ পাহাড়ের দেশ দার্জিলিং এর নাম শুনলেই মনে জাগে শিহরণ - সুনীল, সমরেশ, সত্যজিৎ এর লেখনীতে যার সাথে পরিচয় সেই ছোটবেলায়। সেবার হঠাৎ অবসরে হয়ে গেল দেশের বাইরে প্রথম ভ্রমণ, তাও আবার দার্জিলিং; তাই শিহরণটাও ছিল অন্যরকম। ভ্রমণকালে আমি নিজেকে ট্রাভেলার ভাবতে পছন্দ করি, ট্যুরিস্ট নয়। একজন ট্রাভেলার নতুন কোন জায়গায় গিয়ে সে জায়গার লোকজন, পরিবেশ, স্থানীয় খাবার, সংস্কৃতি সব কিছুর সাথে মিশে যেতে পছন্দ করে, মানুষের জীবন, প্রকৃতিকে কাছ থেকে অনুভব করতে চেষ্টা করে। কিন্ত একজন ট্যুরিস্ট মোটামুটি আরাম, নিরাপত্তা ও কম সময় নিশ্চিত করে ঘুরতে পছন্দ করে, নতুন জায়গার মানুষ কিংবা সংস্কৃতির সাথে মেশা সেখানে মুখ্য থাকেনা। সেই কারণেই ঢাকা কলকাতা বাই এয়ার কিংবা কলকাতা - বাগডোগরা (শিলিগুড়ি এয়ারপোর্ট) বাই এয়ার এর বদলে বেছে নিলাম বেনাপোল হয়ে ভারতে ঢুকে ট্রেন ভ্রমণকে ।
বেনাপোল - পেট্রাপোলে বাংলাদেশ - ভারত দুই দেশের ইমিগ্রেশন কোন ঝামেলা ছাড়াই পার হলাম। টাকাকে রূপিতে কনভার্ট করার পর ২৫০ রূপি দিয়ে একটি ভারতীয় এয়ারটেল সিমকার্ড কিনে নিলাম, ইন্টারনেট ও টক টাইমও চালু হয়ে গেল প্যাকেজ অনুযায়ী (সিমটা যত্ন করে রেখেছি, পরে যখনই ভারতে গেছি এটি ব্যবহার করেছি)। এরপর শেষ বিকেলের কনে দেখা আলো সাথে নিয়ে অটো দিয়ে যশোর রোড ধরে যাত্রা শুরু হল বনগা রেলওয়ে স্টেশন অভিমুখে। যশোর থেকে বেনাপোল-পেট্রাপোল-বনগাঁ-হাবড়া-বারাসাত পার হয়ে কলকাতার শ্যামবাজার পর্যন্ত বিস্তৃত এই ১২৫ কিলোমিটারের যশোর রোড। রাস্তার দুপাশে প্রাচীণ সব গাছ শোভিত সুন্দর এই যশোর রোড দিয়ে ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধারা সীমান্ত পাড়ি দিয়েছেন, মানুষ ওপারে আশ্রয় নিয়েছেন। মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ এই যশোর রোড দেখে সেই সময় লিখেছিলেন তার বিখ্যাত কবিতা, ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। এসব কথা ভেবে শিহরিত হচ্ছিলাম আর সেই সাথে কাটাতারের দুই পাশে মানচিত্রের দুই দেশে কিভাবে চোখের নিমিষে সব বদলে যায় তা লক্ষ্য করছিলাম। সেই পরিবর্তন ধরা পড়ছিল রাস্তার পাশে দোকানের নামে, বিভিন্ন ব্যানার-সাইনবোর্ডে, যানবাহনে, লোকজনের পোশাক পরিচ্ছদ আর বাংলা ভাষার উচ্চারণে। বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে মাত্র ৩০ মিনিট লাগলো বনগাও রেল স্টেশন এ পৌছতে যা ভারতের পশ্চিমবংগের উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলায় অবস্থিত। ২০ রূপি দিয়ে টিকেট করে ট্রেনের অপেক্ষায় থেকে স্টেশনে বিকালের নাস্তা করে নিলাম আমূল এর কেক, চকলেট, থাম্বস আপ আর চা দিয়ে। ট্রেনের নাম বনগা লোকাল যা একদম ভোরবেলা থেকে গভীর রাত অবধি প্রায় প্রতি ৪০ মিনিট পর পর বনগা থেকে শিয়ালদহ যায় ও ফিরে আসে। পশ্চিমবংগের যোগাযোগ ব্যবস্থার একটি অন্যতম লাইফলাইন এই বনগা লোকাল যা চাকুরীজীবি মানুষ, ছাত্রছাত্রীদের পশ্চিমবংগের বিভিন্ন জেলা থেকে কলকাতা পৌছে দিচ্ছে অনেকগুলো বছর থেকে (০৮.০৮ এর বনগা লোকাল নামে তাপস পাল অভিনীত একটি বিখ্যাত মুভি আছে, দেখে নিতে পারেন)। প্রথমবার ভ্রমণ করছি বলেই হয়তো আমার কাছে এই ট্রেনে ভ্রমণ এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা হয়ে ধরা দিল। এই ট্রেনের ভিড় এবং লোকজনের সেই ভিড়েও যায়গা বের করা, তিনজনের সিট এ চারজন বসা, অর্ধেক রাস্তা যাওয়ার পর সিটে বসা যাত্রীকে দাড়াতে বলে দাড়িয়ে থাকা যাত্রীর বসা (যদিও আমাদের দাড়াতে হয়নি) ইত্যাদি বাংলাদেশের ঈদ সিজনের যেকোন ট্রেনের ভিড়কেও হার মানাবে। যাই হোক বিদ্যুৎ চালিত ইঞ্জিন সহযোগে এই ট্রেন মাত্র দুই ঘন্টায় ২০ টা স্টপেজ দিয়ে (এক স্টপেজে সময় ৪৫-৫৫ সেকেন্ড, এর মাঝেই উঠা নামা) প্রায় ৮০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে কলকাতা পৌছলো।
কলকাতা মানে সিটি অফ জয়, কলকাতা মানে শিয়ালদহ স্টেশন। আমাদের কমলাপুরের চেয়ে প্রায় পাচ গুণ বড় এবং দশ গুণ বেশি ভীড় দেখে আমার চক্ষু চড়কগাছ। নানা প্রদেশের নানা ভাষার মানুষ শুধু ছুটছে নিজ নিজ ট্রেন ধরার জন্য কিংবা ট্রেন থেকে নেমে নিজ গন্তব্যে যাওয়ার জন্য। এই বিশালতা আর ব্যস্ততার মাঝে নিজেকে কেমন ঘোর লাগা, জরা গ্রস্থ মনে হতে লাগলো। চারদিকে বিভিন্ন ট্রেনের লাগাতার এনাউন্সমেন্ট ( কৃপা ধ্যান দিজিয়ে/অনুগ্রহ করে শুনবেন....) একসময় আমাকে মনে করিয়ে দিল যে ঘড়িতে সময় রাত আটটা বেজে গেছে, পেটে ইঁদুর বিড়াল খেলা চলছে (সারাদিন ফাস্ট ফুড এর উপর আছি), শরীরটাও একটু আরাম খুজছে। আর আমার মাথা বলছে আসল ভ্রমণ এখনো শুরুই হয়নি আমাদের, তার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে এখনই, দেরি করলে বিপদ!
(ক্রমশ প্রকাশ্য)
পরের পর্বঃ Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে মে, ২০২০ রাত ৮:০৩