somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চার্লি চ্যাপলিন – সিনেমার সবচেয়ে প্রতিভাবান শিল্পী, যার বোকা হাসি জয় করেছে গোটা বিশ্ব

০৬ ই জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ৯:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



বেশিদিন আগের কথা নয় যখন টেলিভিশন – সিনেমা এগুলো সভ্যতায় যুক্ত হয়েছে, হলেও ছিলো অনেক সীমিত পরিসরে। সেসময় সার্কাস ছিলো মানুষের বিনোদনের একটা বড় মাধ্যম, আর সেই সার্কাসের একটা উল্লেখযোগ্য সন্নিবেশ ছিলো ভাঁড়ামি। তো এই ভাঁড়ামিটা বোধকরি নিদারুণ নিরীহ কোনো বিনোদনই ছিলো বলা যায় সেসময়ে। আর সিনেমা-টিভি যখন আসলো তখনও এই হাস্যকর চরিত্র বা কমেডিয়ান হাসির খোরাক দেয়া ছাড়া আর কোনো গুরুত্ব বহন করতোনা। কিন্তু চার্লি চ্যাপলিন – তাঁকে কমেডিয়ান , জোকার, ভাঁড় – এসব নামে অভিহিত করা এক ধরণের ধৃষ্টতা। মানুষের নিত্যনৈমিত্তিক দুঃখবোধ, অভাব-অপ্রাপ্তি, সামাজিক বৈষম্য, ধণিক শ্রেণীর অযাচিত অহমিকা আর নিষ্পেষিতের প্রতি অবহেলা তাঁর ঐ সচরাচর ভাষায় আমরা যাকে কমেডিয়ান চরিত্র বলি তার মধ্যেই ফুটে উঠেছে অনেক শক্তিশালীভাবে। তিনি ইচ্ছা করলে তাঁর সুশ্রী চেহারায় কয়েক আস্তর মেকাপ বসিয়ে নায়ক চরিত্রে অভিনয় করতে পারতেন, চাইলে হতে পারতেন পলিটিক্যাল মেশিনের কোনো মনভোলানো বক্তা – তাঁর The Great Dictator(1940) দেখলেই প্রমাণ হয় তিনি সচরাচর কমেডিয়ান চরিত্রকে উতরেও অন্য চরিত্রে নিজেকে কতটা বলিষ্ঠরূপে উপস্থাপন করতে পারেন। কিন্তু জনমানুষের মনে তাঁর ভবঘুরে সেই চেহারাই আজো জ্বাজ্বল্যমান।

তো এই যে তাঁর বিখ্যাত ভবঘুরে চরিত্র (Little Tramp), মজার ব্যাপার হলো একমাত্র হাতের ছড়িটা বাদে বাকি সবই ছিলো অন্যদের কাছ থেকে নেয়া। পড়নের বেঢপরকম ঢিলেঢালা যে প্যান্ট সেটা নেয়া তাঁর প্রথমদিককার সহকর্মী রসকো আরবুকলের কাছ থেকে, রসকো’ই তাঁর শ্বশুরের হ্যাটটা দেন চ্যাপলিনকে। পুরোনো জুতা আর কোটটা পান আরেক সহকর্মী চেস্টার কংক্লিনের কাছ থেকে। টুথব্রাশ স্টাইলের যে গোঁফ – তা তৈরি ম্যাক সোয়াইনের কাটা চুল থেকে।

ভক্ত হিসেবে চিন্তা করতে কষ্ট হয় একটা পৃথিবী ছিলো যেখানে একসময় চার্লি ছিলোনা… তারপরে একদিন হঠাত করে ভেনিসে এক শিশুদের গাড়ির রেসে ক্যামেরার সামনে নিজের চেহারা দেখানোর জন্যে পাগলপারা একটা লোক বারবার উদিত হয়, তিতিবিরক্ত করে তোলে ক্যামেরাম্যানকে। The Kid Auto Race in Venice (1914) মুভিটি দিয়েই বলা যায় চার্লির চার্লি হয়ে ওঠার গল্পটার শুরু। এ মুভিতে ক্যামেরাম্যানকে বিরক্ত করেছেন এবং এরপর থেকেই সারাজীবন তিনি প্রচলিত সমাজব্যবস্থার ত্রুটিগুলোকে হাস্যরসের মাধ্যমে সমাজের কিছু বিশেষ শ্রেণীকে যেভাবে বিরক্ত করে তুলেছিলেন – সেই যাত্রার প্রথম পদক্ষেপ বলা যায় এই শর্টফিল্মটি।

