মুক্তিযুদ্ধে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি অনিয়মিত বাহিনীও যুদ্ধ করে। টাঙ্গাইলের কাদেরিয়া বাহিনী, দক্ষিণবঙ্গের হেমায়েত বাহিনীর কথা কম-বেশী সবাই জানে।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নিজস্ব উদ্যোগে দেশের ভিতরে যে কটি অনিয়মিত বাহিনী গড়ে উঠে তার মধ্যে ময়মনসিংহের আফসার বাহিনী অন্যতম।
সময়ের পরিক্রমায় ‘আফসার বাহিনী’ মোটামুটি দৃষ্টিসীমার অগোচরেই চলে গেছে।
ময়মনসিংহের দক্ষিণ অংশে প্রতিষ্ঠিত হয় অনিয়মিত আফসার বাহিনী। দক্ষিণ ময়মনসিংহের ভালুকা, ত্রিশাল, ফুলবাড়ীয়া, গফরগাঁও; টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতী, ঘাটাইল ও সখিপুর বর্তমান গাজীপুর জেলার শ্রীপুর ও কালিয়াকৈর থানা এলাকা ছিল আফসার বাহিনী যুদ্ধ এলাকা।
তৎকালীন ভালুকা থানার আফসার উদ্দিন আহমেদ ভালুকা থানার রাজৈ ইউনিয়নের আব্দুল হামিদ মেম্বারের একটি রাইফেল সংগ্রহ করে ৮ জন সদস্য নিয়ে ২৩শে এপ্রিল/৭১ইং তারিখ অত্র থানার নিবৃত পল্লী মল্লিকবাড়ী বাজারে গঠন করেন মুক্তিবাহিনী।
আফসার বাহিনী একাধিকবার ভালুকা থানায় অভিযান চালিয়ে পুলিশের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করে।
এছাড়া ও বিভিন্ন স্থান হতে তৎকালীন বাঙালি ইপিআর আনসারদের ফেলে যাওয়া অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করে আফসার বাহিনী। সদস্য সংগ্রহ করে আফসার উদ্দিন আহমেদ বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে। এক পর্যায়ে আফসার বাহিনীর সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় সারে চার হাজার। বৃটিশ ভারত সেনা বাহিনীর (অব.) সুবেদার মেজর আফসার উদ্দিন আহমেদ তাঁর বাহিনীকে সামরিক বাহিনীর নীতিমালা অনুযায়ী ৫ টি ব্যাটালিয়ানে ভাগ করে নির্দিষ্ট পরিমাণে সৈনিক নিয়োগ করেন।
স্বহস্তে প্রতিষ্ঠিত আফসার বাহিনীর প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে শেষ পর্যন্ত আফসার উদ্দিন আহমেদ বীরত্বের সাথে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি শপথ করে বলেছিলেন আমার মৃত্যু হলে যেন স্বাধীন বাংলার মাটিতেই হয়, দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত এই অস্ত্র ত্যাগ করবো না এবং কারো সাথে কোন প্রকার আপোষ করবো না।
আফসার বাহিনীর উল্লেখ যোগ্য যুদ্ধ ছিল ভালুকা থানাধীন ভাওয়ালিয়াবাজু যুদ্ধ। ২৫ জুন ১৯৭১। পাকবাহিনী সড়ক পথে গফর থেকে ভালুকা আসার পথে আফসার বাহিনী বাধা দিলে ভাওয়ালিয়াবাজু নামক স্থানে যুদ্ধ বাধে। এক টানা ৪৮ ঘন্টা যুদ্ধ চলারপর পাক বাহিনীর অবস্থানে দুটি হেলিকাপ্টার থেকে মুক্তি বাহিনীর অবস্থানে পিছনে (ধলিয়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে) ছত্রিসেনা অবতরণ করায়। এই যুদ্ধে ৯৫জন পাক সেনা নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হয়।
আফসার বাহিনীর এই একটানা ৪৮ ঘন্টার যুদ্ধের খবর তৎকালিন স্বাধীন বাংলা বেতার, বিবিসি ও আকাশবানী থেকে ফলাও করে প্রচার করা হয়। ঢাকা বেতার অবশ্য এই যুদ্ধের খবর পাক বাহিনীর পক্ষে প্রচার করে ছিল। এই যুদ্ধে অধিনায়ক আফসার উদ্দিন আহম্মেদ নিজে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এছাড়াও টাঙ্গাইলের বল্লায় এক টানা ৩ ঘন্টা যুদ্ধ ও গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর উপজেলার ফুল বাড়িয়া বাজারে পাক বাহিনীর সাথে একটানা ১৮ ঘন্টা যুদ্ধ সহ এই অঞ্চলে প্রায় দেড় শতাধিক সফল যুদ্ধ পরিচালা করে শত শত পাক ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যদেরকে নিহত ও আত্মসমর্পনে বাধ্য করেন।
এসব যুদ্ধে আফসার বাহিনীর ৪০ জনের বেশী সাহসী মুক্তি সেনা শহীদ হন। শহীদদের মাঝে অধিনায়ক আফসার উদ্দিন আহম্মেদের ৩য় পুত্র ৭ম শ্রেণীর ছাত্র নাজিম উদ্দিনও রয়েছে। আফসার বাহিনী ঘোষিত মুক্ত এলাকা ভালুকা , ত্রিশাল, ফুলবাড়িয়া, গফরগাও , কালিয়াকৈর, শ্রীপুর, কালিহাতি ও সখিপুর থানা এলাকার যেখানে পাকা ও রাজাকার বাহিনী প্রবেশ করেছে সেখানে মুক্তি সেনারা বাধা দিয়েছে।
আফসার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা অধিনায়ক আফসার উদ্দিন আহম্মেদ ১৭ সেপ্টম্বর ১৯৭১ ভারতের আগরতলায় হাপানিয়া ক্যাম্পে গিয়ে মেজর শফিউল্লাহর সাথে দেখা করে তার বাহিনীর কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত করে এবং উনার মাধ্যমে ১১ নং সেক্টরে প্রধান মিত্র বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার সানসিং বাবজির সাথে কথা বলেন ও সার্বিক সাহায্য সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে তাঁর ভূয়সী প্রসংশা করেন। এর পর মেজর আফসার তার বাহিনীর ৫৬৫জন মুক্তিসেনা ঢালু ক্যাম্পে পর্যায়ক্রমে প্রশিক্ষনের জন্য প্রেরণ করেন।
যুদ্ধ চলাকালিন সময়ে মেজর আফসাররের নেতৃত্বে এস এ কালামের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক জাগ্রত বাংলা পত্রিকা। বিভিন্ন যুদ্ধের সফলতার খবরাখবর প্রকাশ করে এই পত্রিকা মুক্তিকামী মানুষের কাছে বিতরণ করা হতো। এমনকি কৌশলে এই পত্রিকা পৌছে দেয়া হত পাকবাহিনীর ক্যাম্পে।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সকাল ১১:৩২