somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঢাকা, বারো মার্চ।

১২ ই মার্চ, ২০১২ বিকাল ৫:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কবিরের দোকান খোলেনি আজ। এই এলাকার বাসিন্দা হবার পর এমনটি দেখিনি কখনো। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত পাড়ার ছেলেবুড়োদের আড্ডায় জমজমাট থাকে গলির ছোট্ট চায়ের দোকানটি। একটু সামনেই গলিটি মিশেছে রোকেয়া স্মরণিতে। সেখানের মিষ্টির দোকানটির সামনে বেশ কয়েকজন কিশোর-তরুণ আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। চোখে সতর্ক দৃষ্টি। দোকানের শাটার নামানো। মোটরসাইকেলের স্পিড বাড়াই। ফাঁকা রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছি। তালতলা ছাড়িয়ে যাই। বিজয় স্মরণিও ছাড়াই।

গতকাল ঢাকার থমথমে পরিস্থিতি দেখেছি। অনেকটা হরতালের মতোই ছিলো দিনটি। মহাসমাবেশের অনুমতি দেয়া হবে কি হবে না তা নিয়ে দিনভর নাটক। এ নিয়ে রিপোর্টও করেছি। আজ অফিসে আমার কাজ নেই। বাসা থেকে না বের হলেও চলে। কিন্তু রাত থেকেই মনটা উসখুস করছে। ছোট ভাইকে বলে রেখেছি, মোটরসাইকেলটা আমার লাগবে আজ। ঘুম থেকে উঠে গিন্নির রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই বেরিয়ে পড়েছি।

ইতস্তত রিক্সা চলছে। বাস কিংবা সিএনজি অটোরিক্সা একটাও নেই। ব্যক্তি মালিকানার গাড়ি চোখে পড়ছে কদাচিৎ। মাঝে মাঝে তীব্র হুইসেল বাজিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে দু-একটা অ্যাম্বুলেন্স অথবা পুলিশের গাড়ি। রাস্তার দু’পাশে পায়ে চলা মানুষের ঢল। সব একমুখী। আমি যেদিকে যাচ্ছি, সেদিকে। বাংলামটর পার হয়ে মোটরসাইকেলের স্পিড একটু কমাই।
-এই যে ভাই।
ফুটপাত ধরে হেঁটে চলা তরুনদের একটি দলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছি। ঠান্ডা লেগে গলাটা বসে আছে দুদিন ধরে। ফ্যাঁসফেসে আওয়াজ বের হচ্ছে। লোকগুলো শুনতে পেলো কি পেলোনা। এবার গলায় আরেকটু জোর আনার চেষ্টা করি।
-আপনারা কোথায় যাচ্ছেন।
দলের একজন একটু ফিরে চাইলো আমার দিকে। চোখে সন্দেহ। হাঁটা থামায়নি। আমিও ধীরগতিতে তার সাথে তাল মেলাই। তার ভয় দূর করার চেষ্টা করি।
-আপনারা কি মহাসমাবেশে যাচ্ছেন।
চোখে এখনও সন্দেহ। গলাটা বাড়িয়ে হেলমেট পড়া আমাকে দেখার চেষ্টা করে। নজর যায় মোটরসাইকেলের সামনের দিকে। সেখানে ছোট্ট একটা স্টিকার লাগানো। প্রেস। এবার ভয় কাটে তার।
-হ্যাঁ, মহাসমাবেশে যাচ্ছি।
-ছাত্রদল করেন?
-না। যুবদল।
-কোথা থেকে এসেছেন?
-পাংশা। রাজবাড়ী।
-হেঁটে এসেছেন?
-হ্যাঁ।
-পুরোটা?
-না। আদাবর শ্যামলী থেকে।
-পাংশা থেকে কিভাবে এসেছেন?
-তিনচারদিন আগে এসেছি। বাই রোড।
-এ কয়দিন কই ছিলেন? হোটেলে?
-না। আদাবর। বন্ধুদের মেসে ছিলাম।
-আপনারা কয়জন?
-আছি ভাই চব্বিশ পঁচিশজন।
-সবাই বন্ধুদের মেসে ছিলেন?
-হ্যাঁ। জোড়াতালি দিয়ে ছিলাম আরকি।
গুডলাক জানিয়ে এগিয়ে যাই। সামনে রুপসীবাংলা হোটেলের মোড়। কোনপথে যাবো? ভার্সিটি নাকি ভিআইপি রোড? আমার লক্ষ্য অবশ্য নয়াপল্টনে বিএনপি অফিস। তার আগে একটু ইতিউতি ঘোরা। ভিআইপি রোড ধরার সিদ্ধান্ত নেই। মিন্টো রোড ধরে এগিয়ে যাচ্ছি। দুপাশে পায়ে চলা মানুষের স্রোত।

