লেখায় প্রবেশের পূর্বে চলুন একটা তালিকা দেখে নেয়া যাকঃ
চালঃ ক্যাডমিয়াম; আটাঃ চক পাউডার; পোল্ট্রি গোশত ও ডিমঃ সহনীয় মাত্রার ৩/৪ গুণ বেশি ক্রোমিয়াম; গরুঃ স্টেরোয়েড টেবলেট; মাছ, গোশত, দুধ ও ফলঃ ফরমালিন; কৃত্রিম দুধঃ খাওয়ার সোডা, বিষাক্ত পারক্সাইড, বিষাক্ত ক্যামিকেল; সয়াবিন তেলঃ পাম অয়েল; সর্ষে তেলঃ মরিচের গুঁড়া, সাবান তৈরির ক্যাস্টার অয়েল ও ক্যামিকেল ঝাঁঝ; গাওয়া ঘিঃ মিষ্টিকুমড়া-গাজর, রঙ, ফ্লেভার ও প্রিজারভেটিভ; মরিচের গুঁড়াঃ ইটের গুঁড়া; ধনে গুড়াঃ কাঠের গুঁড়া, ধানের ভূষি; হলুদঃ বিষাক্ত ক্যামিকেল, সীসা; মুড়িঃ ইউরিয়া; গুড়ঃ হাইড্রোজ; চানাচুর, বিস্কুট, সমোচা, প্যাটিসঃ গাড়ির পোড়া মবিল; মিনারেল ওয়াটারঃ লিড, ক্যাডমিয়াম, জিঙ্ক; শাকসবজিঃ কীটনাশক;
কলা, মাল্টা, আপেল, আঙ্গুর, খেজুর, আম, সেমাই, নডুলস, আনারস, টমেটোঃ ফরমালিন।
আশা করি উপরের তালিকাটা দেখেছেন। দৈনন্দিন প্রতিটি ভোগ্যপন্যের পাশে তাতে মেশানো ভেজালের নামটি উল্লেখ করা হয়েছে। আপাতত আমার যতগুলো মনে পড়েছে সেগুলোই লিখেছি কিন্তু এই তালিকা এতই বিশাল যে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের এমন কোন ভোগ্য পন্য নেই যেটায় উচ্চমাত্রায় ভেজাল মেশানো নেই। এটা ঠিক ভেজাল নয় বরং প্রানঘাতি। গত বছর জাতীয় জনস্বাস্থ্য ইন্সটিউট সারাদেশ থেকে ৪৩টি ভোগ্যপণ্যের মোট ৫ হাজার ৩৯৬টি নমুনা পরীক্ষা করে৷ আর বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, তাদের ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে খাবারের তালিকাভুক্ত ৪৩ ধরনের পণ্যেই ভেজাল পাওয়া গেছে৷ ভেজালের পরিমাণ গড়ে শতকরা ৪০ ভাগ৷ এর মধ্যে ১৩টি পণ্যে ভেজালের হার প্রায় শতভাগ। তাহলে বোঝেন অবস্থাটা!
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু ও ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ আমিরুল মোর্শেদ খসরু বলছেন, "সম্প্রতি শিশুদের মধ্যে ক্যান্সারের মাত্রা অনেক বেড়ে গেছে, যা আগে কখনও দেখা যেত না। এসব ভেজাল খাদ্যের কারণে প্রথমে ডায়রিয়া বা বমিভাব বেশি দেখা দেয়। যা দীর্ঘমেয়াদে ক্যান্সারে রূপ নিচ্ছে। ভেজাল খাদ্যের কারণে খাদ্যনালীতে ক্যান্সার, লিভার বা ব্লাড ক্যান্সার, মেয়েদের জরায়ুতে ক্যান্সারের প্রবণতা অনেক বাড়ছে, যা আগে খুব কম দেখা মিলত। চিকিৎসায় প্রমাণিত হয়েছে এগুলোর মূল কারণ হচ্ছে খাদ্যে ভেজাল। শিশুদের খাবার হিসেবে যা দেয়া হচ্ছে তাকে বর্তমানে আশঙ্কামুক্ত বলা যাবে না। এর প্রভাব শুধু শিশুদের নয়, সব মানুষের ওপর পড়ছে কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে বোঝা যাচ্ছে না। যখন ধরা পড়ছে তখন এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়ার কোন উপায় থাকে না।"
ফেসবুকে কিছু ছবি সমেত কামাল ভাইর (আপনারা তাকে চিনবেন না, সে আমার পরিচিত) একটা পোস্টে আমার চোখ আটকে গেল! হুবহু তুলে দিলাম!
