ক্লাসে সবচেয়ে ছোট ছিলাম, একটু বোকাসোকাও ছিলাম, বাকি ছাত্র-ছাত্রীদের সবাই আমার চেয়ে বয়সে বড় ছিল। যারা আমাদের পাড়ার তারা আমাকে ছোট বলে স্নেহ করত, সাথে করে স্কুলে নিয়ে যেত। আমাদের স্কুলে একজন নতুন স্যার আসলেন, বহুদিন পরেও সৰাই উনাকে নতুন স্যারই বলতো। একদিন নতুন স্যার এর ক্লাস এ খুব হৈচৈ চলছিল, আমার সেদিকে কোন খেয়াল নেই, আমি পেছনের বেঞ্চে বসে খেলছিলাম অথবা কিছু আঁকিবুকি করছিলাম, একসময় নতুন স্যার আমার নাম ঘোষণা করলেন, সঙ্গে সঙ্গে ক্লাসের সবাই জোড়ে চিৎকার দিয়ে ক্লাসরুম সরগরম করে তুললো। আমি কোনো কিছু বুঝতেই পারলাম না, অগত্যা স্যারের দিকে তাকিয়ে রইলাম। নতুন স্যার আমাকে বললেন এখন থেকে তুমি এই ক্লাসের ক্যাপ্টেন।
এদিকে ক্যাপ্টেন কি তার কাজ কি এসব কিছুই আমি জানিনা। আসল ঘটনা হলো নতুন স্যার ক্লাস ক্যাপ্টেন বানানোর জন্য সবাইকে ছোট কাগজে নিজ নিজ নাম লিখে স্যারের কাছে জমা দিতে বলেন, লটারির মাধ্যমে ক্যাপটেন নির্বাচিত করা হবে। আমাদের পাড়ার কুদ্দুস, নিজের নাম জমা দেয় পাশাপাশি আর একটা কাগজে আমার নাম লিখে জমা দিয়েছিল যা আমি জানতাম না। যাইহোক, আমি ক্ষুদে মহারাজ হয়ে গেলাম ক্লাস ক্যাপ্টেন। এই ঘোষণার পর যে মেয়েটি প্রায় প্রতিদিন আমাকে চোখ রাঙিয়ে ভয় দেখাতো ওর চেহারাটা হয়েছিল দেখার মতো। একদম যেন আকাশ থেকে পরেছিল।
স্যার আরো একটি ঘোষণা দিলেন যে পরদিন আমি সবাইকে বিস্কিট কিনে খাওয়াবো। ঘোষণার পর আমার মতো ছোট্ট মানুষটির ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া চেহারা দেখে স্যার বললেন কালকে ক্লাসের সবাই কিছু পয়সা নিয়ে এসে নতুন ক্যাপ্টেনের কাছে জমা দিবা ও তোমাদের বিস্কিট এনে খাওয়াবে। পরদিন কেউ দশ পয়সা, কেউ পাঁচ পয়সা আবার দু একজন পঁচিশ পয়সা করে এনে জমা দিয়েছিল। তারপর সস্তার বিস্কিট এনে সবাই মিলে খাওয়া হলো।
মূর্তিমান আতঙ্কের নাম ছিল সোরহাব স্যার, কিন্তু সেদিন এই আতঙ্ক মনে হয় স্রহস্যগুন বেড়ে গিয়েছিল। শোনা গেল স্কুলে ডাক্তার এসেছেন সবাইকে টিকা (ভ্যাকসিন) দেয়া হবে। ভয়ে সবাই তো একদম কাঠ, পালানোর জন্য সকলে এদিক ওদিক পথ খুজছিলাম, কিন্তু পালানোর কোন সুযোগই সেদিন আমাদের হাতে ছিল না। সবাই ক্লাসের ভিতরে আর সাক্ষাৎ জম আমাদের সোরহাব স্যার বেত নিয়ে দরজার সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে, টিকা দেয়ার সরঞ্জাম নিয়ে টিকাওয়ালা ক্লাসে ঢুকলেন, এদিকে আমাদের চোখে ছলোছল জল, নিজেকে যেন সবাই কোরবানির ছাগল মনে করেছিলাম সেদিন। একজন একজন করে দরজার সামনে এনে টিকা দেয়ার পর ছেড়ে দেয়া হচ্ছিল আর আমরা অশ্রু সজল চোখে বাড়ির পথ ধরছিলাম। এখন যতই সেদিনের কথা মনে করি আর সেদিনের ভয়গুলো ততই আনন্দে পরিণত হয়।
আরেক দিনের কথা বেশ মনে পড়ে, খুব সম্ভবত তখন তৃতীয় শ্রেণীতে পড়তাম, সোরহাব স্যার ইংরেজিতে বারো মাসের নাম লিখতে দিলেন, আমি সবগুলো মাসের নাম ঠিকঠাকই লিখেছিলাম, কিন্তু প্রথম দুই মাসের নাম ভুল করে লিখেছিলাম JANUAR, FEBRUAR । খাতায় লিখা দেখে স্যার প্রচন্ড আক্রোশে আমাকে বেত্রাঘাত করছিলেন আর প্রতিবার হাফাচ্ছিলেন আর বলছিলেন জানোয়ার ফেব্রুয়ার জানোয়ার ফেব্রুয়ার। আসলে আমি এধরনের ভুল করতে পারি স্যার সেটা মেনে নিতে পারেননি তাই খুউব রেগে গিয়েছিলেন।
তৃতীয় শ্রেণীতে সবচেয়ে বড় ছাত্র ছিল রাশেদ, বার্ষিক পরীক্ষায় পর পর তিনবার ফেল করার পর আমাদের সহপাঠী হলো সে। কেন জানি পড়াশোনা তার মাথায় কোনোভাবেই ঢুকতো না। একদিন অংক ক্লাসে অংক না পারাতে স্যার ওর উপর এমনই রেগে গেলেন যে একেবারে রুদ্র মূর্তি, ওকে ক্লাসের বাইরে খেলার মাঠে নিয়ে গিয়ে চৈত্র মাসের খাখা রোদ্রের মধ্যে সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকার শাস্তির আদেশ দিলেন। আর ওর কপালে বসিয়ে দিলেন এক টুকরা চাড়া (মাটির হারির ভগ্নাংশ) যাতে ও শাস্তি ফাঁকি দিয়ে মাথা নিচু করার সঙ্গে সঙ্গে চাড়া নিচে পড়ে গেলে ফাঁকিটা স্যার সহজেই ধরে ফেলতে পারেন। ও কিছুক্ষন কষ্ট করে ওখানে ছিল, তারপর লজ্জায় বই-পত্র ফেলে রেখে স্কুল থেকে সেই যে চলে গিয়েছিল আর কোনদিন স্কুলমুখি হয়নি।
আপনারা ছোটবেলায়, মেঝবেলায় বা বড়বেলায় কেউ কি ভূত দেখেছেন ? আমি দেখেছিলাম। তাও একবারে দিনে-দুপুরে! পরের পর্বে সেই ঘটনাটা আপনাদেরকে বলবো।
(সম্মানিত ব্লগারদের কাছে অনুরোধ থাকল বাক্য গঠন ও বানানে কোন ভুল পেলে অনুগ্রহ পূর্বক ধরিয়ে দিলে কৃতজ্ঞ থাকবো।)
আগের পর্বের লিংক:
আমার শৈশব - ১
চলবে....
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মে, ২০২৩ দুপুর ১২:৩৭