somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটি কান্নার গল্প

১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ বিকাল ৩:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ভ্যানের প্যাডেল চাপার মতো শক্তি পাচ্ছে না কিশোর আশরাফুল। সেই সকালে বেরিয়েছে। এখন বাজে বেলা ১১টা। শরীর আর চলছে না। শক্তি পাচ্ছে না সে। বড়রা তাকে যে কাজ দেয় সে কাজই করে সে। কোথায়ও জার ভর্তি পানি পৌঁছে দেয়া, প্রেসের মাল ডেলিভারি দেয়া, কারো বাসায় চাল-ডাল পৌছে দেয়া কোন কাজে তার আপত্তি নেই। ভ্যান তার সঙ্গি।
পানির পাম্প থেকে জার ভর্তি করে হোটেলে নিয়ে যাচ্ছে। আশরাফুলের চোখের সামনে ভেসে ওঠল, মায়ের কষ্ট মিশ্রিত হাসি হাসি মুখ। তার মা ফকিরাপুলের বিভিন্ন মেস, দোকানে বাটি খাবার দেয়। ভোরে বাজার করে নিয়ে আসে। বাসায় রান্না করে বাজারের ব্যাগে বিশেষ কায়দায় বাটি সাজিয়ে দোকানে দোকানে খাবার দেয়। একটা সময় হাপিয়ে ওঠে। রাজ্যের ক্লান্তি ভর করে মুখে। বছরখানেক আগেও আশরাফুল মায়ের সাথে খাবার দিতে যেতো। ছোট একটা থলে থাকত তার হাতে। ২টা, ৩টা বাটি জায়গা নিতো সেখানে। এখন তার ছোট ভাই কে নিয়ে যায়।
‘খানকির পোলা গাঞ্জা খাইয়া রাস্তায় নামছ নাকি।’
রং সাইড দিয়ে আসা একটা মোটরসাইকেলে ঘষা খায় আশরাফুলের ভ্যান। খেকিয়ে ওঠে মধ্য বয়সী মোটরসাইকেলের চালক।
‘গালি দেন ক্যা, উলডা দিক দিয়া আপনি আইছেন’।
‘আবার কথা কছ। থাপরাইয়া দাঁত ফালাইয়া দিমু’।
‘আমি কি উলডা দিক দিয়া আইছি? মারবেন ক্যান?’
‘আবার কথা কছ’।
মোটরসাইকেল থেকে নেমে আশরাফুলকে থাপ্পর মারতে থাকে। তাদের ঘিরে অনেকে জড়ো হয়। কেউ কোন কথা বলছে না। চুপচাপ দেখছে সবাই। নিজেদের মধ্যে কথা বলছে কেউ কেউ। মূলত দোষী কে বুঝার চেষ্টা করছে অনেকে। কারো ভাষ্য, তুই ভ্যান চালাছ। হুণ্ডার সাথে টক্কর দিতে যাছ ক্যান? হুণ্ডার কিছু হলে ঠিক করতে পারবি? কেউবা আবার বলছে, আচ্ছা মতো দেও। বদের হাড্ডি। রাস্তায় নামলে হুস থাকে না।
হাত ঠাণ্ডা করে মোটরসাইকেলে ওঠে লোকটি। পাঞ্জাবিটা ঠিক করে মোটরসাইকেল চালু করে। মনে মনে ভাবল, কত প্রিপারেশন নিয়ে বের হলাম। মুডটাই নষ্ট করে দিলো। কত মানুষের সামনে কথা বলতে হবে। এমপি সাহেব আসবে।
আশরাফুল কাঁদতে কাঁদতে বলল, পারবেন তো আমগোর মতো গরিবগোর লগেই।
চোখ মুছতে মুছতে হোটেলের যাচ্ছে সে। তার সামনে ভেসে ওঠে ৩-৪ বছর আগের একটি দৃশ্য। স্মৃতির স্তুপ থেকে উঁকি দেয় দৃশ্যটি। তার বয়স ছয় কিংবা সাত। ফকিরাপুলের কাঁচা বাজারের কাছে খেলছে। যাত্রী নিয়ে আব্দুস সুবহান ফকিরাপুল মোড়ের কাছে একটি হোটেলের সামনে নামে। ভাড়া নিয়ে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে তাকে ধাক্কা দেয় যাত্রী। রাস্তায় পড়ে যায় আব্দুস সুবহান। মাল বোঝাই পিকআপ তার পায়ের উপর দিয়ে চলে যায়। পুরা ঘটনা আশরাফুলের চোখের সামনে ঘটে। দৌড়ে আসে সে। রক্তাক্ত বাবাকে ধরে কাঁদতে থাকে। বিনা চিকিৎসায় মারা যায় তার বাবা।
‘হালায় অমানুষ একটা। এমনে মারন লাগে?’
‘আহারে, পোলাডা ক্যামনে কানতাছে দেহো।’
কথাগুলো ভেসে আসল পাশের চায়ের দোকান থেকে। মোটরসাইকেল চালক চলে যাওয়ার পর ভিড় আস্তে আস্তে কমে গেছে। এ জগতে মানুষই সার্কাসের হাতি মানুষই রিং মাস্টার।
দুই
ব্যানার, স্টেজ দেখে সন্তুষ্ট আশরাফ আলী। ভাবল, টাকা ঠিক হাতেই গিয়েছে। ব্যানারের একপাশে ওর আশরাফ আলীর ছবি দেয়া। নামের সাইজটাও চোখে পড়ার মতো। শিশু দিবসে এতিমখানায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এমপি সাহেব আসবে দেখে ব্যানার, স্টেজ আরও টুকটাক খরচ সে দিয়েছে। এতিমদের খাওয়ার টাকা দিচ্ছে এমপি নিজে। এক সপ্তাহ ধরে বক্তব্য সাজিয়েছে। আসার আগে কয়েকশ’ বার বক্তব্য দিয়ে এসেছে।
‘বড় ভাই এসে গেছেন?’
‘হ্যাঁ, চলে আসলাম।’
‘কোন সমস্যা হয় নি তো?’
‘তেমন সমস্যা হয় নি। হুণ্ডার সামনে একটা ভ্যান এসে পড়ছিল। নেমে কষিয়ে কয়েকটা মারলাম।’
‘ভালো করেছেন। এমপি সাহেবের সাথে কথা হয়েছে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি এসে পড়বে।’
‘সমস্যা নেই। তুমি অন্যান্য বিষয়গুলো দেখো। আমি এখানে আছি।’
এমপি সাহেবকে ঘিরে নিয়ে আসছে, ১০-১২জন ছেলে। তিনি স্টেজে বসলেন। পাশের চেয়ারে আশরাফ আলী। আশরাফ আলীর গুণগান গেয়ে পরিচয় করিয়ে দেয় এমপির সাথে। অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। একে একে সবাই বক্তব্য দিচ্ছে। এমপির আগে বক্তব্য দিবে আশরাফ আলী। এক সময় তার ডাক আসে। মাইকের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। কাশি দিয়ে কথা বলা শুরু করে।
‘আসসালামু আলাইকুম। মহতি এই অনুষ্ঠানে এমপি সাহেব অংশগ্রহন করায় আমরা অত্যন্ত আনন্দিত। সামনে উপস্থিত সোনামনিরা, তোমরা আল্লার তায়ালার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য উপহার। তোমাদের দেখাশুনা করা আমাদের দায়িত্ব। তোমরা আমাদের সন্তান। তোমরা মন দিয়ে পড়াশুনা করবে। দেশের যোগ্য নাগরিক হবে। তোমরা এক সময় দেশের বিভিন্ন দায়িত্ব নিবে। আমরা সেই সোনালি দিনে অপেক্ষা করছি। আমরা চাই না কোন শিশু কাজ করুক। এখন ওদের কাজ করার সময় না। এখন পড়ালেখা করার সময়, খেলাধুলা করার সময়। যোগ্য হওয়ার সময়। সুবিধাবঞ্চিত সকল শিশুদের পড়ালেখার ব্যবস্থা আমরা করব। তারাও আমাদের সন্তান।’
এতিমখানার অনুষ্ঠানে পানি দেয়ার কাজ আশরাফুল পেয়েছে। হোটেলে পানি দিয়ে অনুষ্ঠানে আসে। পকেটে পলিথিন নিয়ে এসেছে। টাকা-পয়সা তো পাবেই, অনুষ্ঠানের খাবারও বাড়ি নিতে পারবে। খাবারের রুমে পানির জার সাজিয়ে রাখছে সে। পানি রেখে হল রুমে গেলো। টাকা নিতে হবে।
মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে কিছুক্ষণ আগে তাকে অন্যায়ভাবে মারা লোকটি। বক্তব্য শেষে হাততালি দিচ্ছে সবাই। অসহায়ভাবে সবার উপর চোখ বুলালো আশরাফুল। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বেরিয়ে গেলো সে।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ রাত ৯:৪৯
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মেঘ ভাসে - বৃষ্টি নামে