চার্লি চ্যাপলিনকে লোকে আজীবন মনে রাখবে তাঁর ট্র্যাম্প চরিত্রের জন্যে- আর তাঁর ট্র্যাম্প চরিত্রের মুভিগুলো সবই ছিলো নির্বাক, সুতরাং কোনো নির্দিষ্ট ভাষা বা দেশের লোকের মধ্যে তাঁর সীমাবদ্ধতা ছিলোনা। ট্র্যাম্প বলতো সারাবিশ্বেরই জনমানুষের কথা- তাইতো সবাক চলচ্চিত্রের দাপট যখন পুরো পৃথিবী জুড়ে তখনো তিনি ট্র্যাম্পকে নিয়ে স্রোতের বিপরীতে থেকেই বানিয়ে গেছেন নির্বাক চিত্র- আর সারাবিশ্ব আজো একই তালে একই সুরে হাসে, কাঁদে- মুখের ভাষা ভিন্ন হতে পারে, গায়ের রঙ ভিন্ন হতে পারে কিন্তু অনুভূতির যে কোনো ভাষা, রঙ-এর ভিন্নতা নেই।

চ্যাপ্লিনকে ট্র্যাম্প চরিত্রে দেখে দেখে অভ্যস্ত মানুষ হিসেবে অনেক সময়ই ভাবতে কষ্ট হয় যে অন্যান্য চরিত্রে তিনি সমান প্রতিভাবান, কিন্তু ভক্তদের ধারণাকে ভুল প্রমাণ করেই তিনি বেশ কিছু ভিন্নধর্মী চরিত্রের সিনেমায় অভিনয় ও পরিচালনা করেছেন। কখনো হিটলারসদৃশ অত্যাচারী জেনারেল, কখনো বুড়ো শিল্পী, কখনো নিঃস্বার্থ প্রেমিক, কখনো সিরিয়াল কিলার, কখনো নিজের সিনেমারই ব্যকগ্রাউন্ড মিউজিকের স্রষ্টা, কখনো সিনেমায় দেখানো যন্ত্রসামগ্রীর ডিজাইনার, কখনো শুধুমাত্র ২ সেকেন্ডের এক কুলি চরিত্রের আড়ালে শুধুই সিনেমার পরিচালক, বিপজ্জনক পরিবেশে স্টান্টম্যান, কখনো গায়ক- সবক্ষেত্রেই সমান দক্ষতা দেখিয়ে তিনি প্রমাণ করেছেন সিনেমা জগতে তিনি নিঃসন্দেহে “সর্বকালের সবচেয়ে প্রতিভাবান ব্যাক্তি”। আমার এ লেখায় তাঁরই বেশ কিছু বিখ্যাত মুভি যা সিনেমা দর্শকদের জন্যে অবশ্যই দ্রষ্টব্য সেগুলো এবং তাতে চ্যাপ্লিনের অসামান্য সব দক্ষতা নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করলাম।

The Kid (1921)