কাল থেকে শুনে আসছি, পথে পথে অবস্থান নেবে আওয়ামীলীগ ও অঙ্গসঙ্গঠনগুলো। মহাসমাবেশে যাওয়া মানুষকে বাধা দেয়া হবে তাদের উদ্দেশ্য। সাড়ে দশটা বাজে। মিরপুর থেকে কাকরাইল মসজিদ পর্যন্ত চলে এসেছি। এখনো তো তেমন কিছু দেখলাম না! কোন দিকে যাবো। আবার দোনোমনা করি। নাহ! নয়াপল্টন একটু পরেই নাহয় যাই। সকালে পেপারে দেখলাম এবার র্যাব পুলিশের পাশাপাশি বিজিবিও নাকি মাঠে থাকবে। তাদের কি অবস্থা একটু দেখে আসি। কাগজে লিখেছে। সচিবালয়ের সামনে তাদের একটা শক্ত অবস্থান থাকবে। সচিবালয়ের রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছি। মূল ফটক ছাড়িয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের ফটকও ছাড়ালাম। কই, বিজিবি নাইতো। ছোপছোপ ড্রেস পরা আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন আছে শুধু। এরা সারাবছরই থাকে। একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে এগিয়ে যাই। সামনে এগিয়ে বামে মোড় নেই। সেখানে সচিবালয়ের পূব পাশে দুটো কালচে জীপগাড়ি দাঁড়ানো। নিশ্বাস আটকে ফেলি। আরেকটু এগোই। আশংকা সত্যি হয়। ত্রিপল ঢাকা দুটো পিকাপ ভ্যান। ড্রাইভার্স ক্যাবের উপরে বালির বস্তা। সেখান থেকে মেশিনগানের নল উঁকি মারছে। পেছনে পুরো যুদ্ধসাজে বিজিবি জওয়ান। দুই গাড়িতে দুই মেশিনগান। পেছনে শক্ত মুখ করে বসে আছে আরো বেশ কিছু সৈনিক। সবার হাতে এলএমজি। মাথায় হেলমেট। গায়ে বুলেটপ্রুফ ভেস্ট। মুখ শক্ত। চোখ সতর্ক। আংগুল বন্দুকের ট্রিগারে। অজান্তে ব্রেকে পা দাবাই। পাশেই একটা গণশৌচাগার। সেখানে মোটরসাইকেলটা পার্ক করে উঁকি মারি। তিনচারজন ফটোসাংবাদিক বিজিবির কমান্ডারকে কি একটা বোঝানোর চেষ্টা করছে। আমার সাথে কোনো ক্যামেরা নেই। না এগোনোর সিদ্ধান্ত নেই। একটু পরেই দেখলাম, সবাই সটান দাঁড়িয়ে গেলো। পরিচিত পজিশনে চলে গেলো ফটোসাংবাদিকেরা। ক্লিক ক্লিক। পকেট থেকে আইফোন বের করলাম। ক্যামেরার অ্যাপস ওপেন করার চেষ্টা করছি। খুলছে না। ছবি তোলা হয় না আর। মোটরসাইকেলে স্টার্ট দিয়ে ফকিরাপুলের দিকে এগোই।

