নববর্ষ উপলক্ষে কালু দা তার পুরো জীবনকালে কখনোই কোন ধরনের আয়োজনের অভাব বোধ করেননি! এই দৃষ্টিকোন হতে আমরা তাকে বেশ বড়লোক হিসেবে বিবেচনা করলে করতেও পারি তবে কাচা লংকা সমেত নববর্ষীয় পানি-পান্তা ভাত যার নিত্য সংগী সেই মানুষটাকে কোন ভাবেই আর্থিক ভাবে স্বচ্ছল বলাটা তার দারিদ্র্যের প্রতি তাচ্ছিল্য বৈ আর কিছুই নয়। চরম দারিদ্রতার গল্পটা মুখ ফুটে বলবার জায়গা ছিল না তার, কারন গরীব হলেও আত্ম-সম্মানবোধটুকু তখনো বেঁচে ছিল তার মাঝে!
মাঝে মাঝে আমাকে বলত। চেষ্টা করতাম প্রতি মাসে সামান্য কিছু টাকা পাঠিয়ে তার কষ্টে সামান্য শরীক হতে কিন্তু হু হু করে নিত্য বেড়ে চলা জীবনের মূল্যে ৫০০ টাকা বড়ই যে নগন্য! মাঝে মাঝে প্রচন্ড ইচ্ছে হত তার জন্য কিছু একটা করবার কিন্তু সাহসে কুলাতো না কখনো! কারন দায়বদ্ধতার জায়গা ছিল আমারো অনেক বেশী!
ProChESTA নামক একটি প্রতিষ্ঠানে তার হয়ে একটা আইজিএ সাপোর্টের জন্য আবেদন করে চুপ করে ছিলাম তাদের উত্তরের অপেক্ষায়। অবশেষে প্রতীক্ষার অবসান হল! নববর্ষের ঠিক তিনদিন আগে ProChESTA-র অফিস হতে কর্তা ব্যাক্তিরা ফোন দিয়ে হড়হড় করে যা বলছিলেন আমার তাতে মনযোগ ছিলনা বরং আমি তখন কালু দা'র জন্য একটা সুন্দর দিনের শুরু দেখা শুরু করে দিয়েছিলাম।
ProChESTA-র ইচ্ছেটা ছিল কালু দা'র জন্য তাদের পক্ষ হতে একটা ক্ষুদ্র ব্যাবসা দ্বার করিয়ে দিয়ে তার জীবনমানের উন্নয়ন করা, যেটি কিনা হবে তার জন্য এবারের নববর্ষের সেরা উপহার! অর্থ্যাত নববর্ষের দিনেই তাকে তার দোকানে বসিয়ে দিতে হবে।
কিন্তু হায় নববর্ষ তো বাকী মাত্র দুইদিন।
ProChESTA হতে ১৫ হাজার টাকা পকেটে পুরে বৃহস্পতিবার রাতে দিলাম ছুট দিনাজপুরের উদ্দেশ্যে! সারারাত নির্ঘুম গাড়িতে পরিকল্পনা করলাম কি করে নববর্ষেই আস্ত একটা দোকান কালু দাকে উপহার হিসেবে তুলে দেয়া যায়। অনেক টেনশন হচ্ছিল কারন দোকানের পজিশন, অনেক অনেক কেনাকাটা! কিভাবে সম্ভব! ভরষার একটা জায়গা ছিল, ছোট ভাইটা। সে চাইলে সবই সম্ভব! শুধু তাকে রাজী করানোটাই একটা কাজ।
খুব সকালে বাড়ি পৌছে, কালু ভাইকে ডেকে নিয়ে তার নিকট হতে কয়েক দফা টাকার পরিমানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ন বিজনেস প্ল্যান যখন করে ফেললাম তখন বাদ সাধল রনি, মানে ছোটটা! এহেন মহৎ উদ্দ্যেগে তাকে কিছুতেই সাথী করতে পারছিলাম না। আর তাকে সাথে না পেলে ফ্রি তে একটা দোকানের পজিশন কোনভাবেই সম্ভব নয়।
তবু বুকে সাহস সঞ্চয় করে কালু ভাই'র দোকানের স্থায়ী সম্পদ হিসেবে একটা চৌকি আর একটা কাঠের বক্স বানাতে দিয়ে বাড়িতে ফিরে এসে দিলাম একটা ঘুম! সারাদিন ঘুমালাম!
সন্ধ্যায় এক কাপ চা হাতে নিয়ে বসেছি আর শুনছি ছোটটা কাকে যেন ফোনে ফাপড় দিচ্ছে! ফোনে কথা শেষ করে এসে, আমাকে বলল তোর জায়গা রেডি। কথাটা শুনে কি যে এক ভালোলাগা কাজ করেছিল তা বলে বোঝানোর মত ছিলনা। কারন কালু ভাইকে যেই বাজারে দোকান সমেত বসানোর পরিকল্পনা চলছিল, সেই বাজারে একটা দোকান ঘর ভাড়া নিতে গেলে শুধু এডভান্স হিসেবেই দিতে হয় ২৫-৩০ হাজার টাকা! সাথে দোকান ভাড়া তো রয়েছেই।
পরের দিন তথা শনিবার উপড়ি পাওনা হিসেবে রনির ম্যানেজ করে দেয়া একজন অভিজ্ঞ পান দোকানদার, কালু ভাই আর আমি গেলাম নতুন দোকানের মালামাল কিনতে। এই দোকান সেই দোকান ঘুরে, দাম দড় যাচাই করে পান, সুপারি, জর্দা, চুন, শর্তা, সিগারেট সহ আরো কত্ত কি যে কেনা হল! বাস্তবিক টাকা উপার্জনের চেয়ে অন্যের টাকা খরচ করা বেশী কষ্টের। তবু একটা ভালোলাগা বিরাজ করছিল মনে, এই পৃথিবিতে আগামীকালটা কেউ একজনের জন্য অন্য রকম একটা দিন হবে।
গতদিন তথা পহেলা বৈশাখে দুপুরের পর হতেই, ভরলা গ্রামের বিলের মাঝখানে ফাকা একটা অংশে সাজসাজ রব চলছিল। সাজসাজ রব ছিল কালু ভাই'র বাড়িতেও। ঢাকের বাদ্যে বিলের মাঝখানে মেলা যখন প্রস্তুত হচ্ছিল, তখন কালু ভাইও প্রস্তুত হচ্ছিল তার নতুন দোকান নিয়ে সেই মেলায় হাজির হতে। আজ সে মেলায় দোকান দিবে, মেলা শেষ হলে পরের দিন সে দোকান নিয়ে তার স্থায়ী ঠিকানায় হাজির হবে।
মেলায় দোকান বসানোর পূর্বে সে সহ আরো দু-একজন মানুষ সমেত মোনাজাত ধরল! দোকান শুরুর পূর্বে এটাই হয়তোবা নিয়ম। তাকে আর্থিকভাবে সহায়তা করবার নেপথ্যে যে মানুষগুলো তাদের জন্য এবং তাদের পরিবারের জন্য দোয়া করতে করতে তিনি হু হু করে কেঁদে উঠলেন। একটা সত্যিকারের সুখের কান্না গতদিন আমি দেখেছি। একটা সত্যিকারের নববর্ষের সেরা উপহার আমি দেখেছি। মানুষ কত অল্পতেই তুষ্ট হয়! আর আমরা? আমাদের অতৃপ্তির কোন যেন সীমানা নেই।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই এপ্রিল, ২০১৯ দুপুর ১২:২৯