এই মুভিকে বেশিরভাগ চ্যাপলিনভক্তরা তাঁর সবচেয়ে “ইমোশনাল এন্ড পার্সোনাল ফিল্ম” হিসেবে আখ্যায়িত করে। ১৯১৮ সালে তাঁর প্রথম স্ত্রীর ঘরে এক বিকলাংগ ছেলের জন্ম হয়, জন্মের ৩ দিন পরেই বাচ্চাটি মারা যায়। এই ঘটনা তাঁকে মানসিকভাবে ভীষণ বিপর্যস্ত করে তোলে, কিন্তু প্রতিভাবান বলে কথা- বাচ্চার শেষকৃত্যের মাত্র ১০ দিন পরে তাঁর মাথায় এই মুভির আইডিয়া আসে। কিন্তু চ্যাপলিন ডিরেক্টর হিসেবে অনেক খুঁতখুঁতে- নিজে যেমন প্রতিভাবান, খুঁজছিলেনও তেমনি একটা বাচ্চাকে যে কিনা ট্র্যাম্পের মতই চালচলন স্বাবলীল ফুটিয়ে তুলতে পারবে ক্যামেরায়। একদিন এক মিউজিক হলে এক নাচিয়ের ছেলেকে পেয়েও যান যে কিনা চ্যাপলিন যা শিখিয়ে দেন তাই হুবহু অনুকরণ করে দেখায়। এই ছেলেটিই জ্যাক কুগান, যাকে বলা হয় চ্যাপলিনের পছন্দের সবচেয়ে নিখুঁত আদর্শ অভিনেতা। আর এই মুভিটা সম্ভবত সিনেমার ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি শুটিং রেশিওর ফিল্ম – প্রতি সিলেক্টেড দৃশ্যের জন্যে শট নেয়া হয়েছিলো ৫৩ বার!!!

কমেডি আর ইমোশনকে সম্মিলিত করার এক অনন্য উদাহরণ “দা কিড” মুভিটি। এক অবিবাহিত মা তাঁর সদ্য জন্মানো বাচ্চাকে ফেলে রেখে যান, আর সেটা এসে পড়ে ট্র্যাম্পের কাছেই। নিজেরই আটপৌরে জীবন, তাই বারবার বাচ্চাটিকে দূর করতে চায় নিজের কাছ থেকে, কিন্তু পেরে উঠেনা কিছুতেই। অগত্যা তাকে নিজের ঘরে এনেই লালন-পালন করতে থাকে। বাচ্চাটি বড় হয়, আর তার প্রতি ট্র্যাম্পের মমতাও বাড়তেই থাকে- তাইতো সরকারী এতিমখানার কর্মীরা যখন বারবার তার কাছ থেকে শিশুটিকে কেড়ে নিতে চায় সে প্রবল প্রতিরোধ করে।

এ মুভিকে চ্যাপ্লিনের শৈশবের জীবনীও বলা যায় এক অর্থে- শিশু বয়সে বাবা ছেড়ে যান, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে হয় আর তাঁকেও মাত্র ৭ বছর বয়সে সরকার মায়ের কাছ থেকে আলাদা করে দেয়। আর এই সবটুকু নিজ অভিজ্ঞতাই ফুটিয়ে তুলেছেন মুভিতে। এ মুভিতে চ্যাপ্লিনের ডিরেক্টর প্রতিভার সম্ভবত সর্বোচ্চ প্রতিফলন দেখা যায় – কিড চরিত্রে অভিনয় করা কুগানের অভিনয় অবাক করতে বাধ্য করে অনেক বিখ্যাত পরিচালককেও, আর চ্যাপ্লিন যে নিজের চোখে ভাসা চরিত্রকে এক্কেবারে ক্যামেরার পর্দায় দর্শকের চোখের সামনে নিয়ে আসতে কুগানকে সর্বোচ্চ সার্থক দিকনির্দেশনা দেয়ার মুন্সিয়ানার পরিচয় দেখিয়েছেন তা পরিচালকদের জন্যে পরম আরাধ্য। সেট ডিজাইন আর স্টোরিটেলিং-এর জন্যে শট সিলেকশন দক্ষতাও কিছু দৃশ্যে সিনেমার পর্দায় দর্শকের চোখকে আটকে রাখবে নিশ্চিতভাবেই।

A Woman of Paris (1923)



কেবলমাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্যে এক কুলি’র চরিত্রে অভিনয় এবং কমেডি বাদ দিয়ে সম্পূর্ণ নতুন ধারা “রোমান্টিক ড্রামা” নির্মাণ করাটা চ্যাপ্লিনের জন্যে বেশ সাহসের একটা পদক্ষেপ ছিলো- কারণ ৭০টি মুভিতে ইতিমধ্যে অভিনয় করা চ্যাপ্লিনকে কমেডি মুভিতে দেখে দেখে অভ্যস্ত দর্শক শুধু ডিরেক্টর তাও আবার “রোমান্টিক ড্রামা” জনারের মুভির ডিরেক্টর হিসেবে দেখতে পয়সা খরচ করতে চাইবে – ব্যাপারটা অনেকটা আনকোরা কোনো পরিচালকের মতই দুঃসাধ্য কাজ। মুক্তি পাওয়ার পর ক্রিটিকরা প্রশংসায় ভাসিয়ে দিলেও প্রথম কয়েকদিনের পরে দর্শকও খুব একটা সাড়া দেয়নি, খুব কম লোকই কুলি চরিত্রে চ্যাপলিনের উপস্থিতি বুঝতে পেরেছে – তারপরও বরাবরের মত দৃশ্যকল্পের ডিটেইলিং এবং স্টোরিটেলিং-এর দক্ষতা এ মুভিকে ঠিকই নির্বাক চলচ্চিত্রের মধ্যে সবচেয়ে প্রশংসিত মুভি হিসেবে অধিষ্ঠিত করেছে।

এর কাহিনীও এসেছে চ্যাপ্লিনের বাস্তব জীবনে সান্নিধ্যে আসা ৩ মহিলার জীবনাচারের উপর চ্যাপ্লিনের অবজার্ভেশন থেকে। প্রথম নারীটি এডনা পুর্ভায়েন্স, যিনি ইতিমধ্যে ৩৫টির মত মুভিতে চ্যাপ্লিনের সহকর্মী ছিলেন – চ্যাপ্লিনের মনে হলো এডনা কমেডি মুভিতে অভিনয়ের জন্যে যথেষ্ঠ বয়স পেরিয়ে গেছে, সুতরাং ড্রামাটিক অভিনেত্রী হিসেবে তাঁর ক্যারিয়ারটাকে গঠন করা দরকার। ২য় নারীটি পেগি হপকিন্স জয়েস, ভার্জিনিয়ার এক নাপিতের কন্যা। নিজ সৌন্দর্য্যকে ব্যবহার করে সে সম্পর্ক গড়ে তোলে মিলিয়নিয়ারদের সাথে, বিয়ে ও ডিভোর্সের মাধ্যেমে কামিয়ে নেয় প্রচুর অর্থকড়ি। চ্যাপ্লিনকেও একই ফাঁদে ফেলতে যায়, কিন্তু এবার চ্যাপ্লিনই বরং লাভবান হন পেগির কাছ থেকে – প্যারিসের ধণাঢ্য প্রকাশকের সাথে পেগির সম্পর্ক এবং পেগির প্রেমে ব্যর্থ হয়ে এক যুবকের আত্মহত্যা করার ঘটনাকে সাজিয়ে গড়ে তোলেন এই মুভির প্লট। ৩য় নারীটি হলেন পলা নেগ্রি, পোলিশ অভিনেত্রী। পলার সাথে চ্যাপ্লিনের প্রেম নিয়ে মিডিয়ার গুঞ্জনে চ্যাপ্লিন খুব বিরক্ত ছিলেন, কিন্তু সদ্য হলিউডে আসা পলা ছিলো এর বিপরীত। পলার প্রতি তাঁর এরুপ অনীহাই ইঙ্গিত করা হয়েছে শেষ দৃশ্যগুলোতে।

The Gold Rush (1925)