লিখেছেন লাইলী আরজুমান খানম লায়লা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩১

সেই ছোট বেলার কথা। চৈত্রের দাবানলে আমাদের বিরাট পুকুর প্রায় শুকিয়ে যায় যায় অবস্থা। আশেপাশের জমিজমা শুকিয়ে ফেটে চৌচির। গরমে আমাদের শীতল কুয়া হঠাৎই অশীতল হয়ে উঠলো। আম, জাম, কাঁঠাল,... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনের গল্প

লিখেছেন ঢাকার লোক, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৩৫

মাত্র মাস দুই আগে আমার এক আত্মীয়ের সাথে দেখা আমার এক বোনের বাড়ি। তার স্ত্রী মারা গেছেন তার সপ্তাহ দুই আগে। মক্কায় উমরাহ করতে গিয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমান

লিখেছেন জিনাত নাজিয়া, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:১২

" অভিমান "

তোমার ঠোঁটে বোল শিখেছি
তুমি আমার মা, কেমন করে
ভুলছ আমায় বলতে
পারিনা। এমন করে চলে
গেলে, ফিরে ও এলেনা। হয়তো
তোমার সুখেই কাটছে দিন,
আমায় ভাবছ না।

আমি এখন সাগর... ...বাকিটুকু পড়ুন

×