‘ঢাকা শহরেত জ্যাম, ঢাকার বাইরেও জ্যাম, বলেন কোথায় যাই এবার’ -সামনের সিটের যাত্রীর কথায় জ্যোৎস্নার ঘুম ভাঙ্গল, না ঘুম ভাঙার পর সামনের সিটের যাত্রী কথা বলে উঠল, জ্যোৎস্না ঠিক বুঝতে পারল না। গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। কাঁচপুর ব্রীজ পার হওয়ার পর পরই জ্যোৎস্না ঘুমিয়ে পড়েছিল। পাশের সিটের লোকটাও ঘুমাচ্ছে। ঠিক কোথায় গাড়ী দাঁড়িয়ে আছে জ্যোৎস্না বুঝে উঠতে পারছে না। ঘড়িতে সময় দেখে সে প্রায় দেড় ঘন্টা ঘুমিয়ে ছিল। গাড়িতে তো সাধারণত আমার ঘুম হয়না, আজকে তে ঘুম হলো কেন? ভালই হয়েছে, শরীরটা ঝরঝরে লাগছে, জ্যোৎস্না ভাবে। হঠাৎ করেই গাড়ী ছেড়ে দেয়, খুব অল্প গতিতে কিছুদুর চলার পর একটা বাজারের কাছাকাছি এসে গাড়ী আবার থেমে যায়। একটা দোকানের সাইনবোর্ড দেখে জ্যোৎস্নাবুঝতে পারে গাড়ী মাত্র সোনারগাঁও এসেছে। পাশের সিটের লোক ঘুম থেকে জেগে ওঠে- কিছুক্ষণ জ্যামের উপর খিস্তি খেউর করে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। জানালা দিয়ে মাথা বের করে জ্যোৎস্না দেখল যতদূর দেখা যায় ততদূরই জ্যাম। গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে ড্রাইভার বাইরে গেছে। মনে হচ্ছে এ জ্যাম আর ছাড়বে না। চোখ বন্ধ করে জ্যোৎস্না ঘুমানোর চেষ্টা করে । ঘুম আসে না। জ্যোৎনার ভাবনারা ডালপালা মেলে। নিজ গ্রামের মতিন মিয়ার সাথে বিয়ে ঠিক হবার পর থেকে জ্যোৎস্নাআবার স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে। আজ এক সপ্তাহ ধরেই স্বপ্নের জাল বুনছে সে। এই জ্যামে, বাসে বসে জ্যোৎস্না স্বপ্নের জালের বুননে আরও গাঁথুনি দিতে লাগল।
আমাদের জ্যোৎস্নার কাহিনী অতি সাধারণ, আটপৌরে। রিক্সাচালক বাবার দুই মেয়ে আর তিন ছেলের সংসারে জ্যোৎস্না সবার বড়। কোন এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে বিনা চিকিৎসায় বাবা মারা যাওয়ার পর সপ্তম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় গ্রামের এক ধনী পরিবারের কাজের মেয়ে হিসাবে ঢাকা শহরে আসে। থাকা খাওয়া ফ্রি, মাসে পাঁচশ টাকা বেতন। জ্যোৎস্নার মনিব ভাগ্য ভালোই বলতে হবে, সবাই মোটামুটি ভাল ব্যবহার করে। জ্যোৎস্না বলতে গেলে সারা দিনই বাড়ীর বড় মেয়ে তানিয়া আপুর সাথে থাকে , আপুর ফাইফরমাস খাটে, আপুকে সঙ্গ দেয়। আপু জ্যোৎস্নাকে বই পড়তে দেয়, পত্রিকা পড়তে দেয়। মাঝে মাঝে অপু চোখ বন্ধ করে সটান হয়ে শুয়ে থাকেন আর জ্যোৎস্না তাকে বই পড়ে, পত্রিকা পড়ে শুনায়, ভুল হলেই আপু ধমক দিয়ে শুধরে দেয়। একদিন আপু জ্যোৎস্নাকে জিজ্ঞাসা করে, আচ্ছা জ্যোৎস্না তোর কি জ্যোৎস্না রাতে জন্ম হয়েছিল? সে জন্যই কি তোর নাম জ্যোৎস্না ?