ফকিরাপুলের রাস্তায় ঢুকতেই নতুন দৃশ্যপট। অসংখ্য মানুষ। একদলকে দেখলাম হলুদ টি-শার্ট গায়ে। মাথায় সাদা ক্যাপ। তাতে কি যেনো লেখা। হাতে বাঁশি। এরা স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য। ছোট ছোট মিছিল এগিয়ে যাচ্ছে। এক একটা মিছিলের রং এক এক রকম। কোনো মিছিলের সবার গায়ে লাল টি-শার্ট। কোনোটার সবার মাথায় লাল ক্যাপ। কেউবা সাদা। একটু এগোই। বামে গেলেই নয়াপল্টন। ডানে একটা লম্বা ব্যানার হাতে অনেকগুলো মানুষ দাঁড়িয়ে গেছে মানববন্ধনের কায়দায়। ব্যানারের লেখা দেখে বুঝলাম এরা জামাত। মুখের ভেতরে একটু তেতো লাগে।
সাড়ে এগারোটা বাজে। নয়াপল্টনে পার্টি অফিসের সামনেটা বেশ ভরে গেছে। চারিদিক থেকে মিছিল আসছে। জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো। এখনই যা মানুষ হয়েছে তাতেই একটা ছোটোখাটো মহাসমাবেশ হয়ে যায়। কেউ একজন ভাষণ দিচ্ছেন। মাইকে তার জ্বালাময়ী কন্ঠ শোনা যাচ্ছে। ভীড়ের মধ্যে দিয়েই অনেক মিডিয়ার গাড়ি ছুটোছুটি করছে। আমিও এগোই। পার্টি অফিস ছাড়িয়ে হোটেল রাজমনির দিকে যাচ্ছি। রংবেরংয়ের মিছিল। ব্যানার। ফেস্টুন। একপাশে কয়েকটি ঘোড়ার গাড়ি। খুব করে সাজানো। তারেক রহমানের ছবিঅলা বড় ফেস্টুন তাতে লাগানো। আরেকপাশে একটা ট্রাকে বেশ বড়সড় একটা এলইডি মনিটর। সেখানে দেখতে পেলাম মঞ্চে ভাষণ দেয়া নেতাকে। লাইভ দেখাচ্ছে। চিনতে পারলাম না ঠিক। আরেকটু সামনে একটি নিশান পেট্রোল গাড়ি আসছে ঢিমেতালে। তার দুপাশে অনেক মানুষের হইচই। গাড়িটির ছাদ ফুঁড়ে বেরিয়ে আছে একজন মানুষ। তার হাতে একটি ভিডিও ক্যামেরা। গাড়ির সামনের কাঁচে লাগানো একটি স্টিকার। http://www.bnplive.com লেখা। অনলাইনে লাইভ দেখাবে বোধ হয়। বিরোধী দলও আজকাল বেশ ডিজিটাল হয়ে উঠেছে। কাকরাইল মসজিদের মোড় থেকে বামের রাস্তা ধরি।

মিনিটের মধ্যে চলে যাচ্ছি এখান থেকে সেখানে। আহা! এমন ঢাকা যদি সারাবছর থাকতো। হাইকোর্ট, দোয়েল চত্বর হয়ে টিএসসির সড়কদ্বীপটার পাশে একটু স্লো করি। একটা চায়ের বড় ফ্লাস্ক ঘিরে বসে আছে তিনজন রিকশাওয়ালা। অলস ভঙ্গিতে সেই ফ্লাস্কে ঝুলানো প্যাকেট থেকে চিড়ের মোয়া নিয়ে চিবোচ্ছে। একটু দূরে রিকশাগুলো রাখা।
-কি অবস্থা? আড্ডা দ্যান?
-খ্যাপ পাই না। কি করুম!
-খ্যাপ পান না মানে? আইজকা তো আপনাগোই দিন। সব রাস্তা ওপেন। রিক্সা ছাড়া রাস্তায় কিছু নেই।
-ভাই, মানুষও নেই। অন্যদিন এই সময়ের মইধ্যে তিন-সাড়ে তিনশো ট্যাকার খ্যাপ মারি। আইজক্যা অহন পর্যন্ত জমার ট্যাকাই ওঠে নাই।
জমার টাকা ওঠানোর চিন্তাও যে এদের খুব একটা আছে, তা মনে হলো না। নীলফামারী, নাটোর আর নোয়াখালীর এই তিন অসমবয়েসী সমপেশার বন্ধুর আড্ডায় আর বাগড়া দেই না। শাহবাগ হয়ে এলিফ্যান্ট রোড ধরি। আমার পাশ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে অসংখ্য রিকশা। বেশিরভাগই খালি। কোন কোনটিতে যাত্রী আছে। একটিতে আবার দেখলাম ওভারলোড। চারজন যাত্রী নিয়ে যাচ্ছে।

