গত কয়েকদিন ধরে সংবাদপত্র, টিভি নিউজ ও ফেসবুক স্ট্যাটাস ঘিরে রয়েছিল দুটি ইস্যু। একটি হচ্ছে ফেসবুকের মাধ্যমে মানুষকে সেহরীর জন্য ঘুম থেকে উঠানো। আরেকটি হচ্ছে দ্বীনপ্রিয় রামাদান প্রেমিক মুসলিম ভাই-বোনদের বৃটেনের রাজকীয় বিয়ে নিয়ে উচ্ছাস, আক্ষেপ ও বাসনা।
আমার এক শুভাকাঙ্খী ছিলেন। বিয়ে নিয়ে তাহার সে কি বাসনা! পারলেতো আজ থেকেই শপিং ও গান-বাজনার চর্চা শুরু করে দেয়। তার উপর হালের প্রিন্স হ্যারী ও প্রিন্সেস মেগান-এর বিয়েতো আছেই। আমার অনেক মুসলিম বোনেরই আফসোস ইস্স্ সে যদি মেগান হইত কিংবা তাকে যদি হ্যারীর কোন রাজকুমার ভালবাসত। এই বিয়েতে মোট খরচ ছিল ৪৫.৮ মিলিয়ন ইউ এস ডলার। সরকার, রাজপরিবার ও মার্কেলের পরিবার মিলে সংস্থান করেছিল এই অর্থ। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো এই যে ব্রান্ড ফাইন্যান্সের তথ্য অনুযায়ী এই বিয়ে বৃটেনের অর্থনীতিতে ১.৪৩ বিলিয়ন ইউ এস ডলারের অর্থের জোগান দিবে। তবে তার কত অংশ বেচারা বলির পাঠা জনগণের কাজে আসবে তা সন্দিহান। এই বিয়ের সাথে আমাদের দেশের বর্তমান উচ্চ ও মধ্যবিত্তের বিবাহোত্তর সংবর্ধনার একটা মিল আছে। যে এর ফলে জামাইয়ের অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ ভারী হয়। এবং সে অর্থ কন্যার বাবার পকেট থেকেই যায়। আমার বাপজান যখন তার মেয়ের বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত তখন আমার ভাই বলছিল ইসস্ বোনটা যদি প্রেম করে পালিয়ে বিয়ে করত তাহলে পরিবারের কতোগুলো অর্থ বেচেঁ যেত। যতোদিন না পর্যন্ত আমার ভগ্নিপতি তার মেয়ের বিয়ের খরচ বহন করছেন ততোদিন তিনি আমার বাবা কষ্ট বুঝবেন না।
আমাদের দেশীয় বিবাহের কিছু চমৎকার সংস্কৃতির কথা আজ তুলে ধরব আপনাদের সামনে। বিবাহ এমন একটি ইবাদত যা কারো জন্য ফরয আবার কারো জন্য সুন্নত। চলুন দেখে নেয়া যাক যে মুসলমানরা বিবাহকে একটি ইবাদত মনে করে, সেই ইবাদত এদেশের মুসলিমরা কিভাবে পালন করছে।
কন্যা দেখতে জামাইয়ের বন্ধু-বান্ধব যেতে হবে অবশ্যই। কেননা নিজেদের জন্য একজন টেকসই, জুতসই, মর্ডার্ণ ভাবী নির্বাচন করা তাদের ইবাদতের মধ্যে পড়ে বলে তারা মনে করেন।
যেহেতু প্রশ্নটা সারা জীবনের সুতরাং নিজেদেরকে বুঝার, জানার ও দেখার জন্য কিছুদিন ঘোরাঘুরি করাই যায় নাকি? ইবাদতের পূর্বে এই ঘোরাঘুরিকে জায়েজ করতে নতুন কোন ফতোয়ার দরকার নাই এদের।
বিবাহই একমাত্র ইবাদত যেখানে আপনি গান বাজনায় মাতোয়ারা হতে পারবেন। ইবাদত সহযোগী চৌদ্দ জেনারেশনের পুরুষ-মহিলা একসাথে একটু নেচে গেয়ে এ্যালকোহল নিলে মন্দ হয় না। আর ইদানীংতো শুনলাম লেডি ডিজেও নাকি পাওয়া যাচ্ছে বাজারে।
আমার বউ দুদিন পরে আমি ছাড়া আর কেউ স্পর্শ করতে পারবেন না। কিন্তু শেষবারের মতো তাকে একটা সুযোগ দেয়াই যায় নাকি। তার দু’চারজন বন্ধ-বান্ধবী, চাচাতো ভাই-বোন, পাড়ার ছেলে-মেয়ে একটু হলুদ নিয়ে হাতে-গালে স্পর্শ করলে ইবাদত নষ্ট হবে না।
