তখন ফাল্গুন কি চৈত্র মাস তা সঠিক মনে নেই। ওই সময়ে আমি ঠিক কোন ক্লাসে পড়তাম তাও মনে নেই, তবে আন্দাজ করি আমার বয়স তখন ৬-৮ বছরের মধ্যে হয়ে থাকতে পারে। দিনটি ছিল রৌদ্র করোজ্জ্বল। শরিক বাড়ির আমার চেয়ে বয়সে বড় ৬-৭ জন চাচাতো ভাই বোনের সাথে খাখা রোদ্দুর মাথায় নিয়ে রওয়ানা দিলাম। ফাঁকা মাঠের উপর দিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম। মাঠের বড় বড় শক্ত মাটির ঢেলা পায়ে মাড়িয়ে চলতে কষ্ট হলেও তার চেয়ে বেশি আনন্দ আর উচ্ছাসে আমরা ছিলাম উল্লসিত। কারন, পাড়াতো ফুপার বাড়ি যাচ্ছি বরই খেতে। কিন্তু হায়! গিয়ে দেখি বরইয়ের মৌসুম শেষ, গাছে পাতার আড়ালে ভুলে হয়তোবা দু একটা বরই আছে কি নাই। যাই হোক আমাদের অবস্থা দেখে বাড়ির গৃহিনী টিনের ঘরের চালে মাছ ধরার জালে করে শুকোতে দেওয়া শুকনো পাকা বরই নামিয়ে খেতে দিলেন। আমরাও ওগুলোই চিবাতে আরম্ভ করলাম। নাস্তা পানিও খেতে দেওয়া হল।
কিছুক্ষন যেতে না যেতেই আমার আর সেখানে মন টিকল না। আমি ছোট মানুষ বাড়ি ফেরার ইচ্ছা পোষন করলাম। কিন্ত কেউ তাতে কর্ণপাত না করে যার যার মতো বিভিন্ন রকম খেলাধুলায় মত্ত হয়ে গেল। উপায়ন্তর না দেখে আমি একাই বাড়ি ফেরার স্বিদ্ধান্ত নিলাম। বাড়িটার পশ্চিম দিকে কয়েকটি হিন্দু বাড়ি, পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে খোলা মাঠ আর পিছন দিকে অর্থাৎ উত্তর দিকে কচুরিপানা ও বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদে পূর্ন পরিত্যক্ত একটা পুকুর এবং তার উত্তরে খোলা মাঠ। পুকুরের দক্ষিণ পাশে অর্থাৎ বাড়ির পেছনে কিছুটা জঙ্গল। পিপুল, ঢেঁকিশাক, আরো নাম না জানা ছোট ছোট গাছ আগাছায় ছেয়ে আছে ওপাশটায়। প্রায় অর্ধেক পানি শুকিয়ে এসেছে তাই পুকুরের পার দিয়ে বড় ছোট কচুরিপানার কিছু মাটিতে শিকড় গেড়ে যারা পারছে জীবিত আছে আর বাকি গুলো মরে শুকিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছিল। বাড়িটার উত্তর পূর্ব দিকের কাছাড় বেয়ে নেমে এসে যেই আমি বাড়ির পথ ধরবো ঠিক তখনই আমার চোখ পড়লো ওর উপর। তারপর আমি যা দেখলাম তাতে ভয়ে আমার সমস্ত শরীরের রক্ত যেন এক নিমিষেই হিম হয়ে জমে গেল। আরাম কেদারায় মানুষ যেমন হেলান দিয়ে বসে ঠিক তেমনিভাবে গ্রীষ্মের দুপুরে পুকুরের ঢালে হেলান দিয়ে ছোট বড় আগাছার উপর আরাম করে ও ঠায় বসে আছে, ওর শরীরের উপরের দুই তৃতীয়াংশ দিনের আলোয় আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম। সমস্ত বুক ও শরীরে বড় বড় লোমে