অনেক রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা।পেয়েছি সার্বভৌম একটি ভুখন্ড।একটি স্বাধীন দেশ।
একটাই স্বপ্ন ছিল আমাদের,নিজেদের ইচ্ছাশক্তির স্বাধীন প্রকাশ ঘটাব।কেউ আমাদের বাক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবেনা।কেউ আমাদের চলার পথকে রুদ্ধ করে দিয়ে,তাদের দেখানো পথে চলতে বাধ্য করবেনা।আমাদের চিন্তায় ,মননে,চর্চায় বাধাঁ হয়ে দাড়াবেনা।নিজেদের যা কিছু আছে সবটুকু নিজের ভেবেই এর যথার্থ ব্যবহার করব।
অনেক গুলো বছর তো আমরা অতিক্রম করে এলাম আমাদের স্বপ্নের ভুখন্ডটির সার্বভৌমত্ব অর্জনের দিন থেকে।চুয়ল্লিশ বছর প্রায়।আজো কি আমরা আমাদের স্বপ্নগুলোকে হাতে পেয়েছি?আমরা কি পেয়েছি মন খুলে কথা বলার স্বাধীনতা?আজো কি পেয়েছি নিজের ইচ্ছানুযায়ী চলার সরল পথটি,যে পথে বাধাঁহীন ভাবে চলা যায়?আমরা কি পেয়েছি অর্থনৈতিক মুক্তি ? না, পাইনি! শুধু যা পেয়েছি তা হল বিশ্ব মানচিত্রের বুকে আলাদা ভাবে দাগাঙ্কিত একটি নতুন মানচিত্র।এর বেশি কিছু নয়।আমাদের মনুষত্বের মুক্তির আকাঙ্খাগুলো এই স্বাধীন দেশেও মুখ থুবরে পরে গুমরে গুমরে কেদেঁ মরছে।
যখন পরাধীন ছিলাম সার্বভৌমত্বের অভাবে,এই পরাধীন জাতির মুক্তির লক্ষে এদেশের স্বাধীনতাকামি মানুষ বুকের রক্ত অকাতরে ঢেলে দিয়েছিল। তখন সে রক্তে কোন সাম্প্রদায়ীকতার রং ছিলনা,ছিলনা কোন বিভেদের গন্ধ।যা কিছুই তারা অর্পন করেছে সবটুকুই ছিল দেশের জন্য,মুক্তির জন্য।মননে,চিন্তায়,চেতনায়,প্রত্যয়ে একটি শব্দই প্রতিধ্বনিত হয়েছিল, এক দেশ,এক জাতি,এক সত্বা, আমরা আমাদের।
এখনও দেশের মাটি থেকে মুছে যায়নি রক্তের দাগ,উবে যায়নি ৭১এ ঝরানো রক্তের গন্ধ। আমরা হয়ে গেলাম হিন্দু,হয়ে গেলাম মুসলিম,হয়ে গেলাম বৌদ্ধ,হয়ে গেলাম খৃষ্টান,হয়ে গেলাম উপজাতি। শুধু বেমালুম ভুলে গেলাম এক আকাশের তলে,একই আলো বাতাসে জন্মানু,একই সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত,একই মাটির সন্তান আমরা সবাই বাঙালী।
বড় কষ্ট হয়! আজ এদেশের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে সাম্প্রদায়ীকতার উৎকট গন্ধে ভারী হয়ে আছে বাতাস। আমাদের কেউ আজ সংখ্যালঘু,আর কেউ সংখ্যাগুরু। প্রতিনিয়ত চোখের সামনে বিভেদের ঘুনপোকা কেটে কেটে বিভেদটাকে যেন ক্রমশই আরো করে তুলছে। চারদিকে এই কথিত সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত হচ্ছে সংখ্যা গুরুদের দ্বারা। এগুলো দেখার কেউ নেই !!! ৯০% সংখ্যাগুরুদের দেশে ১০% সংখ্যালঘুরা আজ আবর্জনায় পরিনত হয়ে আছে।তাই যত তারাতারি সম্ভব এসব আবর্জনা পরিষ্কার করে ফেলাই স্রেয়।
সরকারও আজ সংখ্যাগুরুদের দলে। দেশের সংবিধান থেকে শুরু করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সবাই মাথা নেড়ে সাই দিচ্ছে আমরা সংখ্যাগুরুর দলে।কি হবে দু-চার ঘর সংখ্যালঘুদের প্রটেকশন দিয়ে? ওরা বাঁচলেই কি মরলেই কি?ভোটের রাজনিতির পাশা খেলায় এরা যে বিজিত,ভুমিবাহীন। আর এরই ফলশ্রুতিতে প্রতিনিয়ত ভাঙাহচ্ছে,মন্দির,পেগোডা।প্রতিনিয়ত দেশ ছাড়ার হুমকি দেওয়া হচ্ছে,দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হচ্ছে।
এর একটাই মানে,এদেশ হিন্দুর নয়, বৌদ্ধের নয় ,এটা মুসলিমদের দেশ।এদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম।এদেশে মুসলিম ছাড়া কারো জায়গা নেই। এসব যখন চোখের সামনে ভেসে ওঠে তখনই মনের কোনে একটা প্রশ্ন উকি দিয়ে ওঠে,এই কথিত সংখ্যালঘুরা কোন দেশের জন্য যুদ্ধ করেছিল?কোন দেশকে অন্যের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য রক্ত দিয়েছিল,কোন দেশের জন্য সংখ্যালঘু নারীরা দিয়েছিল সম্ভ্রম?এর কোন উত্তর কেউ দিতে পারেনি ,এর কোন উত্তর হবারও কথা নেই।তবুও এরা সংখ্যালঘুই থেকে যাবে,তবুও এদের খুন করা হবে, তবুও এদের জায়গা-জমি দখল করে,মন্দির,বাড়ি-ঘর ভেঙে দিয়ে বলা হবে-এদেশ ছেড়ে দে! এটা তোদের দেশ নয় ,তোদের দেশ ভারত!!!! হায়রে স্বাধের স্বাধীনতা! হায়রে স্বাধের বাংলাদেশ!