“গোল্ডরাশ” কাহিনীটা চ্যাপ্লিনের মাথায় আসে ১৮শতকের শেষদিকের মানুষজনের স্বর্ণখনির সন্ধানে প্রতিকূল স্থানে ভ্রমণ এবং ১৮৪৬ সালের দিকে কিছু অভিবাসীর প্রতিকূল পরিবেশে আক্রান্ত হয়ে প্রবল ক্ষুধার্ত হয়ে নিজেদের চামড়ার জুতা ও মৃত সহযাত্রীদের মাংস ভক্ষনের ঘটনা থেকে। চ্যাপ্লিন সবসময়ই বিশ্বাস করতেন ট্রাজেডি আর কমেডি দুটোই পিঠাপিঠি জীবনের দুই রুপ- তাইতো এই মুভিতে চরম প্রতিকূল পরিবেশ উপেক্ষা করে স্বর্ণের সন্ধানে যাত্রা করা অভিযাত্রীদের বিভিন্ন বিপদের সম্মুখীন হওয়াটাকেও ব্যাংগবিদ্রুপ সহকারে উপস্থাপন করেছেন সঙ্গতিপূর্ণভাবেই। ক্ষুধার্ত অবস্থায় ট্র্যাম্পের অধীর আগ্রহ ও আনন্দভরা ভঙ্গিমায় জুতা সিদ্ধ করা, নির্লিপ্ত কিন্তু সকরুণ চোখে একটা একটা করে পেরেক মুরগীর হাড়ের মত ভাব করে চোষা, সহযাত্রী ক্ষুধার জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে ট্র্যাম্পকেই মুরগী ভেবে আক্রমণ করতে উদ্যত হওয়া- দৃশ্যগুলো দর্শককে একই সময়ে দুঃখিত এবং হেসে উঠতে বাধ্য করে।

এ মুভিটি চার্লির সবচেয়ে কম সময়ে কাহিনী সাজানো কিন্তু সবচেয়ে ব্যবসাসফল। এ মুভির একটি দৃশ্যে চ্যাপ্লিন খাওয়ার টেবিলে কেকের মধ্যে চামচ গেঁথে ২-পায়ের আকৃতি দিয়ে সেই পাগুলোকেই নাচার ভঙ্গি করেন- এই দৃশ্যটিতে পাপেটিয়ার হিসেবেও চ্যাপ্লিনের দক্ষতা এবং তালে তালে চোখ-মুখের ভংগিমা দর্শক হিসেবে যে কাউকে উদ্বেলিত করে- প্রিমিয়ারে এই দৃশ্যটি টেনে আরেকবার দেখানোর অনুরোধও করে বসে দর্শকরা। আর এটা যে কতটা দুঃসাধ্য সাধন ছিলো তা বুঝা যায় জনি ডেপের একটা সাক্ষাতকারে- এই কাজটাই তিনি যখন Benny and Joon (1993) মুভিতে করতে যান তখন নাকি প্রায় ৩ সপ্তাহের মত সময় ব্যয় করতে হয় শুধু তা রপ্ত করতেই। অভিনয়, ডিরেকশন ছাড়াও এই মুভিতেই বিপজ্জনক সব স্থানে শট নেয়া, স্পেশাল ইফেক্টের কাজেও দক্ষতা দেখান চ্যাপ্লিন।

The Circus (1928)