বাটা সিগন্যালের সামনে মনে হলো যেন কিসের একটা ভিড়। একটা টিভি চ্যানেলের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে সতর্ক ভঙ্গিতে বসে একজন নারী রিপোর্টার আর ক্যামেরাম্যান। কাছাকাছি হতে দেখলাম তরুনদের একটা জটলা। আশপাশের সব থালাবাসনের দোকান বন্ধ। মুন্নু সিরামিকের একটি দোকানের ঝাঁপ আধখোলা। সেই দোকানের সামনেই ভিড়। এদের দুএকজন আবার ট্রাফিক কন্ট্রোল করছে। চাদনীচকের দিক দিয়ে আসা রিকশাগুলোকে সব ঘুরিয়ে দিচ্ছে। একজনের গায়ের টিশার্টে বঙ্গবন্ধুর বড় একটা ছবি। এগিয়ে যাই। সিটি কলেজ পার হয়ে সাতমসজিদ রোডের দিকে। নাহ। এদিকটা শুনশান। রাইফেলস স্কোয়ারের সামনে একটা জায়গায় শুধু কয়েকটা চেয়ার পেতে মুরুব্বী গোছের কজন নেতা বসে আছেন। নির্বিষ। মোটরসাইকেলের নাকটা ঘুরিয়ে নিই।

ইডেন কলেজের গেটটা হাট করে খোলা। একটু স্লো করে ভেতরে উঁকি দিলাম। ক্যাম্পাস দেখা যাচ্ছে। শুনশান। জীবনে প্রথম ইডেন কলেজের ভেতরটা দেখতে পেলাম। উল্টো-পাশের ফুটপাতে দুতিনটি মেয়ে আড্ডা দিচ্ছে বন্ধুদের সাথে। বছর দশ-বারো আগের কথা মনে পড়ে গেলো। ওই সময়ে এই এলাকার একজন হাজী সাহেব সন্ধ্যাবেলায় টর্চ হাতে ইডেন কলেজের সামনের এই ফুটপাত পাহারা দিতেন। অশ্লীলতাবিরোধী অভিযান। ইদানিং রাস্তাঘাটে সেই হাজী সাহেবের অনেক বিজ্ঞাপন-টিজ্ঞাপন চোখে পড়ে। নানা জ্ঞানের কথা লেখা তাতে। বছর খানেক ধরে বিভিন্ন পরবে-উৎসবে এসএমএসও পাচ্ছি তার। নিজের এবং স্ত্রীর নাম দিয়ে শুভেচ্ছাবাণী পাঠান। জীবনে সামনাসামনি দেখিনি তাকে। মোবাইল নাম্বার কোথায় পেয়েছে খোদা মালুম। হঠাৎ হাজী সাহেবকে সামনাসামনি দেখার ইচ্ছেটা প্রবল হলো। ঢাকার পুরোনো অংশে নিশ্চয়ই তার সরব উপস্থিতি থাকবে আজ।

ঢাকেশ্বরি রোড ধরে এগিয়ে চলছি। নাহ! তেমন কিছু চোখে পড়ছে না। শুধু র্যাবের একটা গাড়িবহর পাশ কাটালো সাই সাই করে। বহর মানে গোটাতিনেক পিকআপ, দুটো মাইক্রোবাস, আর দুটো মোটরসাইকেল। সবগুলোই কালো পোশাকধারীতে পূর্ণ। উর্দূ রোড হয়ে লালবাগের দিকে এগোচ্ছি। দোকানপাট সব বন্ধ। জেলখানার পেছন দিকটায় পাইকারি শার্টের একটা বড় বাজার। বেশীরভাগ দোকানেরই শাটার নামানো। দুএকটা অর্ধেক খোলা। ফ্যাশন শার্টস নামে দোকানটার সামনে দাঁড়ালাম। কলাপসিবল গেটের অর্ধেকটা খোলা। ভেতরে মাঝবয়েসী মালিক বসা।
-আজকে কি এই এলাকার মার্কেট বন্ধ?
-না। কাস্টমার নাই তাই সবাই বন্ধ করে চলে গেছে। সকালের দিকে খুলছিলো।
-আপনি যান নাই?
-যাবো। ঘন্টাখানেক পরই বন্ধ করে চলে যাবো। এই সময়ে বাসায় থাকার অভ্যেস নাইতো...
বাকি কথা শোনা হয়না আর। পাশ দিয়ে জোরে হর্ণ বাজিয়ে ছুটে যাওয়া একটি মাইক্রোবাস দৃষ্টি কেড়ে নেয়। গাড়িটির দুপাশে আর পেছনে পোস্টার সাঁটা। পরিচিত সেই হাজী সাহেবের ছবি। নিচে লেখা: ‘একবার বিশ্বাস হারালে আর তা অর্জন করা যায়না। আমি বিশ্বাস রাখতে চাই’। মনে আশার সঞ্চার হলো। জোরে মোটরসাইকেল চালিয়ে গাড়িটিকে অতিক্রম করি। হতাশ হলাম। নাহ। ভেতরে তিনি নেই।