কদিন আগেই জগৎজ্যোতি দাশের জীবনি পড়ছিলাম,কত দেশপ্রেম,কত আত্মত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত এই মহান মানুষটি কতটা নিষ্টুরভাবে নিজের জিবন উৎসর্গ করে দিল।আজ মনে হচ্ছে কোন প্রয়োজন ছিলনা এর। শুধু শুধুই জিবনটা গেল এর।এরা তো আর এদেশের নয়,এরা এদেশের সংখ্যালঘু ,ভারত এদের দেশ।
বেশ কয়েক বছর যাবৎ একটি শব্দ যতেষ্ট পরিটিত হয়ে এসেছে আমাদের কাছে।
“জঙ্গী”
এর আভিধানীক অর্থ যুদ্ধা।
আমরা তো পাকিস্থানিদের থেকে সার্বভৌমত্ব পাওয়ার জন্য ৭১ জঙ্গী হয়েছিলাম।আমরা তো সার্বভৌমত্ব পেয়েছি।দেশ তো আজ স্বাধীন ।তাহলে জঙ্গ বা যুদ্ধ কিসের জন্য?কাদের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ?কারা এই জঙ্গী?হ্যাঁ এরা সংখ্যাগুরুদের পক্ষের লোক।এদের যুদ্ধ এখন সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ।যারা নিজ দেশে পরবাসী হয়ে এদেশের জায়গা জমি দখল করে, এদেশের অন্ন ধংশ করছে। তাদের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ!এদেশে থাকার অধিকার তো এদের নেই। কখনও প্রকাশ্যে কখনও জঙ্গীর ভুমিকায় অবতির্ন হয়ে এই সহজ কথাটিই বুঝাতে চাইছে তারা।তাই তারা লক্ষ স্থির করে নিয়েছে এই সব রিফোজিদের (?) কয়েকটার ধর থেকে মাথা আলাদা করে ফেললেই বাকিরা এমনিতেই চলে যাবে।
অনেকে হয়তো এমনটি ভাববে,জঙ্গীরা কি শুধু হিন্দু,বৌদ্ধ,খৃষ্টানদের হত্যা করছে? এরা তো অনেক মুসলিমদেরও হত্যা করছে।তাহলে একট পেশে কথা বলছেন কেন? হ্যাঁ ঠিক তাই।তারা অনেক মুসলিমদেরও হত্যা করছে। কিন্তু এটাতো অতি সাধারন দৃষ্টিতে দেখলেই দৃষ্টিগোচর হয়, ওরা সেই সব মুসলিমদেরই হত্যা করছে যারা সংখ্যালঘু আর সংখ্যাগুরুর মধ্যে ব্যাবধান বুঝেনা,যারা মননে, চিন্তায়,চেতনায়,চর্চায় শুধুমাত্র এই ধারনা পোষন করে যে আমরা সবাই মানুষ,সবাই বাঙালী,একই দেশমাতার সন্তান আমরা,আমরা সবাই একব জাতিসত্বা।এটাই তাদের অপরাধ!