হাসতে হাসতে মরে যাওয়ার দশা- এই কথাটা এই মুভি দেখার ক্ষেত্রে খুব ভালোভাবেই টের পাওয়া যাবে। চ্যাপলিন সিনেমাজগতকে নিজের প্রতিভার আলোয় আলোকিত করতে আর মানুষকে নির্মল বিনোদন দিতে যে কতটা আন্তরিক ছিলেন তা বুঝতে হলে এ মুভিটি দেখতেই হবে। ট্র্যাম্প চরিত্রটি এ মুভিতে অপ্রত্যাশিতভাবে যুক্ত হয়ে পড়ে একটা সার্কাস দলের সাথে। যখন দর্শকরা সার্কাস দলের তখনকার প্রচলিত ধারার ভাঁড়ামি দেখে দেখে বিরক্ত হয়ে পড়েছিলো তখন হঠাত করেই এক পুলিশের দৌড়ানি খেয়ে ট্র্যাম্প ঢুকে পড়ে স্টেজে। তাঁর ট্র্যাম্প চরিত্রের স্বাভাবিক আচরণ দেখেই তখন লোকজনকে প্রবল হাসিতে লুটিয়ে পড়ে- আর এ দেখে সার্কাস দলের ম্যানেজারও তাঁকে দলে নিয়ে নেন। ****স্পয়লার এলার্ট**** >এর মধ্যেই তিনি ম্যানেজারকন্যার প্রেমে পড়েন, কিন্তু বরাবরের মতই ট্র্যাম্প থেকে যায় অলক্ষ্যেই- কন্যা প্রেমে পড়ে আরেক সদস্যের। বরাবর যা হয়- মনের মধ্যে প্রেম গোপন রেখে ট্র্যাম্পই তাদের সাহায্য করে।অন্ধত্ব থেকে মুক্তির পরে মেয়েটি তার সাহায্যকারী হিসেবে দামি গাড়ি থেকে নামা কেতাদুরস্ত লোকদের ভাবে এবং রাস্তার পাশেই বিপর্যস্তভাবে হেঁটে যাওয়া ট্র্যাম্পকে দেখে কৌতুক ও ভিক্ষা দিতে চায়- কিন্তু পরক্ষণেই হাত ধরেই বুঝতে পারে ট্র্যাম্পই হলো আসল সাহায্যকারী< ****স্পয়লার এলার্ট**** - এই কয়েকটি দৃশ্যের মাধ্যমে বুঝাতে চেয়েছেন সত্যিকারের প্রেম নিতান্তই সাধারণ কিন্তু নিঃস্বার্থ – শেষ কয়েকটি মূহুর্তের দৃশ্য দেখে চোখ ভিজে উঠে- সম্ভবত আমার দেখা সেরা রোমান্টিক দৃশ্য এগুলো।

Modern Times (1936)



চ্যাপ্লিন সবসময়ই যন্ত্রের প্রতি মানুষের ক্রমাগত নির্ভরশীল হয়ে পড়াটাকে ঘৃণা করতেন, আর যন্ত্রসভ্যতার কারণে আর্থসামাজিক কুপ্রভাবকে চোখের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা থেকেই বানিয়েছেন “মডার্ণ টাইমস”। ট্র্যাম্প চরিত্রের শেষ মুভি এটি। ট্র্যাম্প চরিত্রের জন্ম হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে, জন্ম থেকেই এ চরিত্রে ফুটে উঠেছে কলোনিয়ালিজম আর অভিজাত-দরিদ্রশ্রেণীর বিরুপ বৈষম্য আর সাধারণ মানুষের দুর্দশার চিত্র- ট্র্যাম্প যেনো সমাজেরই আয়না। আর “মডার্ণ টাইমস” বানানোর সময়টাই ছিলো আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বে ইন্ডাস্ট্রিয়াল অটোমেশনের কারণে সৃষ্ট বেকারত্ব ও মানুষের ক্ষুধা আর বিষণ্ণতায় আত্মহত্যা প্রবণতা বা আন্দোলন করা, আবার সেই আন্দোলনকারীদের উপর সরকারের দমননীতি- শেষ মুভিতে চ্যাপ্লিন চেয়েছেন ট্র্যম্পের মাধ্যমে এই বাস্তবতাকেই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে। সবাক চলচ্চিত্র যখন একেবারে রোজকার সিনেমাশিল্পের অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠলো, তখন একে সবসময়ই পাশ কাটানো চ্যাপলিন এই মুভিতে সর্বপ্রথম কিছু দৃশ্যে অডিও দিলেন। আর একটি দৃশ্যে তাঁর আবোলতাবোল কথা নিয়ে গানটাই ইতালিয়ান একটা জনপ্রিয় জিবারিশই হয়ে যায় শেষমেষ।

