নেতাকে, আমলাকে, সাংসদকে ভাগ দিয়ে, একচেটিয়াভাবে টেন্ডার বাগিয়ে- আমরা ভার্সিটি বানাই। ভার্সিটির খাট কেনা থেকে শুরু করে হোস্টেল-রেস্তোরা বানানো- সব কিছুতে প্রভাব খাটিয়ে দুই নম্বরী করে লাভের ব্যবসা করি।
তারপর সেই ভার্সিটি থেকে পাশ করা গ্রাজুয়েটগুলোকে বলি, ৪ বছর বিনিয়োগ করে সরকারি নিয়োগ পরীক্ষার ফর্ম, বই, কোচিং, পরীক্ষায় যাওয়া-আসা, ইত্যাদির পিছনে টাকা খরচ করতে; যেখানে প্রতি ১০০ জনে বড়জোর ১০ জন চান্স পায়।
কিছু গ্র্যাজুয়েট নিজের গরজে আর কিছু পরের খরচে বিদেশ উড়াল দেয়; টিকতে পারলে থেকে যায়; তারা আবার দেশ নিয়ে কিছু বলতে গেলে উল্টা গালিও খায়।
অনেক গ্র্যাজুয়েট এদিক-ওদিক ধাক্কা খেয়ে শেষে কামলা খাটে, কেরানিসর্বস্ব অর্থনীতিতে ফাইল দিয়ে দিনে ৯ ঘন্টা মাছি-মশা মারে, বিদেশে বানানো পণ্য ও সেবার বিপণন ও বিক্রয় করে, এদিকের মাল ওদিকে বিক্রি করে টার্গেট এচিভ করে মালিককে লভ্যাংশ পাইয়ে দিয়ে মাসে মাসে বেতন আসা নিশ্চিত করে।
মান্ধাতার আমলের, ঘুণে ধরা, অকার্যকরী শিক্ষাপদ্ধতি থেকে ছেঁকেছুকে যেসব সম্ভাবনাময় প্রোডাক্ট বের হয়, তাদের একটা বড় অংশকে বেতন-সুবিধা-ক্ষমতার টোপ দিয়ে পোষ মানিয়ে, চুপ করিয়ে, হাত গুটিয়ে বসিয়ে রাখি। এই বসিয়ে রাখার স্কিমের নাম "বিসিএস"।
বাকিদের একটা বড় অংশ দেশে নিরুপায় হয়ে বা চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে নিজেদের ক্ষুধা ও পিপাসা মেটাতে বিদেশে গিয়ে উচ্চতর শিক্ষা, গবেষণা বা কর্মক্ষেত্রে যোগদান করে। চীন বা রাশিয়ার মত দেশগুলো দক্ষ ও মেধাবী জনশক্তি নিয়মিত আমদানি-রপ্তানি করে উন্নতির চাকা সচল রেখেছে, আমরা সেখানে ডজন ডজন সরকারি-বেসরকারি দপ্তর খুলে বিদেশে "দক্ষ কাজের লোক" রপ্তানি করি; আর নিজেরা ৬৫ হাজার কোটি টাকার "দক্ষ প্রকৌশল/প্রযুক্তি পেশাজীবি" আমদানি করি।
পলিটেকনিকগুলাতে বিনিয়োগও করি না, তাদের সম্মানও দেইনা, সমাজে পলিটেকনিকে পড়ালেখা করাকে নরমালাইজ/গ্লোরিফাইও করি না। অথচ, নিয়োগের সময় তাদেরকে প্রায়োরিটি দিয়ে ফ্যাক্টরির/প্রজেক্টের সব আসল কাজগুলা করাই, যার বেশিরভাগই কন্টাক্টারি কাজ। রাস্তা-ব্রিজ-বিল্ডিং কারণে-অকারণে বানিয়ে-মেরামত করে যেই সিন্ডিকেটগুলা কানাডার বেগমপাড়ায়, সুইস ব্যাংক এর ব্যালেন্স বা মালেশিয়ার সেকেন্ড হোম বানায়, তাদের কোম্পানিতেই ফরমায়েশ খেটে সন্তুষ্ট থাকে সেই মানুষগুলা, যারা হতে পারতো আধুনিক প্রযুক্তি ও প্রকৌশলভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ার কারিগর।
