somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এক অনাবাসী বাঙ্গালী প্রকৌশলী এবং দুই ভীনদেশির অসীম বীরত্বগাঁথা

১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



1971 সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় তড়িৎপ্রকোশলী রেজাউল হাসান আমাদের গর্ব হয়ে গবেষণা করছিলেন সুদূর আমেরিকার এমআইটিতে (ম্যাসাচুসেটস ইনিস্টিটিউটস অফ টেকনোলজি) কিন্তু দূরে থাকলে কী দেশের প্রতি টান তার বিন্দুমাত্র কমে? পাকিস্তান বাহিনী যখন 25শে মার্চের কালরাত্রিতে ঝাঁপিয়ে পরে নিরস্ত্র বাঙ্গালীদের উপর তখন থেকেই তিনি উৎসুক হয়ে পড়েন দেশের জন্য কিছু করবার সময়। সাথে মাহবুবুল আলম,তৈয়বুদ্দীন মাহতাব এবং খোরশেদ আলমকে নিয়ে পরিকল্পনা করতে থাকেন আমাদের মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করবার। কিন্তু সুদূর আমেরিকায় বসে কীভাবে সম্ভব দেশ মাতৃকার তরে জীবন বিলিয়ে দেওয়া বীর যোদ্ধাদের সহায়তা করা?

এক সময় পেয়ে গেলেন এই প্রশ্নের উত্তর। নিজের প্রকৌশলবিদ্যাকেই তিনি কাজে লাগাতে চান দেশের স্বার্থে। পর্যাপ্ত কমিউনিকেশন ডিভাইস অর্থাৎ মুক্তিবাহিনীর আভ্যন্তরীণ যোগাযোগের জন্য ওয়াকিটকি এবং ওয়ারল্যাসের অভাবে সম্মুখযুদ্ধে খুব একটা সুবিধে করতে পারছিলনা আমাদের যোদ্ধারা। রেজাউল হাসান সিদ্ধান্ত নিলেন আমাদের যোদ্ধাদের এই অভাব পূরণের। আমেরিকায় নিজ ল্যাবে বসে ওয়াকিটকি,ওয়ারলেস বানিয়ে বাংলাদেশে পাঠাবার দুঃসাহসিক এক পরিকল্পনা করলেন তিনি।

আমেরিকান সরকার পাকিস্তানকে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করছিলো এবং আমেরিকার নিয়মানুযায়ী কোনো যুদ্ধ বিধ্বস্ত এলাকায় সরকারের সহায়তা ব্যতীত ত্রাণ বিতরণ নিষিদ্ধ। তাই ধরা পরলে রেজাউলকে হয়তো ভিসা বাতিল করে পাকিস্তানেই ফেরত পাঠানো হতো এবং এদেশে আসা মাত্র পাকিস্তানী সামরিক জান্তার নির্যাতনের খড়গ নেমে আসতো তার উপর।

কিন্তু না, এসব কিছুই থামাতে পারেনি দেশপ্রেমিক রেজাউলকে। নিজে এবং আরো কয়েকজন বাঙ্গালীর সহায়তায় তিনি প্রায় তিরাশি হাজার ডলার সংগ্রহ করেন এবং তা দিয়ে দিনরাত পরিশ্রম করে তৈরি করেন 10 টি HF Communication সেট যা দিয়ে দশ হাজার মাইল দূরে পর্যন্ত কথা বলা যেত,50 টি VHF ওয়ারলেস সেট যা দিয়ে পাঁচ মাইলের মধ্যে যোগাযোগ করা যেত এবং 45 টি ওয়াকিটকি যা দিয়ে দুই মাইলের মধ্যে যোগাযোগ করা যেত। সব মিলিয়ে 105 টি অত্যাধুনিক কমিউনিকেশন ডিভাইস যা যুদ্ধক্ষেত্র আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ছিল অত্যাবশ্যকীয়।

