somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মহামারীর দিনগুলি-৬: ঘুড়ির লেজে এক বিকেল

১৫ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ৯:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

একটা কাটা ঘুড়ির লেজ। ভাঁজ করে রাখা। মানিব্যাগের কোণায়। আজ প্রায় দুই বছর। মাঝে একবার মানিব্যাগ পাল্টেছে। পুরনোটা ফেলে নতুন ব্যাগে প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র চালান করার সময় ঘুড়ির লেজটা নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, কেন এতদিন ধরে রেখেছি এটা?

কিন্তু ফেলে দিতে পারিনি। লেজটার ভাঁজ খুলে আবারো ভাঁজ করে ব্যাগে রেখেছি। যে পকেটে লেজটা আছে সেখানে সাধারণত টাকা রাখা হয় না। তবু, টাকা-পয়সা বের করার সময় মাঝে মাঝে কাগজের টুকরোটা চোখে পড়ে। এটা কাগজ বটে। আবার নাও বটে। কাগজের ঘুড়ি। ঘুড়ি। ঘুড়ির সাথে জড়িয়ে থাকে দূরের ডাক। ঘুড়ি একই সাথে মানুষের শেকড় ও ডানার রূপক। মানুষ ভোকাট্টা হয়ে যেতে চায় না।

ছোটোবেলায় ঘুড্ডি উড়ানোর জন্যে ছেলেদের সাথে মাঠে যেতাম। কাটা ঘুড্ডি ধরতে ছেলেদের দলের সাথে ছুটতাম উর্ধশ্বাসে।

আজ বিকেলে অনেক্ষণ ঘুড়ি উড়ানো দেখলাম। আমার শোবার ঘরের বারান্দার ওপাশে একটা নির্মানাধীন ভবন। এক তলা উঠে করোনার কারণে এখন কাজ বন্ধ। আমার বারান্দার জন্য করোনা শাপে বর হয়ে এলো। কন্সট্রাকশানের কাজ নেই। আওয়াজ নেই। শান্ত সকাল। নিঝুম দুপুর। নীরব সন্ধ্যা। নিরিবিলি রাত। পাখির ডাক ছাড়া অন্য আওয়াজ নেই। কন্সট্রাকশান সাইটটা বেশ বড়। এর একপাড়ে আমার ঘর। আরেক পাড়ে গলির ধার ঘেষে এক সার ভবন। ভবনগুলো একেকটা চার পাঁচ তলা। সেখানেই কোনো একটা ভবনের ছাদ থেকে দু’টো ঘুড়ি ওড়ছিলো। একই রঙের ঘুড়ি।

মানিব্যাগে থাকা ঘুড়ির লম্বা লেজটা কুড়িয়ে পেয়েছিলাম কলম্বোতে। সাগর পাড়ে। গল ফেস বলে একটা জায়গা আছে। সমুদ্রের তীরে সবুজ খোলা চত্বর। মানুষজন আড্ডা দেয়। দল বেঁধে আসা পরিবারের সদস্যরা চাদর বিছিয়ে শুয়ে বসে থাকে। শিশুরা খেলা করে। ঘুড়ি ওড়ায়।

চত্বরের দক্ষিণ দিক শেষ হয়েছে সাগরের বাঁধানো পাড় ঘেষে। বাঁধানো উঁচু অংশটাতে মানুষেরা বসে থাকে। কেউ সাগরের দিকে মুখ করে পা ঝুলিয়ে দেয়। পায়ের নিচে সশব্দে ভেঙে পড়ে ঢেউ। কেউ বসে সাগরের দিকে পিঠ দিয়ে। তার ঘাড়ে পিঠে বাতাস আছড়ে পড়ে। মাঠ আর বাঁধানো উঁচু পাড়ের মাঝখানে অসংখ্য খাবারের দোকান। দোকান মানে ভ্যান। সবই মুভেবল। মুখরোচক সব খাবার।