এমনটা কেন ভাববে এরা?সংখ্যাগুরু মুসলিমদের ধর্মীয় সনদে তো এটাই বলা আছে যে,এক মুসলিম আরেক মুসলিমের ভাই,বাকিরা সবাই কাফের ।কাফেররা কি করে মুসলিমদের সাথে এক জাতিসত্বার অধিকারী হতে পারে?এটা আল্লাহর আইনের পরিপন্থী।তাই এর ব্যাতিক্রম যারা চিন্তা করবে তাদের মরতে হবে অথবা কাফেরদের সাথে দেশ ছাড়তে হবে।
বর্বর যুগ বলে পরিচিত মধ্যযুগের প্রাথমিক আমল থেকে ইতিহাসের পাতায় চোখ বুলালে একটা বিষয় খুবই স্পষ্ট ভাবে দৃষ্টিগোচর হয়,তা হল মুক্ত বুদ্ধির গলায় ছুরি চালানো।সভ্যতার শুরু থেকে দেখা যায় যারাই মুক্ত বুদ্ধি চর্চা করেছে,মুক্তমত প্রচার করেছে যা সমাজে বা রাষ্ট্রের প্রচলিত কন্সেপ্টের বিপরীত তারাই আক্রান্ত হয়েছে সমসাময়ীক সংখ্যাগুরুর জঙ্গীদের দ্বারা।আর এর পেছনে উর্বরতা যোগান দিয়েছে রাষ্ট্রের পরিচালকেরা ।কখনও প্রত্যক্ষ,কখনও পরোক্ষভাবে।
অথচ অনস্বীকার্য সত্য এই যে এই মুক্ত বুদ্ধির লোকেরাই আমাদের সমাজকে ,রাষ্ট্রকে দিয়েছে নতুন মাত্রা।দিয়েছে প্রযুক্তির আকাশে হাতছানি। আর প্রচলিত ধারনার মানুষগুলো ভুল প্রমানিত হয়েছে বারবার। যুক্তির শানিত ধারার কাছে পরাস্ত হয়েছে প্রাগৈতিহাসিক বিশ্বাস যুগে যুগে।
বর্ববর মধ্যযুগ অতিক্রম করে আমরা বাস করছি এক প্রগতিশীল আধুনিক যুগে ।ইতিহাসের অভিজ্ঞতা আমাদের আজো বদলাতে পারেনি।পারেনি উন্মুক্ত আকাশের নিচে বাঁধ ভাঙা আওয়াজ তুলে মুক্তচিন্তা স্ফুরনের একটি ক্ষেত্র তৈরি করে দিতে। দেশের পরিচালকেরা বরং এসব মুক্তচিন্তার মানুষদের নিয়ে বড় লজ্জিত! এরা জঙ্গীদের দ্বারা খুন হলে চোখ বুজে ,মুখ বন্ধ করে লজ্জায় নিজেকে আড়াল করে রাখে। আর মনে মনে বলে যা হয়েছে ভালই হয়েছে। কুকুর ,বেড়ালের মত রাস্তায় পরে থাকে মুক্তমনা মানুষ গুলোর লাশ।কেউ দেখার নেই,কেউ বলার নেই! বরং আইন করে লাগাম লাগিয়ে দেয়া হয় মুক্তচিন্তকদের কলমের ডগায়। এতে করে যতেষ্ট পরিমান পুষ্টি পায় চাপতি ওয়ালা জঙ্গীগুলো। এই প্রাগৈতিহাসিক দানব গুলোকে রক্ষার দায়িত্বই যেন নিয়েছে আমাদের সরকার।
এই সরকারেরই প্রধান থেকে শুরু করে চেলা পাতি চেলা সবাই মঞ্চে দাড়িয়ে গলা ফাটিয়ে সমানাধিকারের কথা বলে বলে মুখে ফেনা তুলে চলছে।এ দেশ নাকি সবার,সবার সমান অধিকার ,আর পেছন থেকে হাত নেড়ে জঙ্গীদেরকে উস্কানি দিয়ে বলছে তোদের কাজ তোরা করে যা। আসলেই তো তাই। মুক্তবুদ্ধিজীবিরাও তো সংখ্যালঘু।বরং হিন্দু,বৌদ্ধ,খৃষ্টানদের তুলনায় একটু বেশিই লঘু। ভোটের রাজনীতিতে তাদেরও কোন ভূমিকা নেই এরারও থাকা না থাকা একই কথা। বরং থাকলেই বিপদ।
এতে কি শেষ রক্ষা হবে?
দেশ আজ অরাজকতার গভীর অন্ধকারে নিমগ্ন। লুটেরা সব লুটে নিচ্ছে যে যেভাবে পারছে।কেউ প্রশাসনিক ক্ষমতার বলে, কেউ পেশি শক্তির বলে কেউ চাপতির বলে।
স্বাধীনতার স্বপ্ন ভেঙে খান খান হয়ে গেছে।প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় চোখ বুলালে,টিভির পর্দায় তাকালে দেখা যায় কোন একটি দল কিভাবে রক্তের হোলি খেলে যাচ্ছে! আর একট দল অতি ক্ষীন স্বরে বলছে আমরা ভাল নেই,আমরা ভাল নেই,এ দেশ আমেদের নয়!!
কেন এই হোলি খেলা?কেন এই আর্তচিৎকার? কেন পেলামনা আমরা আমাদের রক্তের দাম?কেন আমরা নিজ দেশে পরবাসী?
আজ আমার চিৎকার করে বিশ্ব বিবেকের কাছে বলতে ইচ্ছে করছে-
এই স্বাধীনতা কার জন্য?
কেন এই স্বাধীনতা?
কিসের জন্য এই স্বাধীনতা?
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুন, ২০১৬ বিকাল ৫:২৯