সকাল ৭.০০ টাঃ
“ফুলবাড়ি গেট,ফুলবাড়ি গেট। যারা নামবেন তারা উঠে আসেন” – বাসের সুপারভাইজার হঠাৎ করেই সক্রিয় হয়ে উঠল। সারারাত গাড়ির ঝাঁকুনিতে একটু ও চোখ বন্ধ করতে পারিনি। ভোরের দিকে মৃদু তন্দ্রা ভাব এসেছিল,সুপারভাইজারের ডাকাডাকিতে আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠতেই হল। বাস থেকে নেমে পড়লাম। ব্যাকপ্যাকটা নিয়ে হাঁটা ধরলাম কুয়েটের দিকে। শেষ যখন এই রাস্তা ধরে হেঁটেছি,তখন বয়সটা আরও বছর কয়েক কম ছিল,২ চোখ ভরা স্বপ্ন ছিল। আজ চোখ দুটো তেমনই আছে,শুধু স্বপ্নগুলো বিদায় নিয়েছে। কোনটা সত্যি হয়েছে,কোনটা অধরাই থেকে গেছে।
দেখতে দেখতে কুয়েট মেইন গেটে পৌঁছে গেলাম। এ সেই গেট যার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নির্মাণ কাজ আমরা দেখেছি। গেটে টাঙ্গানো ব্যানারে বড়ো করে লেখা – সমাবর্তন ২০১৩।
সকাল ১০ টাঃ
অডিটোরিয়াম এর ভিতরটা আগের থেকে আরও সুসজ্জিত হয়েছে। সেন্ট্রাল এসি লাগানো হয়েছে।
-“সব সময় মনে রাখবে তোমরা শুধু নিজেকে নয়,তোমার পরিবার,ক্যাম্পাস,দেশ কে রিফ্লেক্ট কর। তাই যেখানেই...............” ভিসি স্যারের বক্তব্য চলছে। কান বক্তৃতার দিকে থাকলেও আসে পাশে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছি সেই সব দস্যির খোঁজে যাদেরকে হারিয়ে ফেলেছিলাম বছর খানেক আগে।
-“EEE 07 এর অধিকাংশ স্টুডেন্ট ই মনে হয় এসেচে,কি রে কী বলিস ?” আমার বাম পাশে বসা মানুষটিকে জিজ্ঞেস করলাম।
-“হয় দোস্ত!” তার সেই প্রান জুড়ানো কোমল সুরে উত্তর দিল ওয়াহিদ। এবার ডান পাশের ভদ্রলোক আমার পেটে একটা খোঁচা দিয়ে বলল –“দোস্ত মিত্রের সাথে দেখা হইছে ? আমার সাথে দেখা হইছিল। তোমার কথা জিজ্ঞেস করল। এক্স-ডীন রফিক স্যার তোমার কথা জিগাইল,তুমি তো আবার স্যারের প্রিয় ছাত্র আছিলা।” খোঁচা দেয়া কিন্তু এখনো থামেনি উনার,খোঁচা আর গুতার চোটে আমার কাঁধ আর পেট ব্যাথা হয়ে গেল।
ইনি আমাদের খান সাহেব। আমার ভাণ্ডারেও কম নেই –“হ মাম্মা স্যার আমারে না তোমারে খুঁজছিল। তুমিই স্যারের প্রিয় শিষ্য আছিলা। আর সিমুলেশান ল্যাবে ম্যাটল্যাব করার জন্য তো তোমার অপেক্ষায় একজন বসে আছে সেই পুরানো দিনগুলির মত!”
ওয়াহিদ আর খান যেকোনো ইভেন্টে আমার যোগদানের পিছনে অন্যতম ভুমিকা রাখে। কোথাও যেতে না চাইলে আমাকে নিয়ে যাওয়ার ১০১ টা ফন্দি বের করে ওরা। But,I love these guys.
চোখ দিয়ে পুরা অডি চষে ফেলচি,এমন সময় চোখ থেমে গেল ৫/৬ টা সাক্ষাত শয়তানের অবস্থানের উপর। ওরা বসে আছে কয়েক সারি পরে। ওরা যেখানে থাকে সেখানে বাতাস (ধোঁয়ার জন্য) আর শব্দ (কিছু অতি উৎকৃষ্ট বাংলা শব্দের ঝংকারে) দুইই দূষিত হয়।
বাম থেকে- নিরক্ষর,নিলয়,Mr. C , AJM , মাসুদ তাসনিম,রাসিক,প্রবীন,শাওন,মুগ্ধ,সৈকত,নাভিদ,অনুপ, আজরাফ,তানভীর আর ইভটিজার নিজাম।
নিরক্ষরের সাথে আমার পরিচয় এনডিসি গ্রুপ ২ তে। কিঞ্চিত স্ক্রু ঢিলা হলেও পোলা ভাল। তার চেহারা দিয়ে জ্ঞান চুইয়ে চুইয়ে পড়ে,আর এজন্যই তো সেগুলো ওর মাথার ভিতর থাকলো না! সে এখনো কোন প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানে গোল্ডলিফ পাওয়া যায় না,সেখানে অরিস বা মার্লবরো গোল্ড খোঁজে কিনা কে জানে ?!!