তিনদিনের একটা কনভেনিঙে অংশ নিতে গিয়েছিলাম। ২০১৮ সালে। সকাল থেকে বিকেল অব্দি কাজ। কাজ ফুরোলেই ধনুক থেকে ছুটে যাওয়া তীরের মতন তীব্র বেগে আমি সাগর পাড়ে উড়ে যেতাম। ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতাম, হাঁটতাম সাগর পাড়ে। ঢেউয়ের মুর্ছনায় তৈরি ঘোরের কাছে মদীরা ব্যর্থ।

এর আগেও গিয়েছিলাম কলম্বোতে। সেবার ক’জন বাংলাদেশীকে পেয়েছিলাম। সেই সফর অমোচনীয় স্মৃতি। সাগর শিখিয়েছে, মহাসাগরের পাড়ে ক্ষণিক সময়ের জন্যে যে অচিন মানুষের দেখা মেলে আজীবন একসাথে থেকেও সেই মানুষের দেখা কেউ নাও পেতে পারে। কী জানি! আজীবনেও নিজের দেখা না পাওয়া মানুষও হয়তো সাগর পাড়ে চকিতে একবার নিজের অচিনের দেখা পায়!

ঘুড়ির লেজটা কুড়িয়ে এনেছিলাম শেষবার। ২০১৮ সালে। ফিরতি ফ্লাইট ছিল খুব সকালে। ভোর চারটায় হোটেল ছাড়ার কথা। বিদায় রাতে মনে হলো, সারারাত সাগর পাড়ে থাকা যেতো যদি! তা তো আর হয় না। রাত নয়টা সাড়ে নয়টা নাগাদ হয়তো ছিলাম। বসে থাকলাম। খেলাম। হাঁটলাম। আবার খেলাম। পানিতে পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আবার খেলাম। আবার হাঁটলাম। আবার বাঁধানো উঁচু চত্বরে বসে রইলাম। এসবের আগে সন্ধ্যার দিকে সবুজ মাঠটাতে একটা শিশুর সাথে ঘুড়ি ওড়ালাম। ওই সবুজ মাঠেই কুড়িয়ে পাওয়া রঙীন ঘুড়ির সেই লম্বা লেজ।

মানুষ বোধ হয় অর্থহীন এমন অনেক কাজ করে। কেউ জমিয়ে রাখে কাটা ঘুড়ির লেজ। কেউ জমিয়ে রাখে বাবার কবরের ঘাস। কেউ নিজেকে হারিয়ে যেতে দেয়, স্বেচ্ছায়।

করোনায় অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে বটে। কিন্তু করোনা পৃথিবীকে এনে দিয়েছে এক অচিন্তনীয় আশীর্বাদ। ব্যস্ত-ত্রস্ত মানুষ দিয়েছে অবসর।

দিবানিশি ব্যস্ততার নামে মানুষ সারাক্ষণ ছুটছে। ছুটছে। ছুটছে। কেন ছুটছে? কোথায় ছুটছে?

হ্যাঁ, ছোটাই স্বাভাবিকতা। কিন্তু ছুটতে ছুটতে নিজের জীবনটাকেই ভুলে গেলে এই ছোটার অর্থ কী? সুখে থাকার জন্য মানুষের টাকা চাই। বেশি টাকা রোজগার করতে গেলে বেশি কাজ। বেশি কাজ করতে গিয়ে বেশি ব্যস্ততা। ব্যস্ততার ভারে বাবা-মাকে সময় দিতে পারে না সন্তান। সন্তানকে সময় দিতে পারে না বাবা-মা। স্বামী সময় দিতে পারে না স্ত্রীকে। স্ত্রী সময় দিতে পারে না স্বামীকে। ভালোবাসার মানুষকে পাশে নিয়ে চুপচাপ নির্ভার বসে থাকবার মতন তাড়াহীন সময় মানুষের মেলে না। আত্মীয়, স্বজন, বন্ধু, সহকর্মী কারোর মুখের দিকে তাড়াহুড়োহীন হয়ে তাকাবার ফুরসৎ যেনো কারো নেই। সবাই ছুটছে।

সবাই ছুটছে। জীবনের পিছু। কিন্তু ছুটতে ছুটতে একদিন বিরাম নিতে গিয়ে দেখে জীবনটাই হাত ফস্কে গেছে কোথায়!

