রক্তগঙ্গায় উত্তরণের বন্ধু-পিতা,
তোমাকে পত্র দেবার ইচ্ছা বহুলভাবে লালিত থাকলেও ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে নির্লজ্জের লাজ কাটিয়ে তা লিখতে বসার দুঃসাহস কখনই ছিল না । কিন্তু আজকের একটা অধ্যায় যেন বারবার তোমাকেই নির্দেশ করে যাচ্ছিল । একান্তই ব্যক্তিগত একটা ঘটনা যেন সহসাই জাতীয় স্বার্থের ব্যপকতা ধারণ করছিল ।
ছোট ভাইকে নিয়ে বইমেলায় গিয়েছিলাম । বিপ্লবী চে’র উপর লেখা একটা বই চোখে পড়ল । ভাইটির ব্যাগে চে’র বাণীসহ একটা ছবি দেখেছিলাম । ভাবলাম এই বইটিই হবে ওর জন্যে যথোপযুক্ত । কিন্তু ওর দেখলাম আগ্রহ হিমাংকেরও নিচে । আমার এই বয়সের বিশ্বাসগুলো ধ্বসে পড়ল আর তলিয়ে গেল এদের আধুনিকতার অতলে । আমি যেন কী একটা ফালতু ‘সেন্টিমেন্ট’ নিয়ে ওর অগ্রযাত্রাকে পেছন থেকে টেনে ধরছিলাম ।
বঙ্গবন্ধু, তুমিও আজ লটকে আছো ব্যাগে, দেওয়ালে, দিবসে আর রাজনৈতিক ব্যানারে । ৩২-এ যে সিঁড়িতে তুমি শেষবার সংবর্ধনা পেলে সেখানে একটা ছবি টাঙানো হয়েছে-তোমার বুক ফুঁড়ে রক্তিম ধারা বেরিয়ে আসছে । বাংলার বুক আজ অমনি করে রক্তাক্ত হয়ে আছে । তোমার স্বপ্নগুলো ঐ রক্ত যারা নষ্টদের তালিকায় ভিড় জমিয়েছে ।
ভাবছো চিঠিতে কুশলাদির বালাই কই । তুমি যে ভালো নেই তা আমি নিশ্চিত বুঝি । ভালোরা ভালো থাকে না । আর আমি? তা না হয় পত্র পড়েই বুঝে নিও ।
লিখতে লিখতে চিঠিতে হয়ত একসময় ইতি টানব । কিন্তু জেনে রেখো, এই অভিযোগী বৃত্তান্তের কোন অন্ত নেই ।
কখনও তোমাকে অনেক বোকা মনে হয় । ১০’জানুয়ারীর সেই অকৃত্রিম প্রশান্তিতে বুক চিরে বেরিয়ে আসা বাঁধহীন হাসি আর ১৫’আগস্টের সিঁড়ি বেয়ে গরিয়ে আসা মৃত্যুহীন ছিদ্র হওয়া বুক, লেগে থাকা ঠোঁট, অবনত ডানহাত আর বুজে থাকা চোখ-কিচ্ছুতেই মেলাতে পারিনা । তুমি রবি’র শুধু ‘সোনার বাংলা’ই জেনছো’, ‘রেখেছো বাঙালি করে, মানুষ করনি’-এটা জাননি ।
ওরা এখন রাজনীতির নর্দমায় খুন হয়ে নামের আগে ‘শহিদ’-শব্দটির যথার্থতা বিচারে হোলি খেলে । তোমার নামে তা বসাতে পারিনা । তুমি তো মরণি । সূর্য হয়ে আছো-দিন শেষেও চাঁদ মারফত আলো পাঠাও ।
বন্ধু, দেশের কথা কী বলি? নির্মলেন্দু তো বলেছেনই-‘মাঠের বিরুদ্ধে মাঠ, মার্চের বিরুদ্ধে মার্চ, কবির বিরুদ্ধে কবি ।’ মাঝে মাঝে মৃত লোকটাও লজ্জায় আত্মহত্যা করে এই শুনে তোমার ঘোষণাও আজ স্বীকৃতি পেতে হাইকোর্টের দ্বারস্থ ইতর সাজে । বন্ধুমহলে অবিরাম সংঘর্ষ চলে ঘোষকের স্থিরতা নিয়ে ।
কাণ্ডারি, তুমি তো পালিয়ে(??) পাকিস্তান চলে গেলে । মুক্তিযুদ্ধের চেতনার তুমি কী বোঝ? মুক্তিযুদ্ধ কী বুঝতে এই প্রজন্মের কাছে এসো । এরা যুক্তি-তর্ক মাধ্যমে ’৭১ কে আরও যৌক্তিক করে, আরও অর্থবহ করে । শুনে হয়তো রডকোষ-কোণকোষের পাত্তা না দিয়েই চোখ থেকে অক্ষিগোলক বেরিয়ে আসতে চাইবে-এখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে-বিপক্ষে দল বিভাজন হয় । কেউ আবার মধ্যপন্থী হয়ে উভয় কূল রক্ষা করে । পাটুরিয়ার একই ফেরীতে দেশদ্রোহী(!!) তোফায়েল পুলিশ ভ্যানে আর দেশবন্ধু নিজামির গাড়ীতে লাল-সবুজের মর্যাদা অবিরত শ্লীলতাহানির স্বীকার হয় । তোমার নামে নামকরণে আজ সুশীল সমাজের জিহ্বা চুলকায় । এতে নাকি তুমি দিনদিন সস্তা হয়ে যাচ্ছ । ওরা বোঝেনা যা দুর্লভ তার কোন অর্থ বিচার চলে না ।
