১। আমার মা, আমার বাসায় আসলে খুব বিরক্ত হন। কারন হচ্ছে (ওনার ভাষ্য) আমি মেরাজকে দিয়ে সংসারের কাজ করাই। যতবার বলি মেরাজ করে, ততবার উনি তেতে উঠেন। একদিন বললাম, আম্মু সারাজীবন দেখলাম আব্বু খাওয়ার আগে আমাদের টেবিলে বসাচ্ছে, পানি এনে দিচ্ছে, আমাকে খাওয়ায় দিচ্ছে, দরকার হলে কাপড় চোপড় পরিস্কার করে দিচ্ছে, নাতনীদের আদর করে কোলে নিয়ে বেরাচ্ছে, মেরাজ করলে সমস্যা কোথায়? আম্মু গজ গজ করতে থাকলেন বললেন মেরাজদের বাসায় এইগুলি পছন্দ করে না এবং ঘোষনা দিলেন আমি একটা বেয়াদব!
২। আমাদের বিয়ের পরে আব্বু যখন রংপুরে অনুষ্ঠান করলেন, মেরাজদের বাসা থেকে যারা গিয়েছিলেন বরযাত্রী হিসেবে, তারা বেশ কয়েকদিন বাসায় ছিলেন। বিয়ে বাড়ি যেমন গম গম করে, সেই রকম অপরিস্কার ও হয়। আব্বু পর পর কয়েকদিন নিজের হাতে সিড়িঘর, সামনের উঠান পরিস্কার করছিলেন। আমি দেখিও নি, আমার শ্বাশুড়ি আম্মা পরে আমাকে এই গল্প বলেছিলেন। আব্বুকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এতগুলি কাজের লোক থাকতে তোমার অসুস্থ্য শরীরে কেন ক্লিন করতে হবে? আব্বু হাসতে হাসতে বলতেছিলো যে, ওরা সারাদিন কাজ করে ক্লান্ত, সকালে উঠেই সেটা করতে বললে হয়তো ভালো করে করতোও না।
৩। বিয়ের পর গৃহকর্ম করা নিয়ে কমবেশি মনোমালিন্য হয়েছে পরিবারের সদস্যদের সাথে। বিয়ের আগে এবং পরে কিছুটা সময় আমি একা বগুড়া থাকতাম চাকুরির সুবাদে। সপ্তাহে বেশ কিছুদিন ফিল্ডে যেতে হত, অফিস আওয়ারের ঠিক ঠিকানা ছিলো না। সুতরাং কাজের লোক রাখার সুযোগ ও ছিলো না। অফিস, বাজার, রান্না, ক্লিনিং সব একহাতে করতে হতো। করতামও। মেরাজ যতদিন বাসায় থাকতো সহযোগীতা করতো খুব। আমার শ্বাশুড়ি বেড়াতে এসে বলেই ফেললেন যে, “আমাদের বাসায় ছেলেরা কাজ করে না” । আমি বুঝতেই পারি নি উনি কেন বললেন। পরে রেফারেন্স হিসেবে ২ নম্বর ঘটনা উল্লেখ করলেন, এবং আমাকে বোঝানো হলো যে যেহেতু আমার মা বাবাকে দিয়ে কাজ করান/ বাবা বাসার কাজ করেন, সুতরাং আমি এটা শিখেছি। ঘটনা এখানেই সীমাবদ্ধ থাকে নি, সেটা আমার মাও কোন উপায়ে জানতে পেরেছেন এবং পরবর্তীতে আমাকে অপ্রয়জনীয় ভাবে শাসন করেছেন এবং এখনো করেন।
৪। অফিসের কাজে মিটিং এ বাড়ি ফিরতে দেরী হবে। শাশুড়ি বাসায়। সেটা জেনে অফিসের কলিগ ফট করে বলে বসলেন, কী, কাজে ফাকি দেয়ার জন্য মিটিং এ যাচ্ছেন? সহজ বাংলায় মানেটা হচ্ছে আমি আমার শাশুড়িকে দিয়ে ঘরের কাজ করানোর জন্য দেরী করে বাসায় ফিরবো। আমি “থ”। অপ্রয়োজনে কেউ অফিসে বসে থাকে? বা মিটিং রাখে? আমি মেয়ে জন্য আমার বাড়ির কাজ আগে? বাসায় শাশুড়ি আছেন জন্য প্রফেশনাল কাজ কে আমি প্রায়োরিটি দিতে পারবো না ?
