১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও বৈকালিক ভ্রমণে বের হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব। তবে মনটা কেমন যেন ভালো লাগছিল না সেদিন। দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতায় নিজের অসমাপ্ত কাজগুলোর কথা মনে পড়ছিল বারবার। ইয়াহিয়া-ভুট্টো চক্রের গোপন দুরভিসন্ধির শঙ্কাটাই প্রবল হয়ে উঠছিল। এসব ভাবতে ভাবতে অসুস্থ বোধ করেন তিনি, বাড়ি ফিরে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েন বিছানায়।
তার কয়েক ঘন্টা পরেই শুরু হয় ভয়াল সেই রাত। আধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তত্কা লীন পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র, ঘুমন্ত মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সারারাত ধরেই গোলাগুলি চলে পুরো ঢাকা শহরজুড়ে, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। জগন্নাথ হলে গুলিবর্ষণের প্রচণ্ড শব্দ, আর ভীত-অসহায় মানুষের আর্তচিত্কারে ঘুম থেকে জেগে ওঠেন ড. দেব। অস্থিরভাবে পায়চারি করেন; মেয়ে রোকেয়া সুলতানাকে আশ্বস্ত করে বলেন, 'আমি তো কোনো অন্যায় করিনি, আমাকে ওরা কিছু করবে না।' ভোর হওয়ার অপেক্ষায় বাবার পাশে রোকেয়া সুলতানা ও ছোট্ট শিশুকন্যাকে কোলে নিয়ে তাঁর স্বামী মোহাম্মদ আলী দাঁড়িয়ে থাকেন ।
ভোরের আলো তখনো বের হয়নি। কাছের কোনো মসজিদ থেকে ভেসে এল ফজরের আজান। বাবাকে চা করে খাওয়ালেন রোকেয়া সুলতানা। জগন্নাথ হলের সামনে তখন গিজগিজ করছে পাক-সেনারা, হলের মাঠে জড়ো করা হয়েছে আহত-নিহতদের অসংখ্য দেহ।
রোকেয়া সুলতানা শিউরে উঠে বাবাকে জানালেন সেসব কথা, কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তারপর শান্তস্বরে ড. দেব বললেন, 'প্রার্থনার জায়গা করে দাও।' কথা শেষ না হতেই দরজায় বুটের লাথি পড়ল। অশ্লীল ভাষায় গালাগাল শুরু করে বর্বর পশুর দল - 'মালাউন কা বাচ্চা দরজা খোল।'
কোলের শিশুকন্যাকে তার মায়ের কাছে দিয়ে দরজা খুলতে যান মোহাম্মদ আলী। মুহূর্তে এক ঝাঁক গুলির শব্দ আর একটি আর্তচিত্কাির শোনা গেল, মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন মোহাম্মদ আলী। পাক সৈন্যরা এগিয়ে এলে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ড. দেব বলেন, 'কী চাও বাবারা?' উত্তরে জল্লাদের দল স্টেনগান দিয়ে ড. দেবের মাথা ও বুক বরাবর গুলি করে
ড. দেবের রক্তাক্ত নিথর দেহ পড়ে রইল মেঝেতে, রোকেয়া সুলতানা শিশুকন্যাকে কোলে নিয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন । চলে যাবার মিনিট কুড়ি পরে পাকবাহিনী আবার ফিরে এসে ড. দেবের মৃতদেহ টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় জগন্নাথ হলের মাঠে।
এভাবেই ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের ভোর রাতে বর্বর পাক সেনাবাহিনীর হাতে শহীদ হন খ্যাতিমান ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত দার্শনিক অধ্যাপক ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব। এই মনীষী দর্শনকে ভালোবেসেছিলেন মনেপ্রাণে, যার সাধনায় তিনি ব্রতী ছিলেন সারাজীবন।
তিনি বলেছিলেন, 'Philosophy is my first love, philosophy is my second love and philosophy is my last love.'
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:৫৩