Mr. C ........ইনি বিশিষ্ট লেখক এবং আমার কাছের বন্ধু। এর মাথায় আছে পৃথিবীর সমস্ত প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ আর চোখে আছে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন। কে জানে একদিন এমন কোন সফটওয়্যার বানিয়ে ফেলে কিনা যা দিয়ে আকাশ ছোঁয়া যাবে!
এসব কথা ভাবচি,এমন সময় AJM আমাকে দেখে হাত নাড়ল আর কী যেন বলল। শুনতে না পেলেও বুঝলাম –“হাই ডাবল এ!” নিন্দুকেরা একে কিঞ্চিত মেয়ে ঘেঁষা বললেও আমার ভাল লাগে। মোটের উপর ছেলে ভাল। তবে AJM এর স্পেসালিটি হল , ও কপাল(কপাল না বলে মাথার চাঁদি বলাই ভাল) নাড়াতে পারে!
মাসুদ তাসনিম। CR হিসাবে আমার যোগ্য(?) উত্তরসূরী ছিল থার্ড ইয়ারে। ওর জন্মদিনে কেকের উপর সেই HBD to Masud Tasnim লেখার কথা মনে আছে আজও।
রাসিক একটা রহস্যময় চরিত্র। ও যে কখন ক্লাসে আসত আর কখন বের হত কেউ দেখত না। কিন্তু উপস্থিতি থাকত ষোল আনা! ক্লাস পালিয়ে নজরুল হতে না চাইলেও ওর চুল কিন্তু নজরুলের মতই ছিল অনেকটা।
প্রবীন। ফার্স্ট ইয়ারে এই ছেলে হিটম্যান সেজে পারফর্ম করেছিল স্টেজে,মনে আছে। এবং আমার ক্লাসমেট দের মাঝে এর সাথে প্রথম কথা বলেছিলাম। তখন আমাদের ক্লাস হত বিজ্ঞান ভবনের গ্যালারীতে। ছেলেটা এককথায় ভাল।
নিজাইম্মা। বিশেষ গোপন সূত্রে পাওয়া সংবাদের ভিত্তিতে জানা যায় নিজাম আর অভিকের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কবলে পড়ে B2 এর একজন স্টুডেন্ট B1 এর সাথে ল্যাব করত!
এবার আসি আর্টিস্ট নিলয় এর প্রসঙ্গে। কী আর বলব ? সে এক সাথে অনেক কিছু! ক্রিয়েটিভ চিন্তা-ভাবনা।
দুপুর ১২.০০ টাঃ
অনুষ্ঠান শেষ। অডির সামনে প্রচণ্ড ভিড়। নাহ,এতক্ষনেও বিগ বয় এর দেখা পেলাম না। ওকেই মনে মনে খুঁজছি। হঠাৎ কানে এল –“স্বাভাবিক না?” বুঝলাম ওখানে B section এর মেয়েগুলার থাকার সমুহ সম্ভাবনা আছে,আর তাই ওখানে বিগ বয়ের ও থাকার সম্ভাবনা আছে। হ্যাঁ ঠিক তাই!দেখা মাত্র ওর সাথে কোলাকুলি করলাম জাস্ট লাইক দ্যা ওল্ড টাইমস। Mr. Sn এর সাথেও কোলাকুলি করলাম। বাকি ৪ জনের সাথে তো আর তা করা যায় না,তাই ওদের কুশল জিজ্ঞেস করলাম। এই ৪ রমনীর মাঝে একজনের কাছ থেকে ফার্স্ট ইয়ারে CT পিছানোর জন্য প্রায়ই ঘুষ হিসাবে চকবার আর কোণ খেতাম। নিন্দুকেরা বলে এদের কোন একজনের উপর নাকি আমি ফার্স্ট ইয়ারে ক্র্যাশ করেছিলাম। কেউ কেউ নাকি আমাকে হিন্দু এ্যাসোসিয়েশন এর একটা নবীনবরন অনুষ্ঠানে যেতেও দেখেছে,যদিও আমি হিন্দু নই!