চানখারপুল হয়ে কোন দিকে যাবো ভাবতে ভাবতে আবার টিএসসি হয়ে শাহবাগের দিকে এগোই। অনেকখন একটানা মোটরসাইকেল চালাচ্ছি। হেলমেটের চাপে আমার স্বল্পকেশমস্তক বেশ ঘেমে উঠেছে। হেলমেটটা খুলে পাশে ঝুলাই। চারুকলার কাছাকাছি আসতে শ্লোগানের শব্দ। জয় বাংলা। দ্রুত এগোই। ছাত্রলীগের একটি মিছিল। মোল্লার রেস্টোরেন্টের পাশ দিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢুকছে। মিছিলের লেজটা দেখতে পেলাম। হাঁটার বদলে দৌড়াচ্ছে মনে হলো। রাস্তার পাশে কয়েকটা টিভি চ্যানেলের গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়লো হঠাৎ। গাড়ি থেকে বেরিয়ে টিভি ক্রুরাও ছুট লাগিয়েছে পেছনে। আমার মোটরসাইকেল নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢোকা যাবে না। এই উদ্যানের ভেতর দিয়ে এই রাস্তাটি কোথায় গিয়ে মিশেছে জানা আছে। এগিয়ে চলি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের দিকে। শিশুপার্ক পেরোতেই একটি শব্দ এলো কানে। গুলির শব্দ নয়তো! ভুল শুনে থাকবো হয়তো। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের সামনে গিয়ে ব্রেক করি। বিপুল হট্টগোল। ছাত্রলীগের কয়েকশো ছেলেপেলে। সবার হাতে লাঠিসোটা। কাউকে ধাওয়া করছে। পাশে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে দাঙ্গা পুলিশ। তামাশা দেখছে। রাস্তায় কিছু ভাঙ্গা আধলা পড়ে আছে। আইল্যান্ডে বেশ কয়েকজন টিভি ক্যামেরাম্যান আর মাইক্রোফোন হাতে রিপোর্টার। উত্তেজিত। অজান্তেই হেলমেটটা উঠে এলো আমার মাথায়।
ক্যামেরাক্রুদের ভিড়ে লম্বা একটা মাথা। সবার উত্তেজনার মধ্যে নির্বিকার দাঁড়িয়ে। এনটিভির সুকি ভাই। পরিচিত বন্ধু। এগিয়ে গিয়ে পিঠে খোঁচা দিলাম।
-কি হইছে এইখানে?
-আর কইয়ো না, ছাত্রদলের পোলাপাইন জমায়েত হইছিলো। ছাত্রলীগ আইসা দৌড়ানি দিছে। মারমারিডা লাগবো লাগবো করতাছিলো, কিন্তু নতুন এই ক্যামেরাম্যানগুলা এমন অস্থির হইয়া উঠছে, আর লাগলো না মারামারিডা। আরে ভাই আগে গ্যাঞ্জাম লাগুক, তারপর না ক্যামেরা রোল দিবি। তা না, হুদাই অস্থির। এইখানে মনে হয় আর কিছু অইবো না।
চিরাচরিত দৃশ্য। ছাত্রদল বনাম ছাত্রলীগ। আমি আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। অবশ্য এটাও একটা মজার দৃশ্য। শত শত ছেলে, হাতে বাঁশ, রড, মোটা পাইপ, ক্রিকেটের উইকেট, কাঠের চ্যালা ইত্যাদি। একটা ক্যামেরার অভাব খুব বোধ করছি। আইফোনের ক্যামেরাটাও কাজ করছে না। ধ্যাৎ!
-এলিফ্যান্ট রোডে নাকি মারামরি চলতাছে।
সুকি’র মন্তব্যে হুঁশ ফেরে।
-কই! আমিতো একটু আগে গেছিলাম। তেমন কিছুতো দ্যাখলাম না। অবশ্য ছাত্রলীগের পোলাপাইন দ্যাখছি অনেক।
-চলো যাইয়া দেখি। তোমার মোটরসাইকেলে বইসা কয়ডা ট্র্যাক শটও মারন যাইবো।
গরিলা সুকিকে পেছনে নিয়ে অ্যালিফ্যান্ট রোডে ছুট লাগাই। বাটা সিগন্যালে গিয়ে দেখি তুলকালাম। রাস্তার মাঝখানে আগুন জ্বলছে। শয়ে শয়ে লাঠি সোঁটাধারী ছেলেপেলে এদিক সেদিক কাদের যেনো ধাওয়াচ্ছে। পথচারী সব। এদের মধ্যেই হয়তো আছে অদৃশ্য কালপ্রিট। সুকি লাফ দিয়ে নেমে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমি পুলিশের পেছেন নিরাপদ আশ্রয়ে গিয়ে দাঁড়াই তামাশা দেখার জন্য। ব্যাপক ধাওয়াধাওয়ি চলছে। শত্রুপক্ষ অবশ্য সংঘবদ্ধ নয় বলে মনে হলো। লাঠিসোঁটাও নেই তাদের হাতে। দু-একটা দোকান যা খোলা আছে তাতে ধাওয়া খেয়ে ঢুকে পড়ছে পথচারীরা (অথবা বিএনপি কর্মী, ঠিক জানি না)। সাথে সাথে শাটার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দোকানের। শাটারের ওপরেই পড়ছে দমাদম। জুতোর দোকানগুলোর সামনে একটি ইলেকট্রিক পোলে একটা ফেস্টুন ঝোলানো ছিলো। তাতে খালেদা জিয়ার ছবি আর মহাসমাবেশে আসার আহ্বান জানিয়ে বিজ্ঞাপন। কয়েকজন দেখলাম মহা আক্রোশে ওঠার উপরেই লাঠির বাড়ি মারছে। একটু ওপরে তাকাই। আশপাশের বাড়িগুলোর জানালাগুলোতে দেখা যাচ্ছে অসংখ্য মুখ। ভয়ার্ত দৃষ্টি। সুকি ভাই চলে আসে।
-এই মারামারি মনে হয় অনেক্ষণ চলবে। ভালো ছবি পাইছি। আমার ব্যাকআপ চলে আসছে। আমাকে একটু আগের জায়গায় নামিয়ে দাও।

