ছোটবেলায় বন্ধুদের কাছে প্রায়ই একটা প্রশ্ন শুনতে হতো,
‘‘তোর আব্বু কখনো ক্লাস নিলে কি ডাকবি? স্যার না আব্বু?’’
আরো ছোটবেলায় যখন প্লে নার্সারীতে পড়তাম তখন এই প্রশ্নটাই ছিলো এরকম,
‘‘তুই বাসায় তোর আব্বুকে স্যার ডাকিস না আব্বু ডাকিস?’’
ঘটনা হলো আমি যে স্কুলে পড়েছি আমার বাবা ছিলেন সেই স্কুলেরই শিক্ষক। তাই বাবার কলিগরা আমার প্রতি একটু বেশিই যত্নশীল ছিলেন। অন্যদের যেখানে সাত খুন মাপ ছিলো, আমার সেখানে কারো খুনের সাক্ষী হওয়াও ছিলো পাপ! হোমওয়ার্ক না করা থেকে শুরু করে কারো শার্টের পেছনে কলমের দাগ দেয়ার কথাটা পর্যন্ত বাবার কানে পৌছানো বাদ থাকতো না। ভাবখানা এমন-
‘‘ আপনার ছেলের প্রতি আমি যেমন সচেতন, আমার ছেলের প্রতিও আপনি তেমনই সচেতন থাকবেন।’’
তাদের এই ‘বিনিময় প্রথার’ বলির পাঠা ছিলাম আমি। আমার সাধের শৈশব। আমার দুষ্টুমি বেলা। কতজনের শার্টে যে কলমের দাগ দিয়ে দুরুদুরু মনে বাসায় ফিরেছি তার হিসেব নেই! ভয়ে থাকতাম-এই বুঝি কোনো ম্যাডাম আব্বাকে নালিশ দিয়ে দিলো! এই বুঝি আম্মা এসে বললো-
‘‘আজ স্কুলে কি করে এসেছিস? যা তোর আব্বা তোকে ডাকে!’’
তখন কোন ক্লাসে পড়ি ঠিক মনে নেই। সেদিন কোনো একটা ক্লাসের মেইন টিচার আসেনি। মুহুর্তেই পুরো ক্লাস কয়েকজন মিলে মাথায় তুলে ফেললাম। ঝামেলা পাকালো ক্লাস ক্যাপ্টেন। হাঁদারাম অফিসে খবর দিয়ে এলো যে ক্লাসটা ফাঁকা যাচ্ছে। এসে জানালো যে প্রক্সি দিতে একজন টিচার আসছেন। একটু পর যা ঘটলো তা আমার কল্পনাতেও ছিলো না।এটেনডেন্স খাতা হাতে রুমে ঢুললেন স্বয়ং আমার বাবা !! এরই নাম বুঝি ‘পড়বি তো পর মালির ঘাড়েই’। ঢুকেই রোল কল শুরু করলেন। আমি বিরাট চিন্তায় পরে গেলাম।
‘‘প্রেজেন্ট স্যার বলবো? নাকি প্রেজেন্ট আব্বু বলবো?’’
ক্লাসে চাপা উত্তেজনা। সবাই আমার দিকে তাকায় আছে। আমার রোল নাম্বার ছিলো সতেরো। আব্বু ডেকে চলেছেন দশ,এগারো, বারো। আমিও তাল মিলিয়ে ঘামতেছি। ষোলো পর্যন্ত ডাকা হয়ে গেলো ! আমি তখনও ঠিক করতে পারি নাই কোনটা বলবো ! সেই সময় আব্বু ডাকলো- আঠারো !! ধরে রাখা নিশ্বাসটা বড় করে ছাড়লাম।
সেইদিন তিনি আমার রোলই ডাকেন নাই। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমার টেনশনের কিছু নাই। দুনিয়াতে আমার নার্ভাসনেসটা যিনি সবচেয়ে বেশি বুঝেন, রোল ডাকছিলেন স্বয়ং তিনিই। আজও জানি,যে কোনো সমস্যায় পড়লে তা এই একজনকে জানালেই আমার আর টেনশনের কিছু নেই। সেদিনের মতই কিছু বলার আগেই আমার সব সমস্যা জেনে ফেলেন আজও। বাবা দিবসের শুভেচ্ছা রইলো বাবা। এই কাঁধটায় তোমার হাতের স্পর্শ অনুভব করে আজও ভরসা পাই।প্রতিটা মুহুর্ত ভালোবাসি তোমায়।
পৃথিবীর সকল বাবাকে জানাই বাবা দিবসের শুভেচ্ছা।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুন, ২০১৩ দুপুর ১:৫৫