"ঘুনে ধরা সমাজ, নষ্ট আর মিথ্যার প্রতিযোগিতার রাষ্ট্রে বিশ্বাসের দিন শেষ, এ আমার বাংলাদেশ. দেশে অসংখ্য খাটি সরিষার তেল থাকলেও কেউ কাউকে আর বিশ্বাস/ভরসা করতে পারছেনা তাই ইনোভেটিভ আইডিয়া এখন ঢাকার রাস্তায়.নগদে খাটি সরিষার তেল. চোখের সামনে ভাঙানো দামও হাতের নাগালে, 200টাকা কেজি"
ছবিগুলোঃ
বস্তুত পুরো দেশের মানুষ ভোগ্য পন্যের উচ্চমূল্য আর ভেজাল নামক বিষ খেতে খেতে অতীষ্ট হয়ে উঠেছে। স্বল্প টাকায় তারা ভালো এবং নির্ভেজাল পন্য খুঁজছে। আর তাই হয়তোবা এমন ভ্রাম্যমান আধুনিক সরিষার তেলের ঘানি কিংবা রাজধানীর কাঁচা বাজারের ভেতরে ছোট ছোট হাউস তথা পুকুর বানিয়ে জ্যান্ত রুই, কাতলা, তেলাপিয়া, কালবাউস মাছ দেদারছে বিক্রি হবার দৃশ্য আমাদের চোখে পড়ছে।
আপনারা ভ্রাম্যমান আদালতের কথা ভাবছেন, আমি জানি। খাদ্যে ভেজাল বা ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মেশানোর অভিযোগে ‘নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩’ তে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। এছাড়া খাদ্য নিয়ে মিথ্যা বিজ্ঞাপন, নিবন্ধন ছাড়া খাদ্যপণ্য বিপণন, ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত কাউকে দিয়ে খাদ্য বিক্রি করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে এই আইনে। বলা হচ্ছে, ১৯৫৯ সালের বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ নামে পরিচিত এ সংক্রান্ত প্রচলিত আইনটি অনেক দিনের পুরনো হওয়ায় তাতে অপরাধীর শাস্তির মাত্রা যথেষ্ট নয় বিধায় একটি কঠোর আইন প্রণয়ন জরুরি হয়ে পড়েছিল। এ পরিপ্রেক্ষিতেই প্রণীত হয়েছে নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩। প্রশ্নটা হচ্ছে আইনটি কতটুকু কঠোর কিংবা আইনের পুরোদস্তুর বাস্তবায়ন না থাকলে সেই আইন কতটা কঠোর হতে পারে? মাঝে মাঝে যে দু-একটা ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালিত হচ্ছে না, বিষয়টা তেমন নয় হচ্ছে তবে সেটা পর্যাপ্ত নয়। আমার তো মনে হয়, খাদ্যে বিষ মেশানোতে অনেক বড় একটা চক্র কাজ করে এবং অনেক বেশী শক্তিশালী এই চক্রটি। এই সিন্ডিকেট ভাঙ্গার শক্তি কিংবা সাহস আমাদের ভ্রাম্যমান আদালতগুলোর রয়েছে কি? সেটা একটা মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন!
২০০৮ সালে চীনে মেলামাইন মিশ্রিত দুধ খেয়ে কমপক্ষে ৬ শিশুর মৃত্যু এবং প্রায় ৩ লাখ লোক অসুস্থ হয়ে পড়ে। গোটা বিশ্বে তোলপাড় সৃষ্টি করে ওই ঘটনা। এরপর থেকেই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সংগ্রাম করে আসছে চীন। কঠোর দমনাভিযান চালিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে তারা। চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের বিবৃতি অনুযায়ী শুধু ২০১১ সালের প্রথম ছয় মাসে খাদ্যে ভেজালের কারণে চীন ২ হাজারের বেশি মানুষকে প্রেপ্তার করেছে, পাশাপাশি বেশ কয়েক টন ভেজাল খাদ্য আটক করা ছাড়াও এবং ৫ হাজারের বেশি কোম্পানি বন্ধ করে দিয়েছে। এবং কি বিষাক্ত রাসায়নিক মেশানো শুকরের মাংস বিক্রির দায়ে একজনকে মৃত্যুদন্ড পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। আর ফলাফলটা আজকে চীনের খাবার দাবার শতভাগ ভেজালমুক্ত।
বিগত দশটা বছরে, আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়নের যে চিত্র তা সত্যিই অনেক প্রশংসার দ্বাবিদার! আমার যদি ভূল না হয় তবে, ২০১৯ এ নির্বাচনী ইশতেহারে কোন দলের কোথাও আমি খাদ্যে ভেজাল মেশানোর বিরুদ্ধে সংগ্রামের উল্লেখ পেলাম না যেটা সত্যিই উদ্যেগজনক। ক্ষুধামুক্ত আগামীর বাংলাদেশের মূল চ্যালেঞ্জই হবে কিন্তু খাদ্যে ভেজাল! আর এই ভেজাল হতে রেহাই, আমরা কেউ পাবো না।
বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক!
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জানুয়ারি, ২০১৯ দুপুর ২:২৬