সুকি ভাইকে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে নামিয়ে দিলাম। সেখানে তখনো থমথমে। ছাত্রলীগের সতর্ক উপস্থিতি। কারো হাতে, কারোবা পিঠে গোঁজা লাঠি। মৎস ভবনের দিকে এগোই। এই মোড়ে এসে দেখলাম আজকের দিনের সবচেয়ে অভূতপূর্ব দৃশ্য। একটা জ্যাম লেগেছে এখানে। সহজে ছুটবে বলে মনে হচ্ছে না। মারামারি লাগলো নাকি! আমি মোটরসাইকেল ঘুরিয়ে নেবার উপক্রম করি। একটা সিএনজি থেকে একজন লোক বেরিয়ে এলো। হাতে ফাইলপত্র। ব্যাসায়ী হবে হয়তো। একটু তাড়াহুড়োয় আছে মনে হয়। আমাকে জিজ্ঞেস করলো: ভাই মতিঝিল যাবেন নাকি? আমাকে একটু নামিয়ে দেবেন? আমি লজ্জিত ভঙ্গিতে না বললাম। আমাকে এখন নয়াপল্টন যেতে হবে।
রং সাইড দিয়ে মৎসভবন মোড়ের দিকে এগোলাম। সেখানে অনেক পুলিশ। বড়কর্তারাও আছেন। কে জানি একজন পাশ থেকে বললো, ওদিকে যাইয়েন না, পিএম যাইবো অখখোনি। জ্যাম লাগার কারন বুঝলাম। আজকে সোমবার। এইদিনে প্রধানমন্ত্রী সচিবালয়ে ক্যাবিনেট মিটিং করেন। আজকেও ছিলো। মিটিংয়ে কি আলাপ হলো? এজেন্ডার বাইরে আজকের কিংবা গতকালের ঢাকার পরিস্থিতি নিয়ে কি কোনো আলাপ হয়েছে? জানতে ইচ্ছে হচ্ছিলো খুব। আমার পাশ দিয়েই একটি পালসার মোটরসাইকেল বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে পুলিশের খপ্পরে পড়েছে। পুলিশের এক অফিসার টান মেরে চাবি নিয়ে নিয়েছে। এনিয়ে পালসারের দুই যাত্রীর সাথে পুলিশের গ্যাঞ্জাম লেগে গেছে।
-ওই মিয়া আপনে চাবি নেলেন ক্যান?
-আপনারে না কইলাম পিএম যাইবো, তারপরও আপনি যাওয়ার চেষ্ট করলেন ক্যান?
-পিএম যাইবো সেইডা কইলেই হয়। আমরা কি ছাত্রদল নাকি যে আমাগো চাবি টাইনা লইবেন!
বিরাট গ্যাঞ্জাম। এক পর্যায়ে পুলিশের বড়কর্তা চাবি দিয়ে দেয়। পালসার স্টার্ট নিয়ে বিকট গর্জন তুলে সেখান থেকে একটু দূরে সরে দাঁড়ায়। ততক্ষণে প্রধানমন্ত্রীর গাড়ি মোড় পেরিয়ে গেছে। বহরের লেজের দিকের গাড়িগুলো যাচ্ছে। বহর শেষ হলে আমি আবার আগের রুট ধরি। পোনে একটা বাজে। আমি এগিয়ে যাচ্ছি-প্রেসক্লাব, দৈনিকবাংলা...না, আর এগোনো যাবে না। এখনো মিছিল যাচ্ছে ফকিরাপুলের দিকে। এরই মধ্যে তিল ধারনের জায়গা নেই। টুপি-দাড়ির সংখ্যা অনেক বেড়েছে। নারয়ে তাকবীর...একটু তেতো ঠেকে মুখের ভেতরটা। একটা মিছিল অতিক্রম করলো আমাকে। জ্বালো জ্বালো....ব্যানারটার দিকে তাকালাম। যে দলের মিছিল সে দলের নাম জাগপা। এরাতো চারদলীয় জোটের শরীক না। তাহলে মনে হয়, নতুন যে জোট ঘোষণা হতে যাচ্ছে আজ সেই জোটে যোগ দেবে এরা।