করোনায় জগৎ স্থির হয়ে আছে। যাদের পরিবারে কেউ আক্রান্ত হয়নি, যাদের তিনবেলা আহারের ব্যবস্থা আছে, তাদের কাছে তো করোনাজনিত এই বাধ্যতামূলক ছুটি একটা আশীর্বাদই হবার কথা! করোনার নিয়ামত হিসেবেই মিলেছে তাড়াহুড়োহীন কয়েকটা দিন। মিলেছে নিজের চোখের দিকে তাকাবার ফুরসৎ। গৃহবন্দিত্বের দিনে মিলেছে ভালোবাসার মানুষেরে অনুচ্চারেই ভালোবাসা প্রকাশের দিন। মিলেছে মানুষকে ক্ষমা করে দেবার, ক্ষমা চেয়ে নেবার অনন্য উপলক্ষ। কিন্তু এমন দিনেও তাড়াহুড়োময় জীবনের জন্য মানুষের মন কেমন করছে!

কী জানি, মানুষ হয়তো এমনই। ব্যস্ততা বেছে নিয়ে ভাবে অবসরই ভালো। অবসর পেয়ে ভাবে, ব্যস্ততাই মধুর। প্রতিটা মানুষের মনেই হয়তো রবীন্দ্রনাথ। যাহা চায় ভুল করে চায়, যাহা পায় তাহা চায় না।

১৫.০৪.২০
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ৯:৩১
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্যবহারে বংশের পরিচয় নয় ব্যক্তিক পরিচয়।

লিখেছেন এম ডি মুসা, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৫

১ম ধাপঃ

দৈনন্দিন জীবনে চলার পথে কত মানুষের সাথে দেখা হয়। মানুষের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য আসলেই লুকিয়ে রাখে। এভাবেই চলাফেরা করে। মানুষের আভিজাত্য বৈশিষ্ট্য তার বৈশিষ্ট্য। সময়ের সাথে সাথে কেউ কেউ সম্পূর্ণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মহিলা আম্পায়ার, কিছু খেলোয়ারদের নারী বিদ্বেষী মনোভাব লুকানো যায় নি

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯



গত বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক ও মোহামেডানের ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। অভিযোগ উঠেছে, লিগে দুইয়ে থাকা মোহামেডান ও পাঁচে থাকা প্রাইমের মধ্যকার ম্যাচে নারী আম্পায়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জানা আপুর আপডেট

লিখেছেন আরাফআহনাফ, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭

জানা আপুর কোন আপডেট পাচ্ছি না অনেকদিন!
কেমন আছেন তিনি - জানলে কেউ কী জানবেন -প্লিজ?
প্রিয় আপুর জন্য অজস্র শুভ কামনা।



বি:দ্র:
নেটে খুঁজে পেলাম এই লিন্ক টা - সবার প্রোফাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন

বন্ধুর বউ কে শাড়ি উপহার দিলেন ব্যারিস্টার সুমন। বাটার প্লাই এফেক্ট এর সুন্দর উদাহারন।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭



এক দেশে ছিলো এক ছেলে। তিনি ছিলেন ব্যারিস্টার। তার নাম ব্যারিস্টার সুমন। তিনি একজন সম্মানিত আইনসভার সদস্য। তিনি সরকার কতৃক কিছু শাড়ি পায়, তার জনগণের মাঝে বিলি করার জন্য।... ...বাকিটুকু পড়ুন

অধুনা পাল্টে যাওয়া গ্রাম বা মফঃস্বল আর ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া শহুরে মানুষ!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০০


দেশের দ্রব্যমুল্যের বাজারে আগুন। মধ্যবিত্তরা তো বটেই উচ্চবিত্তরা পর্যন্ত বাজারে গিয়ে আয়ের সাথে ব্যায়ের তাল মেলাতে হিমসিম খাচ্ছে- - একদিকে বাইরে সুর্য আগুনে উত্তাপ ছড়াচ্ছে অন্যদিকে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমুল্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

×