যেহেতু বুখারী শরীফের হাদীসে (৫১৪৭) আছে বিবাহের খবর ব্যাপকভাবে প্রচার করতে হবে ও এরপর আকদ অনুষ্ঠানের অতিথিদের মাঝে খেজুর বন্টন করতে হবে সেজন্য আমরা লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে তিন-চারদিন আলোকসজ্জ্বা করে হাজারখানেক লোককে লক্ষ টাকার খাবার নষ্ট করার পাশাপাশি আপ্যায়ন করি। আর ছবি তোলা ও ভিডিও করা একটি আদি প্রথা হয়ে দাড়িয়েছে। "বউ আমার তবে দেখবে পুরো বিশ্ব" এই শ্লোগান কে সামনে রেখে দম্পতির হাতের ছবি আংটি সহ, পায়ের ছবি আলতা সহ, মুখমন্ডলে ছবি পাউডারসহ আপলোড না দিলে মোদের নিকাহ নামক ইবাদত কবুল হয় নাহ।
হাদীসে আছে (আবু দাউদ ২১০৬) সামর্থ্য অনুযায়ী মোহর ধার্য করতে হবে সেজন্য আমারা আগত অতিথিদেরকে লোকদেখানো বিরাট সামর্থ্য অনুযায়ী বিশাল অংকের বাকি টাকা রেখে মোহর ধার্য্য করি।
যেহেতু মুসলিম শরীফের হাদীস (১৪২১) না মানলেও আমাদের ইবাদত চলে সুতরাং ছেলে পক্ষ হতে অবশ্যই আমাদেরকে একজন ইযন পাঠাতে হবে সাক্ষী হিসেবে।
কনেকে একবারে বিদায় দেয়া হচ্ছে এবং সে যাবার সময় যতোটুকু বাবার কাছ থেকে আদায় করে নিতে পারে সেটাই তার লাভ। আর বেচারা জামাই যতো বেশী বরাযাত্রী নিয়ে এসে কনের বাবার বোঝা বাড়াতে পারে ততোই তার লাভ। এক্ষেত্রে দু’একটা হাদীসের ভ্রুক্ষেপ না করলেও চলবে। (বুখারী ২৬৯৭)।
হাদীসে বলা হয়েছে যে ওলিমায় গরীব মিসকিনদের দাওয়াত দেওয়া হয় না সে ওলিমা সবচেয়ে নিকৃষ্টতম ওলিমা। (আবু দাউদ ৩৭৫৪)। আরে ভাই নিকৃষ্টতম বলা হয়েছে হারামতো আর বলা হয় নাই। তাছাড়া এ যুগের গরিব-মিসকিন সে যুগের গরিবদের চেয়ে অনেক ভাল খায়। সুতরাং আগে নিজের পেট পূজা করে নেই তারপর যে খাবার ডাস্টবিনে যাবে সেটিকে তাদের খাদ্য হিসেবে ব্যবহারই সবচেয়ে ভাল ।
আজকাল বিয়ের অনুষ্ঠানে গেলে আপনি বুঝতে পারবেন না যে এটি মুসলমানের বিয়ে নাকি অন্য কোন ধর্ম্বালম্বীদের বিয়ে। বিয়ে আজ একটি ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকল অতিথি ও আপ্যায়নকারীদের জন্য একটি জাহিলায়তে পরিণত হয়েছে।
সমাপ্তি টানব শুধু দুটি বিষয় স্মরণ করিয়ে। সূরা জারিয়াতের ৫৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন 'আমি সৃষ্টি করেছি জিন এবং মানুষকে এ জন্য যে, তারা আমারই ইবাদত করবে। আপনি ও আমি যার ইবাদত করার জন্য সৃষ্টি হয়েছি তিনি অন্ধ বা বধির নন। তিনি অবশ্যই আমাদের সৎ ও অসৎ সব কর্ম সম্পর্কে অবগত আছেন। তিনি আল কুরানে সে ঘোষণা দিয়েছেন। "নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু শোনেন, সবকিছু দেখেন।"(সুরা নিসা- ৫৮)"তোমরা যা কর আল্লাহ তা দেখেন।" (সুরা আনফাল - ৭২)
রাসূল্লাল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহিওসাল্লামের এর বর্ণনা অনুযায়ী নিকাহ নামক ইবাদতের বৈশিষ্ট্য নিয়ে পরের ব্লগে আলোচনা করব ইনশাল্লাহ।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মে, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:২৮