-দোস্ত ফার্স্ট বুউউউউক............” জোরে চিল্লিয়ে উঠলেন এক ভদ্রলোক। কথাটা যে আমাকে বলা হয়েছে এবং কে বলেছে তা পিছনে না তাকিয়েই বুঝলাম।
-“আবির হলে যাবা না?” বলা নেই কওয়া নেই কোথায় থেকে ব্যাস্ত তালহার আগমন! তার ব্যাস্ততা একটুও কমেনি এই ১ বছরে। আরও মোটা হয়েছে ব্যাটা।
-“হ্যাঁ দোস্ত চল।
বিকেল ৩.০০ টাঃ
অমর একুশে হলের ২০৯(পশ্চিম) নাম্বার রুম। এ সেই চেয়ার-টেবিল,এ সেই বিছানা যা আমার কত শত দিনের আনন্দ বেদনার সঙ্গী ছিল। নস্টালজিক হয়ে পড়লাম মুহূর্তে। জুনিয়র গুলারে আর পেইন না দিয়ে রুমের সামনের বারান্দায় আড্ডা জমালাম। আমি,সত্যেন,মানিক,জনি,সাগর আর তালহা। যে সত্যেন বিয়ে করবে না বলে প্রতিজ্ঞা করেচিল,সেই সত্যেন বিয়ে করে ফেলেছে! একটা কথা মনে হচ্চে,ও তো দুধ বা দুধ দিয়ে তৈরি কিছু খেত না। এখন দুধ বিষয়ে ওর অভিমত কী সেটাই জাতির বিবেকের কাছে প্রশ্ন আজ। মানিককে জিজ্ঞেস করলাম –“কী রে তোর ভাবীদের কি অবস্থা?” হলে থাকার সময় মানিকের কথা বার্তার অধিকাংশ জুড়ে ছিল ওর ভাবিরা। উল্লেক্ষ্য ওর গ্রামের সমস্ত গৃহবধূই ওর ভাবি ছিল।
হঠাৎ সাগর বলে উঠল –“এহ হে আমার চুল সব পড়ে গেছে!” সাগরের মত সহজ সরল ছেলে এ যুগে খুব কম দেখা যায়। ওকে কোনোদিন রাগতে দেখিনি।
সন্ধ্যা ৭.০০ টাঃ
হোটেল রয়েল। EEE 07 এর গেট টুগেদার পার্টি। ১২০ জনের প্রায় সবাই উপস্থিত। একটা উৎসব উৎসব আমেজ। সাউন্ড সিস্টেমে বেজে চলেছে –“কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই .........। ”
কোথায় আছে,ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। ৩ ভদ্রলোক তাদের হাস্য রস দিয়ে যথারীতি মাতিয়ে রেখেছে সবাইকে। আসিফ,তনয় আর আমাদের মাসুদ। চুপি চুপি বলে রাখি,নিন্দুকেরা মাসুদকে রেডিও নামে ডাকতো। কোথাও মাসুদ আছে,আর সেখানে হাসি-তামাসা হবে না-এ ও কি সম্ভব?!
আজ এখানে প্রায় সবাই প্রতিষ্ঠিত। মজার ব্যাপার হল,কারো শখ ছিল টেলিকম সেক্টরে যাওয়া,সে গেছে পাওয়ার সেক্টরে। আর যার পাওয়ার ভাল লাগত না সেই গেছে টেলিকম সেক্টরে। কেউ কেউ অবশ্য কোনো ভার্সিটির টিচার হয়েছে।
এত মানুষের মাঝে বসে থেকেও মনে পড়ে ফেলে আসা দিন গুলি,মনে পড়ে যায় সেই ক্লাসে লেকচার না তুলে ঘুম, পিএল এলেই কারো লেকচার নিয়ে ফটোকপি করার ধুম,ল্যাব এবং ল্যাবের রিপোর্ট নিয়ে যত ২ নাম্বারি,ক্যাফেটেরিয়া,হল লাইফ,মধ্য রাতের পরটা-ডাল ভোজন আর তারার মতন বন্ধুদের মুখ গুলো। আজ সে সব অতীত হয়েচে,আমরা হয়েছি অতীত। সে সব আজ জুনিয়রদের কারোর দখলে। ঠিক যেন কুয়েট একটা ফুল বাগান,আমরা তার মালি আর আমাদের দেখা স্বপ্ন গুলো ফুলের কুঁড়ি। গান বেজেই চলেছে,
একই সে বাগানে আজ ফুটেছে নতুন কুঁড়ি
শুধু সেই সেদিনের মালি নেই .........
কত স্বপ্নের রোদ ওঠে এই কফি হাউসে
কত স্বপ্ন মেঘে ঢেকে যায়,কত জন এল গেল
কত জনই আসবে,কফি হাউসটা শুধু থেকে যায়!
**বিশেষ দ্রষ্টব্য :ইচ্ছা ছিল প্রত্যেকের সম্পর্কে কিছু না কিছু লিখব। কিন্তু স্থানাভাবে সকলের নাম গল্পে আনা গেল না। তার মানে এই নয় আমি তাদের মিস করব না।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুন, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:৫২