somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ বৃষ্টি

১৮ ই অক্টোবর, ২০১৩ বিকাল ৩:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বৃষ্টি

ছোট্ট পাহাড়ী গ্রাম চন্দনা। এখনো ইলেকট্রিসিটি আসে নি। সন্ধ্যার পর সারা গ্রাম ঘুমিয়ে পড়ে। গ্রামের পাশে ঘন জঙ্গল। রাতে সেখান থেকে যখন শেয়ালের ডাক ভেসে আসে তখন এই ঘুমন্ত জনপদকে অপার্থিব মনে হয়। এখানে বসতি খুব ফাঁকা ফাঁকা। একেকটা বাড়ি যেন একেকটা দ্বীপ। একটা থেকে আরেকটা বেশ দূরে। গ্রামের যে পাশে জঙ্গল তার বিপরীত পাশে ছোট্ট একটা পাহাড়ী নদী। কলেজটা নদীর তীরে। এখানে মাস্টারি করলাম তিন বছর। থেকেছি কলেজের সাথে লাগোয়া কটেজে। কটেজটা নদীর দিকে মুখ করা। ওটাই গ্রামের সীমানা। নদীর ওই পারে রেল লাইন। রেল লাইন পার হয়ে একটু দূরে পাহাড়ের সারি। আমার ট্রান্সফার হয়ে গেছ। আজ চলে যাচ্ছি। সারাদিন বৃষ্টি। মনে পড়ে যাচ্ছে সেই আশ্চর্য শুরুর দিনটা।

এখানে যখন প্রথম আসি সেদিনও সারাটা দিন অসম্ভব বৃষ্টি। এক মুহূর্তের বিরাম নেই। অনেক ঝক্কি মাথায় করে তল্পিতল্পাসহ গ্রামে এসে উপস্থিত হলাম। কাউকে যে জিজ্ঞেস করব কলেজটা কোন দিকে সে উপায় নেই। একটা লোক দেখছি না। একটা ঘরবাড়ি দেখছি না। একটু সন্দেহ হল এটা কি আসলেই কোন জনপদ না জনহীন কোন পাহাড়ী অঞ্চলে চলে এলাম। ভয়ে ভয়ে এদিক সেদিক খোঁজ করে একটা বাড়ি চোখে পড়ল। জঙ্গলের কাছে। টিনের ছাদের বাড়ি। দেয়াল-মেঝে পাকা। কিছুক্ষণ ধাক্কাধাক্কি করার পর একজন বয়স্ক মানুষ দরজা খুলে দিলেন। আমার পরিচয় পেয়ে ভেতরে নিয়ে গেলেন। সারাদিন বৃষ্টিতে ভিজে শীতে কাঁপছি। জিনিসপত্র রেখে গা মুছতে মুছতে দেখি তিনি আমার জন্য তেল-পেঁয়াজ দিয়ে মুড়ি মাখিয়ে নিয়ে এসেছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারলাম বাড়িতে তিনি একাই থাকেন। হালকা খাওয়ার পর যখন শীত কিছুটা কমে এল তিনি আমাকে একটা বিছানা পেতে দিলেন। আমার অবস্থা তখন বেশ কাহিল। ভদ্রতা টদ্রতা না করে শুয়ে পড়লাম।

ঘুম ভাঙল সন্ধ্যার একটু আগে। তখনো অবিশ্রান্ত বৃষ্টি। উঠে দেখি বেশ ভারী নাস্তা আর চা তৈরি। আমি বেশ লজ্জায়ই পড়ে গেলাম। তার সহৃদয় ব্যবহারে ধীরে ধীরে আমার সংকোচ কমে এল। চা’র টেবিলে বৃষ্টির দিনটা বেশ জমে উঠছিল একটু একটু করে। নাম তার প্রকাশ প্রসার। শুনে মনে হল নাম থেকে কৌশলে ধর্মীয় গন্ধ উধাও করে দিয়েছেন। তিনি এখানকার হাই স্কুলের টিচার ছিলেন। কিছুদিন হল রিটায়ার করেছেন। আমাকে পেয়ে যেন বেশ খুশি মনে হল তাকে। যেন অনেক কথা বলার আছে তার। শোনার লোক নেই।

বাবা তোমাকে তুমি করেই বলি। আমি যখন এই ইশকুলে শিক্ষক হয়ে আসি তখন তোমার মতই টগবগে তরুন ছিলাম। বলে একটু থামলেন। বুঝিবা সেই হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো কিছুক্ষণ দেখে নিলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার শুরু করলেন। বছর পেরিয়ে বিয়ে থা করলাম। কন্যা পাশের গ্রামের। দেখতে শুনতে ভাল। বিয়ের পর সেই দিনগুলো...কী সুন্দর সেই দিনগুলো। আমি স্কুল থেকে ফিরে এসে দেখতাম একটা টিনের বালতিতে গরম পানি করা আছে। গামছা সাবান সব হাতের কাছে। সন্ধ্যার একটু আগে বলার আগেই মুড়ি আর চা। সন্ধ্যার পর আকাশ ভেঙে জোছনা নামত। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম দূর জঙ্গলের দিকে। জঙ্গল যে এত সুন্দর আমি আগে জানতাম না।