শুধু তৈরি করলেই তো হবে না, যুদ্ধক্ষেত্রে প্রেরণের পূর্বে প্রয়োজন এই ডিভাইসগুলোর কার্যকারিতা পরীক্ষা। এগিয়ে আসেন তার এক মার্কিনী বন্ধু,যার ফ্যাক্টরিতে বসে এগুলোকে পরীক্ষা করা হয়। সব যন্ত্র তৈরি এবং পরীক্ষার পর এবার আসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, মার্কিন গোয়েন্দাদের চোখ এড়িয়ে কীভাবে পাঠানো যায় এই যন্ত্রগুলো বাংলাদেশে।

এগিয়ে আসেন রেজাউল হাসানের আরেক পরিচিত নিউ হ্যাম্পশায়ারের কনকর্ডে ফ্রাঙ্কলিন পিয়ার্স সেন্টারের অধ্যক্ষ ড. রবার্ট রাইস। তার প্রতিষ্ঠান থেকে ত্রাণ পাঠানোর নাম করে তিনি ব্যবস্থা করতে পারবেন এই যন্ত্রগুলো পাঠাবার। এদিকে নিজ দেশের আইনের তোয়াক্কা না করে মানবতাবাদী মার্কিন বিমান বাহিনীর এক অবসরপ্রাপ্ত অফিসার কার্ল মাইলস আমেরিকার ফ্লেচার স্কুলে এমএ তে অধ্যয়নরত বাঙ্গালী তৈয়বউদ্দীনকে শিখিয়ে দেন এই যন্ত্রগুলোর ব্যবহার।

যথারীতি মার্কিন কর্তৃপক্ষের নজর এড়িয়ে তৈয়বউদ্দীন ডক্টর রাইসের সহযোগিতায় এই যন্ত্রগুলো নিয়ে রওনা হন বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে এবং নির্বিঘ্নে বাংলাদেশ পৌঁছে জিনিসগুলো তিনি তুলে দেন জেনারেল ওসমানীর হাতে এবং মুক্তিবাহিনীদের শিখিয়ে দেন যন্ত্রগুলোর ব্যবহারবিধি।

এতগুলো কমিউনিকেশন সেট পেয়ে ওসমানী এত খুশী হয়েছিলেন যে তিনি রেজাউল হাসানকে একটি চিঠি লিখেন আনন্দ এবং ধন্যবাদ প্রকাশ করে। সেই সাথে উল্লেখ করেন তিনি রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনীর সাফল্যের কথা। একইসাথে রেজাউল হাসানের নিকট প্রেরণ করেন প্রয়োজনীয় জিনিসের আরো একটি তালিকা, যেগুলোও পাঠাবার ব্যবস্থা করেছিলেন রেজাউল হাসান।

যুদ্ধক্ষেত্রে রেজাউলের এই কমিউনেকশন সেটগুলো বাঁচিয়ে দিয়েছিলো বহু মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণ, এবং সেই সাথে তার এই সেটগুলোর কারণে রচিত হয়েছিল বহু বিজয়ের বীরত্ব গাঁথা। শুধু তাই নয়, দেশ স্বাধীন হবার পরেও প্রত্যন্ত এলাকায় প্রশাসনিক যোগাযোগের জন্য এই সেটগুলোর ব্যবহার হয়। শ্রদ্ধা এই বাঙ্গালী প্রকৌশলীর প্রতি যিনি প্রমাণ করেছেন দেশপ্রেমই যথেষ্ট দেশের প্রতি কাজ করবার জন্য। দেশমাতৃকার টানে উদ্ধ্বুদ্ধ হয়ে যে যার অবস্থান থেকে সম্মিলিতভাবে কাজ করে গেলে সাফল্য সুনিশ্চিত।

সর্বশেষ এডিট : ১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:০৯
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

সম্পর্ক

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪২


আমারা সম্পর্কে বাঁচি সম্পর্কে জড়িয়ে জীবন কে সুখ বা দুঃখে বিলীন করি । সম্পর্ক আছে বলে জীবনে এত গল্প সৃষ্টি হয় । কিন্তু
কিছু সম্পর্কে আপনি থাকতে চাইলেও থাকতে পারবেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×