এই মুভিতে একটি দৃশ্যে একটা যন্ত্র দেখানো হয় যা কারখানার এক শ্রমিককে খাবার খাওয়ানোর কাজ করে, উদ্দেশ্য হলো শরমিকদের লাঞ্চব্রেকের সময়টাকে উতপাদনে ব্যয় করা – এই দৃশ্যের মাধ্যমে চ্যাপ্লিন ইঙ্গিত করলেন যন্ত্রের আবির্ভাব আমাদের জীবনযাপনকে নির্লিপ্ত করতে পারে। আর শেষ দৃশ্যের লং ক্যামেরা শটে পিছনে দৃষ্টির সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত খোলা রাস্তা এবং সামনেও একইরকম রাস্তা দেখিয়ে ইন্সপায়ার করলেন দর্শককে – শত ঝড় উতরে সাধারণ মানুষেরা ঠিকই জীবনের লম্বা পথ অতিক্রম করে, আর সামনের দীর্ঘ পথও একই ভাবেই অতিক্রম করতে হবে, পথের দৈর্ঘ্য আর বাধা দেখে আমরা যাতে হতাশ না হই। তাঁর মুঠি পাকিয়ে লড়াই করার ইঙ্গিত সবসময়ই মানুষকে জীবনযুদ্ধে বীরের মত লড়ার প্রেরণা দেয়।

The Great Dictator (1940)



আমার দেখা চ্যাপ্লিনের সেরা সিনেমা এটি। হিটলারের আগ্রাসন ও ফ্যাসিবাদী ইউরোপিয়ান শাসকদের নীতিমালা, সাধারণ মানুষের মনের হাহাকার তাঁকে প্রবলভাবে নাড়া দেয়, এ থেকেই এই মুভির অনুপ্রেরণা পান। সাধারণের জন্যে কথা বলতে গিয়ে বাসস্থল আমেরিকায় তিনি সমালোচিত হন- সেই হতাশা আর সাধারণ মানুষকে আশার আলো দেখাতেই তাঁর “গ্রেট ডিক্টেটর” মুভিটি। এ মুভির সবচেয়ে আলোড়িত করার মত অংশটুকু হলো হিটলারসদৃশ জেনারেল হিংকেলের ভাষণ- বারবার দেখার মত দৃশ্যগুলো। হিটলার চেয়েছিলেন পুরো পৃথিবীকে দখলে নিতে – একটা গ্লোব নিয়ে খেলা এবং শেষে তা ফেটে যাওয়া-এ দৃশ্যের মাধ্যমে চ্যাপলিন রীতিমত হিটলারকে খোঁচাই দিয়েছিলেন, যদিও শোনা যায় এ মুভিটি বরং হিটলার বেশ পছন্দই করেছিলো। তবে সিনেমালোচকরা ঠিকই এই দৃশ্যটিকে “ক্লাসিক” তকমা দিতে ভুলেননি। যেহেতু রাজনৈতিকভাবে এ মুভিটি অনেক গুরুত্ব বহন করছিলো তাই এ মুভিটি তৈরীতে চ্যাপলিনকে বেশ সতর্কই থাকতে হয়েছিলো।

Monsieur Verdoux (1947)



সিরিয়াল কিলিং-এর ধারাটাতেও যে চ্যাপলিন অভিনয় ও পরিচালনা করতে সক্ষম তার প্রমাণ রাখে “মঁশিয়ে ভার্দ্যু” মুভিটি। কেন্দ্রীয় চরিত্র একজন সিরিয়াল কিলার যে কিনা ডিভোর্সড কিংবা বিধবা ধণাঢ্য মহিলাদেরকে তাঁর প্রেমের ফাঁদে ফেলে হাতিয়ে নেয় সব সম্পদ এবং শেষমেষ তাদেরকে খুন করে। বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব থেকে চাকরি হারানো, ওদিকে অসুস্থ স্ত্রী আর ছেলের দেখভালের প্রয়োজনই বাধ্য করে ভার্দ্যুকে একজন সিরিয়াল কিলার হতে। ভার্দ্যু চরিত্রে চ্যাপলিন যে সিরিয়াসনেস দেখিয়েছেন তা কমেডিয়ান ইমেজের চ্যাপলিনের জন্যে বেশ চ্যালেঞ্জিং কাজই ছিলো এবং সিনেমাজগতের সবচেয়ে প্রতিভাবান শিল্পী চ্যাপলিন তা ঠিকই অর্জন করে দেখিয়েছেন। চ্যাপলিন নিজে ভার্দ্যু চরিত্রকে তাঁর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে ব্রিলিয়ান্ট চরিত্র হিসেবে উল্লেখ করেছেন। একের পর এক খুন, খুনীকে ধরতে বেপরোয়া পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়েই নতুন নতুন শিকারকে বাগে আনতে রোমাঞ্চকর সব পন্থা অবলম্বন, সবসময়ই ধরা পড়ে যাওয়ার আশংকা নিয়েও নিজের বুদ্ধি দিয়ে পরিত্রাণ – এ সব কিছু বিচারে সাসপেন্স থ্রিলার হিসেবে ১০০ তে ১০০ পাবে এই মুভিটি।