৫। মেরাজ এর অফিসের ডে আউট। ওর সব কলিগরা ফ্যামিলি সহ বেড়াতে গিয়েছি। ওর একজন কলিগ হঠাৎ করে বলে বসলেন, “মেরাজ ভাই আপনার অফিসের ডে আউটে আসার সুযোগ হলো তাহলে”! মেরাজ বরাবরের মত হেসে চুপ। আমি ওর কলিগদের সাথে কথা বলে জানলাম মেরাজ অনেক পার্টি অ্যাভয়েড করার সুযোগ থাকলে ডুব মারে। মেরাজকে জিজ্ঞাসা করলাম, ও বললো আমার হই হুল্লোড় ভাল্লাগেনা তুমি তো জানোই। পরে বুঝলাম যে, আমি যেহেতু অফিসের প্রয়োজনে অনেক ট্যুর করি, যদি বাসায় থাকি তাহলে হয়তো আমাকে সময় দেয়, নাহলে বাসায় কেউ থাকে (আমার বাবা মা/ অথবা ওর মা), অফিসের বাহিরের সময়টা অপ্রয়োজনীয় পার্টি অ্যাভয়েড করেে। আমি হলেও অবশ্যই তাই করতাম বা করি।
এখন গৃহের কাজের পলিটিক্সটা বোঝেন ! এইসব ঘটনা উল্লেখ করা মানে শাশুড়ি আম্মা ভিলেন/ অফিস আওয়ারের বাহিরে মিটিং রাখা আমি ভিলেনই তা না, আমাদের পুরা স্ট্রাকচারটা কি পরিমান ভিলেন সেইটা বোঝার চেষ্টা করেন। আমি প্রয়োজনীয় মিটিং এ গেলে সেটা খারাপ কারন “বাসার কাজে ফাকি দিচ্ছি” মেরাজ অপ্রয়োজনীয় পার্টি অ্যাভয়েড করলে সেটা দেখা খারাপ কারন “বাসায় সময় দিচ্ছে”। যারা চাকুরি করি এবং বিবাহিত তাদের মধ্যে গুটিকয়েক সৌভাগ্যবান যাদের ফুল টাইম গৃহকর্মী আছে তারা ছাড়া বেশিরভাগ নারীকেই এই ঘরের কাজ, বাহিরের কাজ ব্যালেন্স করে চলতে জানতে হয়। ভাই, বিশ্বাস করেন কোন জ্বীন পরী এসে করে দিয়ে যায় না।
আমি একবার এইসব কোন একটা পলিটিক্স এ খুব মন খারাপ করে মেরাজকে বলেছিলাম, “আমার না বলার কোন অপসন নাই”। মেরাজ সোজা উত্তর দিয়েছিলো, “না” বলা অভ্যাস করো। তোমার সমস্যা কি, এত সারাক্ষন আমি ভালো বউ/ মেয়ে প্রমাণ করতে হবে এই ধারনা নিয়ে চলো কেন? আমি বলেছিলাম যে, এত সহজ না বুঝলে, এইগুলি এয়ার প্রেসারের মত, তুমি চাও বা না চাও আশেপাশে থাকেই।
আমাকে সবাই ভাগ্যবতী বলে। কারণ আমার জীবনটা আমি যার সাথে শেয়ার করি, তার সাপোর্ট আমি পাই । আমাদের বাসায় আমরা বাসি খাই, এবেলার তরকারি ও বেলা খাই, ভাগ করে ঘরের কাজ করি। যাদের সমস্যা হয় এইসবে তাদের আসতে “না” বলে দিয়েছি, আমার অপ্রয়োজনীয় গৃহকর্মে মন নাই। আমার যোগ্যতা বোঝার যোগ্যতা যাদের নেই তাদের আমি পুছি না !!
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুন, ২০২০ রাত ৯:৩১