somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

আহমাদ মাগফুর
আমি আহমাদ মাগফুর। ৯৪ এ ময়মনসিংহে আমার জন্ম। স্কুল, কওমি আর আলিয়া -- সবার অবদান প্রাপ্ত হয়ে আপাতত আমি ‘মূর্খ কবি’ হিসেবে জীবনযাপন করছি। তাই আমার অনেক কিছু জানতে ইচ্ছে করে। জানতে ইচ্ছে করে, মানুষ কেন খুন করে! জানতে ইচ্ছে করে, মানুষ কেন ভালবাসে!

এক টুকরো আকাশের গল্প

০৫ ই জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ১০:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আশিক আমাকে আমাকে ‘তুই’ করে ডাকে।আমিও আশিককে বলি ‘তুই’।এই এতোবড় শহরে আমার, তুইতোকারির সম্পর্ক্ কেবল আশিকের সাথেই রয়ে গেছে।এই সম্পর্কের বয়স এখন পনেরো।আজ থেকে পনেরো বছর আগে, আমি আর আশিক একসাথে পড়তাম।সে অনেক পুরনো কথা।তিনটাকা ভাড়া দিয়ে তখন বুক ফুলিয়ে মুগদা থেকে রামপুরা আসা যেতো।এক টাকায় পুরি,আর দু’টাকায় বড় মাপের সিঙ্গারা সমুচা খাওয়া যেতো।দু’টাকা করে দুটো পরটা আর দু’টাকার ডালভাজি খেলে তো পেটে আর জায়গাই থাকতো না।

আশিকের মত আরো অনেক তুইতোকারির মানুষই আমার ছিলো তখন।আপাতত কেউই তারা নেই।তাদের কেউ বা এই শহরে নেই।কেউ বা বাংলাদেশে নেই। আর কেউ তো দুনিয়া ছেড়েই চলে গেছে বহুদূর।দুয়েকজন যাও বা আছে, তারা একবার ‘আপনি’ বলে আরেকবার বলে ‘তুমি’। আর মুখ ফস্কে কখনো বা বলে ফেলে তুই।আর কেউ তো সম্বোধন করতে গিয়ে রীতিমত অসুবিধেয় পড়ে যায়।ঠিক কী বলে সম্বোধন করবে ভেবেই পায় না।ঠিক এখানে এসে, একেবারে নিঃসংকোচে আমি তুই বলি এবং আমাকে তুই বলার মানুষ, কেবলই আশিক।

পরবর্তী সময়ে আমার সাথে আর কারো সম্পর্ক্ই যে গাঢ়ো হয়ে উঠেনি, ব্যাপারটা এমন নয়।এর পরেও আরো অনেকের সাথেই আমার সম্পর্ক্ হয়েছে।সেখানে ছেলে যেমন ছিলো,মেয়েও ছিলো।ছোট ছিলো, বড়ও ছিলো।ছিলো সমবয়সীও।এমন কি সেইসব সম্পর্কের ভেতর আমি, সম্পর্কের গভীর থেকে গভীরতাও অনুভব করেছি।তবে মজার ব্যাপার হলো এইসব ক্ষেত্রে সম্পর্ক্ যে মাত্রাই পাক না কেন, সম্বোধন কিন্তু তুমি আর আপনিতেই ছিলো।এক কথায় তুইতোকারির মানুষটা শেষ পর্য্ন্ত আমার আশিকই রয়ে গেলো।

আশিকের সাথে আমার সাধারন সম্পর্ক্ থেকে ইকটু গাঢ়ো সম্পর্ক্, এবং একসময় বন্ধু বলে ডাক দেবার সম্পর্ক্ টা ঠিক কিভাবে গড়ে উঠে ছিলো, সেটা বোধহয় আশিক ভুলেই গেছে।আমার যে টুকু মনে পড়ে, তা হলো সম্পর্কের সূত্রপাত হয়েছিলো একটা ভিডিও ক্যাসেটকে ঘিরে।

তখন আমার কাছে ‘বিশ্ব মুসলিম গণহত্যা’র একটা ক্যাসেট ছিলো।আমাদের বাসায় এই ক্যাসেটটি চালাবার কোন ব্যবস্থা নাই জেনেও ২০০৩ এ মোহাম্মাদপুর থেকে এটি আমি কিনেছিলাম।ভেবেছিলাম সুযোগে কারো বাসায় দেখে নিবো।প্রথম সুযোগ হিসেবে আমি ‘আমাদের ম্যাডামের’ বাসায় গেলাম।ক্যাসেটটা প্রথমবারের মত চললো। কিন্তু মন দিয়ে আমি দেখতে পারলাম না।‘ম্যাডামের বাসায়’ কিছুতেই আমার মন বসতো না।অস্থিরতা টাইপের একটা অস্বস্তি কাজ করতো। যদিও সেই অস্বস্তি আমার খারাপ লাগতো না।তবে আরেকবার ক্যাসেটটা অন্য কোথাও দেখবার ইচ্ছাটাও কিন্তু দূর হলো না।