- আপু জ্যোৎস্না রাত মানে কি ? রাত তো রাতই, অন্ধকার, মাঝে মাঝে চাঁদ ওঠে আবার অনেক সময় ওঠে না।
- দূর গাধা, আচ্ছা ঠিক আছে তোকে একদিন জ্যোৎস্না রাত দেখাব।
একদিন গভীর রাতে তানিয়া আপু জ্যোৎস্না ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলে বলে- জ্যোৎস্না চল ছাদে যাব, তোকে জ্যোৎস্না রাত দেখাব। জ্যোৎস্না ছাদে উঠে দেখে সবকিছু দিনের আলোর মতো পরিষ্কার দেখাচ্ছে। এত চাঁদের আলো যেন কোনদিন দেখেনি জ্যোৎস্না। তনিয়া আপু বলে ওঠে, বুঝলি মেয়ে এটাই জ্যোৎস্না রাত। তোর রাত- বলে খলখলিয়ে হেসে ওঠে তানিয়া আপু। হঠাৎ করেই তানিয়া আপু দু’হাত ছড়িয়ে ঘুরতে থাকেন আর কেমন করে যেন হাসতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর দু’হাত আকাশের দিকে তুলে কাঁদতে থাকেন। জ্যোৎস্নার কেমন যেন ভয় ভয় করতে লাগল। সে ভাবে আপু আজ এমন করছে কেন? আপু কি পাগল হয়ে গেছে।
হঠাৎ করে আপু তার হাত ধরে বলল, চল বাসায় চল, ঘুমানোর আগে তানিয়া আপু জ্যোৎস্না কে সতর্ক করে দিল এসব যেন বাড়ির কাউকে না বলে। এরপর থেকে জ্যোৎস্না আর আপু অনেকদিন ছাদে গেছে, সব সময় তানিয়া আপু একই রকম আচরণ করেছে। একসময় জ্যোৎস্নার ও আকাশের দিকে দু’হাত তুলে কাঁদতে ইচ্ছে করেছিল কিন্তু আপু থাকাতে লজ্জায় পারেনি। আপু বলতেন ঢাকা শহরের চেয়ে গ্রামের জ্যোৎস্না রাত আরও অনেক সুন্দর। আপুর শখ জ্যোৎস্না রাতে জংগলে গিয়ে বাঁশঝাড়ে বসে থাকার। জ্যোৎস্না তখন বলেছিল, আপু লোকে তখন আপনাকে পাগল বলবে আর রাতে বাঁশঝাড়ে গেলে আপনাকে ভূতে ধরবে। আপু তখন হেসে বলে উঠে তাহলে তো ডাবল মজা জ্যোৎস্না রাত ও দেখা হবে, ভূত বাবার সাথেও দেখা হবে।
জ্যোৎস্না ঢাকা শহরে আসার পর তার ফুপাতো ভাই জসিম ভাই আর তার বউ মাঝে মাঝে জ্যোৎস্নার খোঁজ খবর নিত। ওনারা দু’জনই গারমেন্টে চাকুরি করেন। জ্যোৎস্না কয়েকমাস পর পর তাদের কাছে বাড়ীর জন্য টাকা পাঠাতো। তানিয়া আপুদেও বাসায় বছর তিনেক থাকার পর জসিম ভাই জ্যোৎস্নার মাকে বলেন জ্যোৎস্না কে ঐ বাসা থেকে নিয়ে আসতে, উনি জ্যোৎস্নাকে গারমেন্টে চাকুরী ঠিক করে দিবেন, উনাদের সাথে থাকবে জ্যোৎস্না। জসিম ভাই জ্যোৎস্নার মাকে বুঝায়, বাসায় কাজ করলে সারা জীবন কাজের মেয়ে হয়ে থাকতে হবে, বেতন ও কম, আবার গারমেন্টে কাজ করলে শুরুতে বেতন কম হলেও অভিজ্ঞতা হওয়ার সাথে সাথে বেতন বাড়বে। সবশুনে মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে মা রাজী হয়ে গেলেন। তানিয়া আপুদের বাসা ছেড়ে যেতে জ্যোৎস্নার ভালো লাগছিলনা। তানিয়া আপুরা সব শুনে রাজী হয়ে গেলেন, না করলেন না। আসার সময় তানিয়া আপু জ্যোৎস্নাকে অনেক কিছু দিয়েছিলেন।