জানো, তখনকার ছাত্র-আন্দোলন এখন ছাত্র-রাজনীতিতে বদলে নিয়েছে নিজেকে । রাজনীতির বাদ-প্রতিবাদ এখন রক্তের রগে কথা বলে । হরতালের অসহায়ত্বে রাজনীতির নিদর্শন মেলে । রাজনীতি দর্শিতে এসো বিশ্বজিতের পরিবারে । রাজনীতির দেখা মেলে বিদেশী ব্যাংকে । রাজনীতির সুশাসনে তোমার জাহানারারা আটকা পড়েন । না-না, চুরি-ডাকাতি কিংবা খুন-খারাবির জন্যে নয় । স্রেফ দেশদ্রোহিতার(!!) পাপে ।
শুনে আঁতকে উঠো না । ‘৭১এ জন্মহীনদের পাপে নোংরা হয়েছিল যেসব যোনীধারীরা তাঁরা আজও তাঁদের পাপের আর নোংরামির সাজা সয়ে-বয়ে বেড়াচ্ছেন । আর যারা ওদের মনোরঞ্জনে নিজেদের উজাড় করে দিয়েছিল তারা আজ পাতলা কাপড়ে ক্ষমতার চাবি আঁচলে বাঁধার স্বীকৃতি পায় । তুমি যাদের নিষিদ্ধ করলে তারাই বিনা ভিসায় প্রত্যাবর্তন করে, রাষ্ট্রযন্ত্রের কল-কাঠি নাড়ায় । বারবার করে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা হয় । তবুও কেন আক্তার চাচার কুলি খেটে সংসার চালাতে হয় সেই প্রসঙ্গ না হয় নাইবা বললাম । তবুও পাঠ্য-পুস্তকে ইতিহাস বিকৃতির লজ্জা লুকোয় কী করে?
পাক-বিচরণ আজও ঊর্ধ্ব-শিরে । পার্থক্য সেদিন ওরা ছিল আগ্রাসী, আজ আমরা ওদের নিরাপত্তা বিধান করি । শহীদ মুস্তাক আর জুয়েলের রক্ত মাড়িয়ে গ্যালারীতে গিয়ে ‘আফ্রিদি,আফ্রিদি’ বাক-চিত করি । রক্ত গালিচার শেষ অধ্যায়ও থাকবে পাক-প্রীতিতে রঞ্জিত ।
কি? দমে গেলে? সত্যিই এতো নিদারুণ অবস্থা? না! তোমার সন্তান হয়ে দগ্ধ কণ্ঠে জানিয়ে দিচ্ছি, জাতিসংঘে আবার আমরা বাংলায় উচ্চারণের দৃঢ়তায় আত্মমর্যাদার চরম শিরে আরোহণ করছি । তোমার প্রাণের কৃষক-শ্রমিকদের আজ তথ্য-প্রযুক্তির আবর্তে আঁটকে ফেলেছি । এখন মুক্তিযোদ্ধার সন্তনরা ভালো জায়গায় পড়তে পারে, সহজেই চাকুরী পায় । মেয়েদের মাকড়সার জালে ঢাকা চার দেয়ালের জগত থেকে বেরিয়ে এনে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য চলছে সকল আয়োজন ।
জঙ্গিবাদের মেরুদণ্ড মচকে দেওয়া হয়েছে । সিরিজ বোমা হামলা এখন ইতিহাস । ধর্ম ব্যবসায়ীদের তালিকায় আর একটি গোষ্ঠী অবশিষ্ট আছে । আশি আগামী পত্রেই ওদের কবর রচনার খবর পাবে ।
এখন অনলাইনেই ঘটনার উল্লেখ, পর্যবেক্ষণ আর উত্তাল প্রতিবাদ চলে । ইতিহাসের সত্যতা নিরূপণে সেখানে টগবগে রক্তওয়ালা তরুণ । তোমার ছেলেরা আজ ২২গজে গর্জে ওঠে, বাঘের ক’ঘা থাবা দিয়ে ছিনিয়ে আনে বিজয় ।
তোমার দানের স্বার্থকতা পুনশ্চে এঁকে দিলাম-মূল চিঠির এতো ক্ষমতা নেই যে তা মুল চিঠিতে ধারণ করে । শুধু একটাই প্রতিবন্ধকতা-চোরের খনি থেকে অবিরাম উত্তোলন চলছে ।
ইতি-
এক দিকচ্যুত খাদক
(তোমার খুনের রক্তে চোখ ঢেকে আছে । তাইতো অন্ধ চোখের দিক-ভ্রান্তিতে সম্ভাবনাগুলোকে গিলে খাচ্ছি ।)
পুনশ্চঃ শাহবাগে প্রজন্ম চত্বর – ‘১৩তে’৭১ । ফিরে এসেছে ‘জয় বাংলা’...ফিরবে জাতির পিতাও...
ফেসবুক লিঙ্কঃ Click This Link