২০০৪ এ মুগদায় ভর্তি হয়ে এক ঝাঁক নতুন ক্লাসমেটের পাশাপাশি আমি আশিককেও পাই।নতুন যায়গা।নয়া পরিবেশ।‘মন বসে না পড়ার টেবিলের’ মতই দশা।তার উপর এমনই শীতের সময় ছিলো তখন।মনের অবস্থা তখন কেবলই উড়ু উড়ু।প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠেই প্রথম মনে হতো যে, আমি এখানে নতুন। সাথে সাথেই ‘হাল্কা নরম রোদের’ পুরো সকালটা্ই ফ্যাকাশে হয়ে উঠতো।কেবল ‘একটা ভাপা পিঠা’ ছাড়া। মধ্য মসজিদের পাশে ‘রহমানের দোকানের সামনে তখন খুব মজার ভাপা পিঠা বিক্রি হতো।ঘন গুর আর নারকেলে ভরা।এই পিঠাটাই ছিলো তখনকার সকালের কিছুটা ভালো লাগা।এমন ছোট ছোট কিছু ভালো লাগাকে ভর করেই কাটছিলো দিন।সকালে ভাপা পিঠা খেতাম আর দুপুরে গোসল করে ছাদে বসেবসে গায়ে তেল,লোশন মাখতাম।সাথে নতুন মুখগুলোর সথে হতে থাকতো টুকটাক আলাপ সালাপ।

এই আলাপ করতে করতেই সবাইকে চিনলাম। সবার কথা জনলাম। এবং সেই সাথে জানলাম আশিকের নিজেদের বাসাটা এখান থেকে খুব দূরে নয়।সে প্রতিদিন বিকালেই তার বাসায় যায়।তার বাসায় টিভি আছে।সিডি আছে।সে বাসায় গিয়ে প্রতিদিন নাস্তা করে।সিডিতে মজার মজার ভিডিও দেখে।বাসায় তার একটা ভাইয়া আছে।একটা আপু আছে।তারা কলেজে পড়ে। আর তাদের বাবা হলেন একজন রিটায়ার পার্স্ন আর্মি অফিসার।এসব শুনেই আমি তাকে জানালাম আমার সেই ‘ক্যাসেটটার’ কথা।এবং ক্যাসেটটা যে আমি দ্বিতীয়বার দেখতে চাই সেই কথা।

অতপর কোরবানি ঈদের ছুটি হলো।বাসায় গেলাম।বাসা থেকে আসার সময় সাথে করে নিয়ে এলাম ক্যাসেটটি।ছুটির পর প্রথমদিন তেমন একটা ক্লাস হয় না।তাই এই সন্ধ্যাতেই ক্যাসেটটা নিয়ে আশিক তার বাসায় নিয়ে গেলো।দুই তলার একটা বাসা।আমরা বাইরের একটা স্টিলের সিঁড়ি বেয়ে একটা রুমে ঢুকলাম।মেজেতে পা রেখেই বুঝলাম মেজেটা কাঠের তৈরি।পাশের রুমটাই আবার ঢালাই করা।
রুমটাতে বসেই আমি একটা পারফিউমের ঘ্রাণ পেলাম। দেখলাম রুমটা একদম গোছানো।মেহমান আসবে বলে মাত্র সাজানো হয়েছে এমন। পড়ার টেবিলে বইয়ের পাশে কাঁচা ফুল। তার সাথে ঘরটা আবার যথেষ্ট নিরব এবং মনোরম।

এই ঘরেই রাখা আছে আশিকদের সিডি প্লেয়ার আর টিভি। রুমটা আশিকের বড় ভাই ‘আপেল মাহমুদের’। তার একটা ছবিও ঝুলে আছে দেয়ালে।যেখানে তিনি একটা ক্যাপ পরে, পুকুরজলে পা ডুবিয়ে বসে আছেন।ছবিটা দেখেই মনে হলো; ‘কোন মেয়ে আছে যে একে দেখে প্রেমে পরবে না?’।হয়ত কত মেয়েই প্রেমে পরে গেছে তাকে দেখে। কিন্তু আমার বয়ে আনা ক্যাসেটটা তার ঘরে বসে আর দেখা হলো না।কারন তাদের ঘরে যে ভিডিও প্লেয়ারটা আছে সেটা সিডি প্লেয়ার। আমার ক্যাসেটটা ডিভিডির।কিন্তু এই তথ্যটা জেনেছি আমরা আরো অনেক পরে।