ফেসবুকে বন্ধু এবং ক্রীড়া সাংবাদিক দেবব্রত মুখোপাধ্যয়ের একটি স্ট্যাটাসের কথা মনে পড়ে গেলো। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাইনাল নিয়ে। ‘....ফাইনালের ব্যাপারটা তো সাদা চোখেই বোঝা গিয়েছিল। শ্রীলঙ্কার আচরণ দেখে মনে হচ্ছিল, ভারতকে কাপ জেতাতে জান দিয়ে দেবে তারা। স্কোয়াডের বাইরে থেকে তিন খেলোয়ার মাঠে নামিয়ে দিল; টুর্নামেন্টে ভালো করাদের বসিয়ে। দুইবার টস করে জেতানো হলো ধোনিকে..’। মোটরসাইকেলের নাক ঘোরাই।

কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ ছাড়িয়ে বিজয় স্মরণি হয়ে রোকেয়া স্মরণির দিকে যাচ্ছি। দুধারে পায়ে চলা মানুষের উল্টো স্রোত রয়েছে এখনো। স্রোতটা অবশ্য আগের চেয়ে একটু পাতলা হয়ে এসেছে।

গলির মুখের মিষ্টির দোকানের সামনে ছেলেগুলো আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে এখনো। কবিরের দোকান খোলেনি। আজ মনে হয় আর খুলবে না।

পাদটীকা: ভেবেছিলাম বাকি অংশ বাসায় ফিরে টিভিতে দেখবো। কাগজে অবশ্য পড়েছি টিভিগুলোকে অলিখিত নির্দেশ দেয়া হয়েছে সরাসরি সম্প্রচার না করতে। তারপরেও শুনেছি, দুএকটা টিভি হয়তো দেখাবে। অনেকক্ষণ ধরে বাসার কেবল লাইনে কোনো চ্যানেল দেখতে পাচ্ছি না। আজ মনে হয় আর টিভি দেখা যাবে না। কি আর করা! নেই কাজ তো খই ভাজ!
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×