উপরদের বাদ দিয়ে বাকি আমরা যারা আছি, আমরাই মূলত দেশ চালাই। আমাদের কোন কাজ জানা লাগে না, ডিগ্রি লাগে না, ঘাম ঝরানো লাগে না, মাথা খাটানো লাগে না, পাবলিককে খুশি করা তেমন একটা লাগে না, মূলত আমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ, বাকিরা সংখ্যালঘু।
আমরা গলাবাজিতে ওস্তাদ। ফাঁকাফাঁকিতে, মিথ্যা ওয়াদা দেওয়াতে, লোকদেখানোতে। আমরা অতীতে কোন এক সময় বাঘ মেরেছিলাম, সেই বাঘের চামড়া দেখিয়ে দেখিয়ে আমরা এখন প্রতিরাতে বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধি।
আমরা মিউনিসিপালিটির ঝাড়ুদার থেকে শুরু করে দেশের একেবারে মাথা পর্যন্ত ছড়িয়েছিটিয়ে আছি। আমাদের ইশারা ছাড়া দেশে একটা পাতাও নড়ে না। যত উন্নয়নের ফিরিস্তি দিই আমরা, সবকিছুতে আমাদের প্রোফিট আছে, অংশীদারিত্ব আছে। আমাদের সরাসরি কোন ইনভলভমেন্ট লাগে না, আমরা দূর থেকে বসেই কোটি কোটি টাকার প্রজেক্ট থেকে অন্তত এক কোটি টাকা তো পকেটে ভরতেই পারি।
আমরা আমাদের নিজেদের মধ্যের কাওকেও ফাও কোন কিছু করে দিই না। দলের অভ্যন্তরীণ পোস্ট-প্রমোশন, চাকরির নিয়োগ-প্রমোশন, বিজনেস সেট আপ বা বিজনেস এক্সপ্যানশন, সবকিছুতে আমরা টেবিলের উপরে বা নিচ দিয়ে, গোলাপ বা গান দেখিয়ে কমিশন নিয়ে নিই।
আমরা আমাদের বানানো মেডিকেল কলেজ থেকে বানানো ডাক্তারদের চিকিৎসা নেই না বা মানি না; শত ঘাট ঘুরে শেষ পর্যন্ত ইন্ডিয়া বা সিঙ্গাপুরে গিয়ে ট্রিটমেন্ট করাই। আমরা আমাদের বানানো হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে পারি না বা যাই না। আমাদের টেন্ডার দিয়ে সেট-আপ করা হাসপাতালের যন্ত্রপাতি আমাদের নিজেদের রোগ নির্ণয় করতে পারে না, রোগ সারানো তো দূরের কথা। শুধু হাসপাতাল না, দেশের যেখানেই পারি, সেখানেই, লাগবে না- সেরকম জিনিস, বেশি দামে কিনে ভরিয়ে রাখি। অনেক ক্ষেত্রে, আমরা টাকা ভাগিয়ে নিই কোষাগার থেকে, কিন্তু জিনিসের অস্তিত্বই থাকে না। আবার অনেক সময় কেনা জিনিসের টাকা নিয়ে, সেই কেনা জিনিস আবার বিক্রি করে টাকা নেই। প্রতি বছর ত্রাণের কম্বল পাওয়ার পরে বিক্রি করে দেওয়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর লোকগুলোর মত; তারাও "আমাদের"-ই অংশ।
যা কিছু দেশের মানুষের দীর্ঘমেয়াদে উপকার করবে বা কাজে লাগবে, যা কিছু করলে মানুষের খরচ কমে যাবে, ঝামেলা কমে যাবে, সেসব আমরা আমাদের নীতিনির্ধারণী লেভেল থেকেই বাদ দিয়ে দিই। কারণ, ওসব করলে যেসব ব্যবসা মার খাবে, সেসব ব্যবসাতে ইতিমধ্যেই আমার ভাগীদারিত্ব আছে।
আমাদেরকে যে বা যারা কাজ পাওয়াতে সাহায্য করে, সাজা বা বিপদ থেকে বাঁচায়, তাকে বা তাদেরকে আমরা দুনিয়ার সব উজাড় করে ভালোবাসি, সমর্থন করি, পাশে থাকি। আমরা তারই লোক।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০২১ বিকাল ৪:২১