Limelight (1952)



হালের “দা আর্টিস্ট” মুভিটি যারা দেখেছেন তারা এ ধারারই আইডিয়া নিয়ে তৈরি “লাইমলাইট” পছন্দ করবেন অবশ্যই। বার্ধক্যের দুশ্চিন্তা এবং তুমুল জনপ্রিয়তায় সারাজীবন কাটানো শিল্পী শেষ বয়সে লাইমলাইটের পিছনে চলে গেলে যে নিদারুণ কষ্টের মধ্যে দিয়ে দিনাতিপাত করতে হয় সেই চিত্রটাই তুলে ধরার প্রয়াস এ মুভি। একেবারে তরুণী এক নৃত্যশিল্পী হতাশ হয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে, ক্যালভেরো চরিত্রের চ্যাপ্লিন তাকে নিজের ঘরে এন চিকিতসা দিয়ে সুস্থ করে তোলেন, পৃথিবীর প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে তরুণী যখন বারবার বেঁচে থাকাটা অভিশাপ হিসেবে নেয় তখন বুড়ো ক্যালভেরোই তাঁকে উতসাহ দেন, প্রেরণা দেন আবার জীবনকে উপভোগ করার, নিজের ভিতরকার শক্তিকে জাগিয়ে পৃথিবীকে জয় করার। তরুণী সফল হয়ও, কিন্তু একের পর এক অবহেলা আর অবিচারে অতিষ্ঠ হয়ে বুড়ো নিজেই ভেঙ্গে পড়ে। লাইমলাইটের মাধ্যমে নিজের বুড়ো বয়সের হতাশাগুলোকেই বেশ সফলভাবেই চ্যাপ্লিন তুলে ধরেছেন ভক্তদের চোখের পর্দায়।

চার্লি চ্যাপলিনের যারা ভক্ত তাঁদের জন্যে একটা মজার তথ্য জানিয়ে লেখাটা শেষ করবো। চ্যাপলিন যে শুধু তাঁর সিনেমার মধ্যে দিয়ে আজো মানুষের মধ্যে বেঁচে আছেন তা নয়, আকাশের তারা হয়েও বিদ্যমান। ইউক্রেনিয়ান এক জ্যোতির্বিদ কারাচকিনা মঙ্গল আর বুধ গ্রহের মাঝখানে আবিষ্কার করা এক গ্রহের নামকরণ করেন “৩৬২৩ চ্যাপলিন” প্রিয় এই অভিনেতার নামে। সেই তারাও হয়তো কোনো একসময় কৃষ্ণগহ্বরে হারিয়ে যেতে পারে- কিন্তু চ্যাপ্লিন তাঁর মুভির মাধ্যমে আজ থেকে ১০০, ১০০০ বা ১ লাখ বছর পরেও ছেলে, বুড়ো, নিষ্পেষিত, অনাহারী সবার মুখেই শত দুঃখের মধ্যে হাসির ফোয়ারা বইয়ে দিবে।

উৎসর্গঃ ফাহাদ চৌধুরী মিশু ভাই, আমার নিজের লেখার স্টাইল ভালোনা আমি নিজে খুব ভালো জানি, কিন্তু উনার মত কিছু লেখক- যাদের লেখার স্টাইল থেকেই শিখি- মনে করেন আমার সিনেমা নিয়ে কিছু লেখা উচিত- তাই সাহস করি।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মার্চ, ২০১৩ রাত ১:৪১
২৩টি মন্তব্য ২২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×