তারপর হল কি, কিছুদিন যেতেই তার এক কঠিন রোগ হল। ব্রেস্ট ক্যান্সার। রাজধানীতে নিয়ে গিয়েছিলাম। ডাক্তার বলল অপারেশন করে দু’টো ব্রেস্টই ফেলে দিতে হবে। আমার কোন সঞ্চয় ছিল না। সহকর্মীদের কাছ থেকে ধার দেনা করে অপারেশন হল। অপারেশনের পর সে খুব মনমরা হয়ে থাকত। মুখ ফুটে না বললেও তার দুঃখ আমি বুঝতাম। তার যেন মন ভাল থাকে, সেজন্য তার প্রতি আমি আগের চেয়ে আরো বেশি মনযোগ দিলাম। অপারেশনের ধকল কাটিয়ে ওঠার পর সে আমাকে দ্বিতীয় বিবাহ করার জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকে। আমি তাকে বুঝিয়ে বলি যে দেহটাই সবকিছু নয়। সে এক সময় হাল ছেড়ে দিয়ে আরো শুকিয়ে যেতে থাকে।

অন্য সময় হলে মনে হয় এত দীর্ঘ কাহীনি শুনতে বিরক্ত লাগত। কিন্তু টিনের চালে একটানা বর্ষণের শব্দে কেমন একটা নেশা ধরানো পরিবেশ। আমার শুনতেই ইচ্ছে করছিল।

সেই পল্লীবালার মৌন দুঃখ আমাকে ভীষণ কষ্ট দিত। সহকর্মীদের ধারের টাকা শোধ দিতে গিয়ে সংসারে টানাটানি। সব দিন বিকেলের চা নাস্তা হয় না। সেই অভাবের মধ্যেও চেষ্টা করতাম তাকে খুশি রাখার। কিন্তু অভাবের চরিত্র খুব খারাপ বাবা। অভাবের জানালা দিয়ে জোছনা ঠিক আগের মত ঘরে পৌঁছে না। ছোটখাট অভাব অভিযোগ মাঝে সাঝেই বড় হয়ে উঠতে চায়। প্রতিটা মাসের শুরুতেই যখন এতগুলো টাকা ধার শোধের জন্য দিয়ে দিতে হত, আমার কেবলি মনে হত টাকাগুলো অপচয় করছি। সত্যি কথা বলতে কী, ধার শোধ করতে করতে এক সময় বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। আমি তখন একটা ইয়ং ছেলে। বলতে বলতে তিনি বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়ছিলেন। তবে আমার বিরক্তি কখনো মুখে প্রকাশ করিনি।

দিন গেছে। ধার শোধ হয়েছে। আমার হাতে কিছু সঞ্চয়ও হয়েছে। তখন কিন্তু সে দ্বিতীয় বিয়ের জন্য আমাকে আর পীড়াপীড়ি করেনি। আমি তখন খুব চাইতাম সে একবারের জন্য আমাকে আবার বিয়ের কথা বলুক। কিন্তু নাহ। সে আর কখনোই সেকথা বলেনি। এটুকু বলে তিনি কিছুক্ষণ থেমে রইলেন। বাইরে অবিরল বর্ষণ। পৃথিবীর আর কোথাও যেন কোন শব্দ নেই। অন্ধকার হয়ে এসেছে। তিনি উঠে গেলেন হারিকেন জ্বালাতে। হারিকেনের আলোয় সারাটা ঘর এক অদ্ভুত আলো আঁধারিতে ভরে উঠল। তার কথাগুলো সেই আবছায়ায় রহস্যময় ঠেকল।

একটু ইতস্তত করে তিনি বলতে লাগলেন, আমার...আমার মাঝে মাঝে মনে হত সে মরে যায় না কেন। তার নারী জীবন যে ব্যর্থ এবং তার যে আর বেঁচে থাকার কোন মানে হয় না এটা বোঝানোর জন্য আমি অনেক ছল চাতুরি করতাম। আমি মাঝে মাঝেই তাকে কথায় কথায় ব্যর্থ নারীদের গল্প শুনাতাম। গল্পগুলোর কিছু কিছু শোনা, বেশিরভাগই আমার বানানো। বেশিরভাগ গল্পের শেষে নারীটি আত্মহত্যা করত কিংবা উদভ্রান্ত হয়ে পড়ত। এসব গল্পের উদ্দেশ্য সে বুঝত কিনা আমি বুঝতে পারতাম না। তার আচরণ বোঝা কঠিন হয়ে উঠেছিল। আমার গল্প তার মধ্যে খুব একটা প্রতিক্রিয়া তৈরি করত বলে মনে হত না। তারপর আমি বিভিন্ন ধরণের কীটনাশক নিয়ে বাড়ির এখানে সেখানে রেখে দিতে লাগলাম। এ বিষয়ে সে একটি কথাও বলত না। যেন বাড়িতে অস্বাভাবিক কিছুই ঘটেনি। আমার মন মেজাজ দিনে দিনে অতিষ্ট হয়ে উঠতে লাগল।