ক্যাসেটটা না দেখতে পেরে যতটা যাই লেগেছিলো আমার, হয়ত তার চেয়েও বেশি খারাপ লেগেছিলো আশিকের।আশিক ফিরতে ফিরতে তাই বারবার বলছিলো; ‘ধুত, ক্যান যে চল্লো না, কিছুই বুঝলাম না।আমার কাছেও বোঝাবার মত কোন জ্ঞান ছিলো না তখন।ফেরার পথে ঝিলপাড়ে আমরা হালিম/চটপটি খেলাম।এবং এর দুই চারদিন পর মোহাইমিনের বাসায় কম্পিউটারে ক্যাসেটটি খুব ভালো করে দেখলাম।ব্যবস্থাটা আশিকই করেছিলো।হয়ত সে একটা দায় নিয়েই দেখালো।এবং আশিকের বাসায় ক্যাসেটটি না চলার কারনটি খুঁজে পাওয়া গেলো।

এই ঘটনার পর থেকে আশিক প্রায় আমাকে বিকেলবেলা তার বাসায় নিয়ে যেতো।আমরা তখন তার ভাইয়ার ‘সেই’ রুমটায় বসতাম।প্রায় দিনই আশিকের আম্মা নাস্তা দিয়ে যেতো।আমরা বসেবসে নারিকেল আর চিনি দিয়ে মুড়ি খেতাম।আর নাটক দেখতাম।হুমায়ূন আহমেদের ‘উড়ে যায় বকপক্ষি, তারা তিনজন’ সহ আরো কত কী। কোলকাতার ছবিও দেখতাম মাঝেমধ্যে।এভাবেই একদিন তার বাসার সাথে সাথে তার ভাই, তার বোন, তার মা’ও, যেন দিনেদিনে আমারই বাসা, আমারই ভাই, আমারই বোন, আমারই মা মনে হতে থাকলো।কেবল তার বাবার সাথেই আমার কথা হতো না। মানুষটা কিছুটা কি রাগি ছিলো।হয়ত।কিন্তু ছেলেমেয়েরা তাকে কছিুটা যে ভয় পায় সে কথা বুঝা যেতো।

ছুটি হলেও আমার বাসায় যাবার আগে এই বাসাটা একবার হয়ে যেতাম আমি।মুগদা থেকে চলে আসার পরেও এই বাসায় অনেক গিয়েছি।গিয়েছি ঈদে, আনন্দে কিংবা উৎসবে।এককথায় ঢাকার শহরে এই বাসাটাতেই আমি সবচে বেশিবার গিয়েছি।কখনো কখনো থেকেছিও।এখনো সময় সুযোগ পেলে এই বাসাটায় আমি যাই।আশিকের সাথে সময় কাটাই।ভাইয়ার সাথে আড্ডা দেই।

কিন্তু গত কয়েকমাস হলো, একবরো যাওয়া হয় নি।এরই মধ্যে আশিক একবার ফোনে জানালো তার আব্বার শরীরটা বড্ড খারাপ। এবং শেষমেষ অন্য একজনের কাছে ক’দিন আগে জানতে পারলাম, তার আব্বা আর এই পৃথিবীতে নেই।

ভাবতেই বুকটা হু হু করছে যে সামনে যখন সেই বাসাটায় যাবো,তখন আর এই মানুষটাকে দেখবো না।শুনবো না আর আশিকের মুখে; ‘কিছু হইলেই আব্বা শুধু বকে’।আর দেখবো না্,ভরা বাজারের ব্যাগহাতে ধীর পায়ে হেটে আসছে আশিকের আব্বা।আশিক কিংবা ভাইয়া আমাকে জানায় নি তাদের বাবার চলে যাবার খবরটা।অথচ এর মাঝে আমাদের ইনবক্স হয়েছে।মৃত্যু যেহেতু সবচে বড় দুঃখ, তাই হয়ত এই দুঃখের খবরটা আশিক জানাতে চায় নি। কিংবা বাবার বকা না খেতে পেরে হয়ত সে আজ বুঝতে শিখেছে, বাবার বকাও যে এক টুকরো আকাশের মত। আর সেই আকাশটুকু খুঁজে না পেয়ে সে হয়ত একটা আকাশ খুঁজে বেড়াচ্ছে।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ১০:৪৯
৩টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও পদ্মশ্রী পুরস্কার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৬



এ বছরের পদ্মশ্রী (ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা) পদকে ভূষিত করা হয়েছে, বাংলাদেশের রবীন্দ্র সংগীত এর কিংবদন্তি শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে।

আমরা গর্বিত বন্যাকে নিয়ে । ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×