জ্যোৎস্নার মনে এখন প্রশান্তির বন্যা বইছে, আগামী শুক্রবার রাতেই তার আর মতিন মিয়ার বিয়ে। জ্যোৎস্নার পাশে থাকবে এখন থেকে একজন বিশ্বস্ত পুরুষ মানুষ। দু:খের সময় যার বুকে মাথা গুজে অঝোর ধারায় কেঁদে সে দু:খ থেকে মুক্তি খুঁজবে। এরপর জ্যোৎস্নার প্রয়োজন একটি ফুটফুটে তুলতুলে অতিথি, যাকে বুকে চেপে ধরে সে বিলিয়ে দিবে নিজের সমস্ত সঞ্চিত আদর আর ভালোবাসা।জ্যোৎস্না ভাবে একদিন জ্যোৎস্না রাতে সে মতিন মিয়াকে নিয়ে ঘরের বাইরে বের হবে। জোৎস্নার ভাবনার ছেদ পড়ে তাদের গাড়ীর ড্রাইভার আর পাশের গাড়ীর ড্রাইভারের ঝগড়ায়। ওভার টেকিং করা নিয়ে একে অপরকে দুষছে। পাশের সীটে একজন বিরক্তি প্রকাশে করে বলে, উঠল পাঁচ ঘন্টায় মাত্র দাউদকান্দি। জোৎস্না ব্যাগ থেকে ঘড়ি বের করে দেখের এখন সাতটা বাজে। সে কখন দুপুর ২টায় জসীম ভাই এসো তাকে গাড়ীতে তুলে দিয়ে গেছে। এতক্ষণে তার বার আউলিয়া পৌঁছে যাওয়ার কথা। তার মনে একটু ভয় ভয় লাগতে শুরু করল। বেশি রাত হলে সে বাড়ী ফিরবে কি করে? জোৎস্নাদের বাড়ী সীতাকুন্ড এলাকার বার আউলিয়া রাস্তার মাথা থেকে ৫-৬মাইল দূরে পাহাড়ের কোল ঘোঁষে। ওদের পরিচিত অনেকে রিক্সা চালায়। সবসময় পরিচিত কাউ না কাউকে পেয়ে যায়। কিন্তু বেশী রাত হলে সে কি রিক্সা পাবে? ইস! একটা মোবাইল থাকলে কি উপকার হতে। পাশের বাড়ীর এক ভাবীর মোবাইল নাম্বার তার কাছে আছে। জসীম ভাইয়ের মোবাইল থেকে মাঝে মাঝে ফোন করলে ভাবী জোৎস্নার মাকে ডেকে দিতে। জসীম ভাই কত বলেছে জোৎস্নাকে একটি মোবাইল নিতে কিন্তু জোৎস্না খরচ বেড়ে যাওয়ার ভয়ে নেয়নি। জোৎস্না একবার ভাবল, পাশের সীটের লোকটাকে বলবে তাঁর মোবাইল থেকে একটা কল করবে। কিন্তু দ্বিধা আর সংকোচে বলতে পারে না লোকটাও কেমন জানি একটু অন্যরকম। সারাক্ষণই কেবলই ঘুমাচ্ছে। কখনও অবশ্য গায়ে পড়ে আলাপ করার চেষ্টা করেনি। অবশ্য বাড়ীতে ফোন করেও কি হবে, কে আসবে? ভাইটাও অনেক ছোট কেবল মাত্র ক্লাস ফাইভে পড়ে। মায়ের পক্ষে এত রাত্রে আসা সম্ভব না। একবার মতিন মিয়ার কথা মনে পড়ল। মতিন মিয়ার কথা মনে পড়তেই জোৎস্না নিজের কাছে নিজেই লজ্জা পেল। জোৎস্না ভাবে মতিন মিয়া তাঁকে এত রাত্রে নিতে আসলে সবাই কি ভাববে। জোৎস্না যখন বার আউলিয়া বাজারে এসে নামল তখন রাত বারটা ছুঁই ছুঁই। দু-একজন মানুষ আনা-গোনা করছে, দু-একটা দোকান এখনও খোলা আছে। একটা রিক্সা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু চালককে দেখতে পেলনা জোৎস্না। চালক মনে হয় আশে-পাশে কোথাও আছে জোৎস্না ভাবে। একটু সাহস সঞ্চয় করে জোৎস্না পাশের চায়ের দোকানে দিকে এগিয়ে যায়।
- ভাই, এই রিক্সার ড্রাইভার কই?
দোকানের ভেতর থেকে কই যাইবেন বলে বের হয়ে আসেন রিক্সা চালক আব্দুর রশিদ।
- আরে আমাদের জোৎস্না না, একটু অবাক হয় আব্দুর রশিদ। রশিদ জোৎস্নার আব্বার বন্ধু ছিলেন। তুই এত রাতে কোথায় থেকে জোৎস্না?