একদিন সে স্বপ্ন দেখল আমি তাকে রেল লাইনে বেঁধে রেখে এসেছি। রেল গাড়ি তার দিকে ধেয়ে আসছে। সে কোনভাবেই নিজেকে মুক্ত করতে পারছে না। স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙল। আমাকে ডেকে তুলল। স্বপ্নের কথা বলল। আমি বিরক্ত বোধ করলাম। কিন্তু মুখে বললাম সোনা আমার, এটা কি কখনো হতে পারে ? সে স্বপ্নটা আরো কয়েকদিন দেখল। তারপর থেকে যেন আমার প্রতি তার এক ধরণের ভীতি তৈরি হয়। তার চোখের চাহনি দেখে আমি বুঝতে পারতাম। আমার তখন খুব ভাল লাগত। আরেকদিন সে স্বপ্ন দেখল আমরা পাহাড়ে ঘুরতে গেছি। ঘুরতে ঘুরতে আমি হঠাৎ তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছি। তার ভয় দিনে দিনে বাড়তে লাগল। আমার খুশিও। তার মনে এই ধারণা বদ্ধ হয়ে গিয়েছিল যে আমি তাকে মেরে ফেলব। আমি তাকে বলতাম যে তার এই ধারণা কোন দিন সত্য হবে না। কিন্তু আশ্চর্যের কথা কি জান বাবা ? সত্যি সত্যি একদিন সে পাহাড় থেকে পড়েই মারা গেল।
- আপনি তখন কোথায় ছিলেন ?
আমার এই প্রশ্নে তিনি ভয়ানক বিব্রত বোধ করলেন। আমার দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালেন এবং আচমকা রেগে উঠলেন। তারপর মাল সামান সমেত সেই বৃষ্টির রাতে আমাকে বের করে দিলেন।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই অক্টোবর, ২০১৩ রাত ৯:১৫
১৪টি মন্তব্য ১৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

= দাওয়াত বা কোন অনুষ্ঠানে খাবার গ্রহণের সময় যে কটি বিষয় আপনার বিবেচনায় রাখা দরকার =

লিখেছেন এমএলজি, ১৪ ই অক্টোবর, ২০২৪ ভোর ৪:২৩



১. দ্রুত খাবার গ্রহণের অভ্যাস থাকলে তা কিছুটা ধীর বা প্রলম্বিত করার চেষ্টা করুন যাতে অন্য সবার বেশ আগেই আপনার খাওয়া শেষ হয়ে না যায়।

২. কোন আইটেম খুব সুস্বাদু বা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ এবং কিছু কথা......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ১৪ ই অক্টোবর, ২০২৪ সকাল ১০:৩০

আমাদের ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ এবং কিছু কথা.........

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আমাদের সফলতার চেয়ে ব্যর্থতার বিষাদময় গ্লানির সঙ্গেই বোধকরি বেশি সম্পর্ক। কদাচিৎ কোনো বড় দলকে পরাজিত করার পর আমরা পুরো বাংলাদেশ এখনো আবেগে আপ্লুত... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ্‌ সাহেবের ডায়রি ।। অন্য দেশে চলে যাচ্ছে গার্মেন্টসের অর্ডার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৪ ই অক্টোবর, ২০২৪ দুপুর ১২:২০




এবার বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের অর্ডারের একটি অংশ প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তানসহ অন্য দেশের বাজারে চলে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। রাজনৈতিক অস্থিরতা, সরকার পতন এবং শ্রমিক অসন্তোষের কারণে দেশের সবচেয়ে বড়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন ভারতের উদ্বেগ!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৪ ই অক্টোবর, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩


ভালোভাবেই শেষ হলো সনাতনীদের বৃহৎ উৎসব দুর্গাপূজা কিন্তু দুর্গাপূজা ভালো ভাবে শেষ হওয়ায় অনেকেই বড্ড হতাশ হয়েছে; পূজা নিয়ে তারা ট্রামকার্ড খেলতে চেয়েছিল কিন্তু ট্রামকার্ড খেলার পরও সফল হতে পারেনি।... ...বাকিটুকু পড়ুন

উফ্! কি দারুণ!! WOW!!!

লিখেছেন মন থেকে বলি, ১৪ ই অক্টোবর, ২০২৪ বিকাল ৩:০৬

চোখটা সবে যেই বুঁজেছি, ডাকল হুলো 'মিঁয়াও'।
মাথায় এলো আজিব টপিক - আরি সাবাশ! WOW!!

ল্যাংটাকালে 'আমার বই'-য়ে,
আঁকল ছবি কোন আঁকিয়ে?
তালগাছেতে উলটো ঝোলে কানাবগির ছাও।
সেটাই ছিল প্রথম অবাক, প্রথম বলা - WOW!!

আরও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×