আবৃত, ওরকম ঘন ও বড় বড় লোম কোনো মানুষের শরীরে থাকেনা, তখন ভুত প্রেতের কোন ধারনাও খুব সম্ভবত আমার ছিলোনা, কিন্তু আমি ওকে দেখে যার পর নাই ভয় পেয়ে দুচোখ বন্ধ করে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার দিলাম, আমার চিৎকার শোনে বাড়ির সমস্ত লোকজন দৌড়ে আমার কাছে এল, আমি তখন ভয়ে দুচোখ বন্ধ করে কাঁপছিলাম আর কান্না করছিলাম, সবাই আমার কাছে কারন জানতে চাইলে আমি জঙ্গলের দিকে দেখিয়ে বললাম ওখানে একটা ভয়ঙ্কর মানুষ বসে আছে, সবাই লাঠি সোটা নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে খোজাখোজি করেও কোনো কিছুর সন্ধান না পেয়ে পশ্চিম দিকে হিন্দু বাড়ির দিকে এবং চারিদিকে সংক্ষিপ্ত সময়ে যতদূর একজন লোকের পক্ষে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়ে ততদূর পর্যন্ত খোঁজে কোনোকিছুরই সন্ধান পেল না।
প্রকৃতপক্ষে কি ঘটনা ঘটেছে সেটা সবাই বোঝার জন্য বিভিন্ন রকম চিন্তা ভাবনা করছিল, সবশেষে বাড়ির কর্তা আমাকে প্রশ্ন করলেন পাশেই বেঁধে রাখা সাদা বাছুরটা দেখে আমি ভয় পেয়েছি কিনা? আমি তখনও ভয়ে কাঁপছিলাম, কাঁদতে কাঁদতে না সূচক জবাব দিলাম, কিন্তু গৃহকর্তা সবাইকে বলতে লাগলেন যে আমি নাকি বাছুর দেখে ভয় পেয়েছি। গৃহকর্তা বিভিন্ন রকম তন্ত্র-মন্ত্র জানতেন, বড় হবার পর আমার ধারনা হয় যে ঐদিনের ঘটনাটার প্রকৃত বিষয়টা তিনি নিশ্চই জানতেন কিন্তু বিষয়টাকে কোন কারনে আড়াল করতে চেয়েছিলেন।
যাই হোক ব্যাপারটা আমার নিজের জীবনের ঘটনা, কারোর থেকে শোনা গল্প নয়। মনে হয় হ্যালোসিনেশনও নয়। আশা করবো অভিজ্ঞ ব্লগারদের কাছ থেকে এটার একটা যৌক্তিক ব্যাখ্যা মিলবে।
এবার অন্য গল্প। প্রাইমারিতে আমার পড়ার সাথী ও খেলার সাথীরা ছিল আলাদা। যাদের সাথে তখন খেলতাম তারা কেউ স্কুলে পড়তোনা। কিছুটা টোকাই শ্রেণীর বলা যায়। ওরাই ছিল আমার ওস্তাদ। স্কুল থেকে ফিরে এসে ওদের সাথে সারাদিন ঝোপে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতাম। কোথায় পাখির বাসা বেঁধেছে এগুলো সারাদিন খোঁজে বেড়াতাম। জঙ্গল থেকে বিভিন্ন রকম গাছ-গাছড়ার চারা এনে বাড়িতে লাগাতাম। বিষয়টি আমার মা পছন্দ করতেন না। আমার মা আমাকে নিয়ে বেশ চিন্তিত ছিলেন এজন্য কখনো তিনি বলতেন "সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে" আবার কখনো বা বলতেন "শেওড়ার সাথে থাকলে শেওড়া হয় আর চন্দনের সাথে থাকলে চন্দন হয়"।
