প্রতি রাতের মতো সেরাতেও ঘুম ভেঙ্গে গেল ভোর পৌনে চারটায়।কাঁথা মুড়ি দিয়ে আবার ঘুমানোর চেস্টা করে ব্যর্থ হলাম। এপাশ-ওপাশ করে একসময় উঠেই পড়লাম।দূর-দূরান্তের মসজিদ গুলো থেকে আজানের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। পাখির কলকাকলীতে মুখোরিত হয়ে উঠছে পরিবেশ। কতদিন এমন শান্ত-স্নিগ্ধ পরিবেশে পাখির কুহুতান শুনি না।আহ! এমন স্বর্গীয় আবেশে মন-প্রাণ একেবারে জুড়িয়ে গেল। বাড়ির আঙিগনা পার হয়ে মনে হলো এমন শিশিরভেজা ঘাসের উপর জুতা মাড়িয়ে হাটা রিতিমত অপরাধের সামিল। খালি পায়ে একটু হাটার পর দেহ-মন একেবারে শীতল হয়ে গেল। আহ! কী শান্তি ! ঘটনাটি রোজার ঈদের ঠিক দু’দিন পরের।
গ্রামের মেঠোপথ ধরে হাটতে হাটতে পূর্বপাড়ার বিলের ধারে চলে এসেছি।সেখানে দেখি আমার মতো আরো দু’জন দাড়িয়ে গল্প করছে। তাদের কাছে গেলাম,দু’জনই আমার ছোটবেলার বন্ধু।অনেকদিন ওদের সাথে কথা হয় না।দেখেই একজন আরেকজনের উপর ঝাপিয়ে পড়লাম।কেউ দেখে ফেললে নিশ্চত মনে করতো আমারা মারামারি করছি।এ নির্জন ভোরে ওদের সাথে দেখা হয়ে মনে কি যে আনন্দ হয়েছিল; বলে বোঝানো যাবে না। তারপর কুশলাদি বিনিময় আর গল্প করতে করতে ঘাটের দিকে গেলাম।
সেখানে বৈঠাসহ একটি ডিঙ্গি নৌকা বাঁধা দেখে একে অন্যের চোখের দিকে তাকালাম, নিমিসেই প্রত্যেকে অন্যর মনের কথা বুঝে ঝটপট নৌকায় উঠে পড়লাম।
তারপর বেসুরো গলায় গান গাইতে শুরু করলাম। বন্ধুদের অতিরিক্ত প্রসংশা সহ্য করতে নাপেরে থেমে যেতে হলো।বললাম, ‘তোরা জ্ঞানির কদর বুঝলি না।’
কতক্ষণ হই-হুল্লোড় করার পর আকাশে ভেসে বেড়ানো পেজা তুলার মত মেঘের দিকে তাকিয়ে তিনজনই চুপ-চাপ নৌকার উপর শুয়ে রইলাম। এভাবে কতক্ষন কেটে গেল বুজতেই পারলাম না। পিঠে কিছুটা বেজা বেজা অনুভূত হওয়ায় ঘুম ভাব ছুটে গেল।
কী ব্যাপার দেখার জন্য উঠে তো চক্ষু একেবারে ছানাবড়া হয়ে গেল! তলার কোন অদৃশ্য ছিদ্র দিয়ে পানি উঠে নৌকার প্রায় ডুবো ডুবো অবস্থা। পানি সেচার কোন ব্যবস্থাও নাই। কী করবো তা ভাবারও সময় নাই।এসময় তিনজনের সামান্য নড়াচড়াতেই কাত হয়ে নৌকাটা গেল ডুবে।
সাতার জানা সত্ত্বেও ভয়েই আমার আধমরা অবস্থ। তখন সত্যিই যেন আমি আকূল পাথারে হাবু-ডুবু খাচ্ছি।সমানে হাত-পা ছুড়ছিলাম। কয়েকঢোক পানিও মনে হয় খেয়ে ফেলেছিলাম।একসময় দেখি আমার উক্ত দুই বন্ধু আমাকে ধরে দাড়িয়ে আছে। আর হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরিয়ে ফেলেছে।
আমি ওদের কান্ড-কারখানা দেখে প্রচন্ড রেগে গেলাম। বললাম,‘এটা কী ধরনের আচরণ?আমি ডুবে মারা যাচ্ছি আর তোরা হাসতেছিস, আশ্চর্য!
আমি রেগে গেছি দেখে ওরা হাসি থামিয়ে বললো, ডুবে মারা গেলে এখন দাড়িয়ে আছিস কিভাবে?আর বুক সমান পানিতে তোর হাবু-ডুবু খাওয়া দেখে হাসবো না তো কি কাঁবো?
তখন মনে হলো তাইতো ! আমিতো এখন দাড়িয়েই আছি।এবার তাদের দিকে তাকিয়ে আমিও বোকার মতো হাসলাম।
এরপর সব ভুলে আমাদের দুরন্ত শৈশবের দিনের মতো শুরু হলো পানিতে ঝাপা-ঝাপি, মাতা-মাতি। আমাদের এতো হাসি-আনন্দ দেখে সূর্যটা আর মুখ লুকিয়ে রাখতে পারলো না। পুবাকাশে উঁকি-ঝুঁকি মারতে একসময় বেরিয়ে পড়লো। আমরাও নৌকাটা ঘাটের দিকে টেনে নিয়ে আসলাম।আর পানি থেকে উঠে যে যার বাড়ির দিকে হাটা ধরলাম…এভাবেই আনন্দময় একটি দিনের সূচনা হলো ।#