- ঢাকা থেকে চাচা। প্রচন্ড জ্যাম রাস্তায়। সেই দুপুর দুটায় গাড়ীতে উঠেছি।
- আর বলিস না ইদানিং কি যে হইছে রাস্তাটার সবসময় জ্যাম থাকে। কারও কোন মাথা ব্যাথা নাই এই নিয়ে। যাক তোর ভাগ্য ভালো আমি ছিলাম। আল্লাহ ভরসা রিকসায় উঠ।
রিকসা চালাতে চালাতে আবার কথা বলতে শুরু রশিদ মিয়া
- শুনলাম তোর বিয়ে ঠিক হয়েছে মতিন মিয়ার সাথে। জোৎস্না চুপ থাকে। রশিদ আবার বলে উঠে ছেলেটা খুব ভালো আর কর্মঠ। আমার খুব পছন্দ।
ভরা জোৎস্না রাত। রাস্তার আশে-পাশে সব কিছু দেখা যাচ্ছে। মতিন মিয়ার দোকানের সামনে দিয়ে রিক্সা যাবে। ইস্! যদি এই ভরা জোৎস্নার গভীর রাতে মতিন মিয়ার দোকান খোলা থাকত তাহলে লোকটাকে একনজর দেখে যেতে পারত, জোৎস্না ভাবে। মতিন মিয়াকে নিয়ে জোৎস্নার মনে নানা স্বপ্ন খেলা করতে থাকে।
ঐদিকে স্বপ্ন শিকারীরাও বসে নেই। মানুষের চোখ দেখে ওরা বুঝে যায় কার চোখে স্বপ্ন আছে। তারপর ঐ স্বপ্ন তারা চুরি করে। ওদের নিজেদের কোন স্বপ্ন নেই তাই এরা অন্যের স্বপ্ন চুরি করে বেড়ায়। আজরাতেও ওরা তিনজন রাস্তার পাশে জংলার ধারে ওত পেতে বসে আছে শিকারের সন্ধানে। দু একজন লোক অবশ্য রাস্তা দিয়ে গেছে কিন্তু ওদের চোখে স্বপ্নের দ্যুতি দেখেনি তাই ওদেও ছেড়ে দিয়েছে। দূর থেকে একটা রিক্সা আসতে দেখে ওরা তিনজন নড়ে-চড়ে ওঠে। স্বপ্ন শিকারীদের একজন জঙ্গল থেকে বের হয়ে রাস্তার আসে। জোৎস্না রাতে এতদূর থেকে দেখতে পায় রিকসা যাত্রীর চোখে স্বপ্ন ঝলঝল করছে। রিকসা ওর কাছাকাছি হতেই একটু জোরে সঙ্গীদের উদ্দেশ্যে বলে উঠে ওরে মেয়ে মানুষ তাড়াতাড়ি আয়। তিনজন মিলে রিকসাটা ঘিরে ধরে। জোৎস্না কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুজন ওর মুখ চেপে ধরে। ওকে রিকসা থেকে নামিয়ে জঙ্গলের দিকে নিয়ে যায়। আরেকজন ততক্ষণে কুপিয়ে রিকসা চালক রশীদকে চেতনাহীন করে ফেলেছে।
জোৎস্না এখন হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে। চেতন আর অর্ধ-চেতন এর মাঝামাঝি একটা ঘোরের ভিতর আসে সে। এক এক সময় মনে হয় ও এক এক জায়গায় আছে। একবার মনে হয় সে মতিন মিয়ার হাত ধরে বসে আছে। একবার মনে হয় গার্মেন্টে কাজ করছে। কখনও কখনও মনে হচ্ছে সে ও তানিয়া আপুদের বাসার ছাদে হাত তুলে আকাশের পানে তাকিয়ে আছে। জোৎস্নার হঠাৎ মনে হল সে থানায় বসে আছে। পত্রিকার সাংবাদিকরা তার ছবি তুলছে , তাকে ঘিরে নানা প্রশ্ন করছে। একসময় জোৎস্না থানা থেকে বের হয়ে আসে। কিছুদূর আসার পর জোৎস্নার মনে হচ্ছিল আশে-পাশের লোকগুলো তার দিকে আড় চোখে তাকাচ্ছে আর মিটিমিটি হাসছে। আস্তে আস্তে পাশের লোকগুলোর হাসির ঝলকানি বাড়তে থাকে। ঐ হাসতে থাকা লোকগুলোর মাঝে সে মতিন মিয়াকেও দেখতে পায়।