আমার সবচাইতে পছন্দের বিষয় ছিল স্কুল কামাই দেওয়া। স্কুল জীবনে খুব সম্ভবত এমন কোন সপ্তাহই পাওয়া যাবেনা যেখানে পুরো ছয়দিন ক্লাসে উপস্থিত হয়েছি। ক্লাস ফাঁকি দেওয়া এবং স্কুল কামাই দেওয়া নিয়ে আমার অনেক মজার গল্প রয়েছে সময় পেলে অন্য কোন একদিন বলা যাবে। আজকে শুধু একদিনের গল্প আপনাদের সাথে শেয়ার করছি।
শুধু আমিই একা না, আমার মতো আরো অনেকেই ছিল যারা স্কুল কামাই দিতে পছন্দ করতো। আর ওদিকে বাসেদ স্যার যারা স্কুলে না আসতো তাদেরকে বাড়ি থেকে ধরে আনার জন্যকয়েকজন শক্তিশালী ছাত্রকে পাঠিয়ে দিত । তো এমনি একদিন পড়লো আমার ধরা খাওয়ার পালা। খালাতো বোন জামাই বেড়াতে এসেছেন আমাদের বাড়িতে, চিন্তা করলাম উনার সাথে যদি বাজারে যেতে পারি তবে তো স্কুলে যেতে হবে না। কিন্তু বাজারে থেকে ফিরে এসে দেখি তখন স্কুলে যাবার সময় রয়ে গিয়েছে। আমার মা তখন আমাকে স্কুলে যাবার জন্য প্রচন্ড চাপ দিতে থাকলেন। আমি উপায়ন্তর না দেখে গেলাম দুলাভাইয়ের কাছে। দুলাভাইয়ের সুপারিশে মা কোনোমতে স্কুলে যাওয়া থেকে সেদিনের মতো রেহাই দিলেন। কিন্তু কপাল খারাপ হলে যা হয় সেদিন তাই হলো। মা রান্না ঘরে লাকড়ির চুলায় রান্না করছিলেন আমি চুলার উল্টো পাশে বসে খেলছিলাম। এমন সময় বাসেদ স্যারের স্কুলে ফাঁকিবাজ ধরার এলিট ফোর্স আমাকে ধরে নিতে আমাদের বাড়িতে এসে হাজির। আমার অবস্থা খুব বেগতিক দেখে দুলাভাই তাদেরকে অনেক অনুরোধ উপরোধ করলেন কিন্তু তাতে কোন কাজ হলো না। ওঁরা আমাকে নির্দয়ভাবে চেংদোলা করে স্কুলে ধরে নিয়ে গেল। শুধু যদি ধরে নিয়ে যেত তাহলেও কোন দুঃখ থাকতো না। ওঁরা স্যারের কাছে গিয়ে আমার নামে ডাহা মিথ্যা অপবাদ রটিয়ে দিল যে আমি নাকি স্কুল কামাই দিয়ে ভাত রান্না করছিলাম। স্যার আমাকে বেত দিয়ে কষে একটা করে বারি দিচ্ছিলেন আর বলছিলেন "ভাত রাঁধুনি ভাত রান্দ্বে ভাত রাঁধুনি ভাত রান্দ্বে"
দুষ্ট ছেলে পেলেদের সাথে মিশে কত শত দুষ্টমির অভিজ্ঞতা হয়েছে তার বেশিরভাগই এখানে উল্লেখ করা হয় নাই। স্কুল পালানো, দলবেঁধে মাছ ধরতে যাওয়া, কারো শুন্য বাড়ির আম গাছের কাঁচা আম পেরে খাওয়া আরও কত কি। বিশ্বাস করুন এমনি অসংখ্য ত্যাদর পোলাপানের সাথে মিশেও আমি কেন যে ওদের মত না হয়ে আলহামদুলিল্আলাহ আমার মতনই রয়ে গেলাম এটা আমার কাছে বিরাট এক বিস্ময়! প্রসঙ্গান্তরে উল্লেখ্য কলেজ ভার্সিটি লেবেলে কিছু ভয়ংকর ছেলেপেলের সাথে পরিচয় হয়ে গিয়ছিল তারপরও আমি ওদের মত না হয়ে কিভাবে যে সত্যি সত্যিই আমার মতই আছি! হয়তোবা আমার মা-বাবার দোয়া আমাকে রক্ষা করেছে।
আগের পর্বের লিংক:
আমার শৈশব - ১
আমার শৈশব - ২